“ডুয়ার্স”। শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে আদিম গহীন অরণ্যের এক রোমহর্ষক ছবি। দুপাশে আকাশছোঁয়া ঘন জঙ্গলের বুক চিরে ছুটে চলা কালো জাতীয় সড়কের ছবিটা দেখলেই আপনার মনে হবে এই বুঝি হাতির পাল রাস্তা পেরোলো কিংবা এক ছুটে পার হয়ে গেল একটি সম্বর হরিণ। ইট কাঠ কনক্রিটের জঙ্গল পেরিয়ে ফুসফুস ভরে টাটকা সতেজ দূষণহীন বাতাসের সাথে দু’চোখ ভরে সবুজ দেখার ইচ্ছে থাকলে একবার অন্তত ঘুরে আসতেই হবে আপনাকে ডুয়ার্স । তিন চার দিনের ছুটিতে জঙ্গল, চা বাগান, খরস্রোতা নদী, পাহাড়, ঝর্ণার এমন অনবদ্য কোলাজ আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
ডুয়ার্স কোথায়
পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে পশ্চিমবঙ্গের তিস্তা নদী থেকে আসামের ধানসিঁড়ি নদী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলটি ডুয়ার্স নামে পরিচিত। তিস্তা নদীর ডানদিকের অঞ্চলটি তরাই এবং বাঁ দিকের অঞ্চলটিকে ডুয়ার্স বলা হয়। রাজনৈতিকভাবে পশ্চিমবঙ্গ ডুয়ার্স অঞ্চলটি পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলা ও আলিপুরদুয়ার জেলার সমগ্র অংশ ও কোচবিহার জেলা ও কালিম্পং জেলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। অন্যদিকে অসম ডুয়ার্স অঞ্চলটি অসমের ধুবড়ি, কোকড়াঝাড়, বরপেটা, গোয়ালপাড়া ও বঙ্গাইগাঁও জেলা নিয়ে গঠিত। ভারত থেকে ভুটানে প্রবেশের অন্যতম মাধ্যম এই ডুয়ার্স। উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার হিসেবেও ডুয়ার্স পরিচিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই অঞ্চলের গড় উচ্চতা প্রায় ১৫০-১৭০০ মিটার। পূর্ব ও পশ্চিম ডুয়ার্স মিলিয়ে সমগ্র অঞ্চলটি প্রস্থে প্রায় ৩০ কিমি এবং দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩৫০ কিমি বিস্তৃত। পূর্ব হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল থেকে বিভিন্ন নদীর মাধ্যমে বাহিত পলি, বালি ও নুড়ি জমে হিমালয়ের পাদদেশের নীচু জমিতে এই তরাই ডুয়ার্স অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে। সমগ্র অঞ্চলটি মোটামুটিভাবে উত্তর থেকে দক্ষিণে ঢালু এবং নদীখাতের নীচু অংশ বাদে অঞ্চলটি প্রায় সমতল। তবে এখানে ছোট ছোট পাহাড়ের অবস্থানও চোখে পড়ে। মহানন্দা, মেচি, ডায়না, বালাসন, তিস্তা, লিস, ঘিস্, মূর্তি, জলঢাকা, মজনু, তোর্সা, কালজানি, রায়ডাক প্রভৃতি এখানকার উল্লেখযোগ্য নদী । এই অঞ্চলটিকে ঘিরে ভুটান, চিন অধিকৃত তিব্বতের কিছু অংশ এবং বাংলাদেশের সীমানা রয়েছে। সড়কপথে শিলিগুড়ি থেকে লাটাগুড়ির দূরত্ব ৬৩ কিমি এবং আলিপুরদুয়ারের দূরত্ব ১৫৭ কিমি। বর্ধমান রেল জংশন থেকে ডুয়ার্স সরাসরি পোঁছানোর উপায় নেই। ডুয়ার্সের কোন সার্কিটটিতে আপনি ঘুরতে চাইছেন তার ওপর নির্ভর করে আপনাকে তার নিকটবর্তী স্টেশন নিউ জলপাইগুড়ি বা নিউ ময়নাগুড়ি বা নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে নেমে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে ডুয়ার্স যেতে হবে। বর্ধমান স্টেশন থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের দূরত্ব ৪৭১ কিমি,নিউ ময়নাগুড়ি স্টেশন ৫৩৪ কিমি এবং নিউ আলিপুরদুয়ার ৬৩০ কিমি। কলকাতা থেকেও ডুয়ার্স যেতে হলে একইভাবে যেতে হবে। এক্ষেত্রে কলকাতা থেকে নিউ জলপাইগুড়ির দূরত্ব ৫৮৩ কিমি, নিউ ময়নাগুড়ি স্টেশন ৬০৯ কিমি এবং নিউ আলিপুরদুয়ার ৭০৩ কিমি।
ডুয়ার্সের ইতিহাস
ডুয়ার্সের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। এই অঞ্চলটি একদা কোচ কামাতাপুর রাজ্যের অধীনস্থ ছিল। এই রাজ্যের রাজা ছিলেন কোচ রাজা বিশ্ব সিং। ডুয়ার্সের হিঙ্গুলাভা অঞ্চলটি ছিল কামাতাপুর রাজ্যের রাজধানী। এই হিঙ্গুলাভা অঞ্চলটি বর্তমানে আলিপুরদুয়ার সাব ডিভিশনের অন্তর্গত। পরবর্তীকালে রায়ডাক নদীর বন্যায় এই অঞ্চলটি বিপর্যস্ত হলে বিশ্ব সিং তাঁর রাজধানী হিঙ্গুলাভা থেকে সরিয়ে আনেন। ইতিমধ্যে ভুটান রাজের সাথে কোচ রাজাদের শত্রুতা বাড়তে শুরু করলে কোচ রাজ তাঁর রাজধানী ডুয়ার্সের দক্ষিণে সরিয়ে নিয়ে যান এবং ডুয়ার্সও কালক্রমে ভুটান রাজাদের দখলে চলে আসে। ডুয়ার্সের দখলদারি নিয়ে ভুটান রাজার সাথে কোচ রাজাদের লড়াই ক্রমে ব্রিটিশদেরও ডুয়ার্সের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। ১৭৭২ সালে ভুটান কোচবিহার দখল করে নিলে কোচ রাজ ব্রিটিশদের সাহায্য চান যার ফল স্বরূপ প্রথম অ্যাংলো-ভুটান যুদ্ধ শুরু হয়। এরপর ১৮৬৪ সালে দ্বিতীয় অ্যাংলো-ভুটান যুদ্ধ হয় এবং যার ফলশ্রুতি ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশ এবং ভুটানের মধ্যে হওয়া ‘সিঞ্চুলা চুক্তি’। এই সিঞ্চুলা চুক্তির মাধ্যমেই ব্রিটিশ সরকার ডুয়ার্সের দখল পাকাপাকিভাবে নিজেদের হাতে নেয়।
‘ডুয়ার্স’ শব্দটির উৎপত্তি ‘দুয়ার’ বা ‘দোর’ থেকে যার অর্থ – ‘দরজা’ । এক সময় ভুটান থেকে ভারতে প্রবেশের এরকম ১৮টি দোর বা প্রবেশ পথ ছিল যেগুলিকে একত্রে ডুয়ার্স বলা হত। এর মধ্যে এগারোটি পশ্চিমবঙ্গে যথা – ১) ডালিমকোট ২) চামুরচি ৩) জুমারকোট ৪) লাকি বা লক্ষ্মী ৫) বক্সা ৬) ভাল্কা ৭) গোমার ৮) রিপো ৯) বাগ ১০)ময়নাগুড়ি ১১) সিদলি এবং সাতটি অসমে অবস্থিত যথা – ১) বড়িগুমা ২ ) কালিং ৩ ) শুরকোলা ৪) চাপাগুড়ি ৫) বান্সকা ৬) চাপকাহামা এবং ৭) বিজনি। তবে বর্তমানে সমগ্র ডুয়ার্স অঞ্চলটিকে সংকোশ নদী পূর্ব ও পশ্চিম ডুয়ার্স এই দুই ভাগে ভাগ করেছে। পূর্ব ডুয়ার্স পরিচিত অসম ডুয়ার্স এবং পশ্চিম ডুয়ার্স পরিচিত পশ্চিমবঙ্গ ডুয়ার্স নামে।
ডুয়ার্স কীভাবে যাবেন
ট্রেনে করে ডুয়ার্স যেতে হলে প্রথমে আপনাকে ঠিক করতে হবে আপনি বক্সা জয়ন্তি সার্কিটটি ঘুরবেন না গরুমারা লাটাগুড়ি সার্কিটটি ঘুরবেন আগে। যদি আপনি মনে করেন বক্সা জয়ন্তি সার্কিট থেকে আপনার ডুয়ার্স ভ্রমণ শুরু করবেন তাহলে আপনাকে নামতে হবে নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে। এখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে আপনি সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন বক্সা জাতীয় উদ্যান যার দূরত্ব এখান থেকে সড়কপথে গাড়িতে ২৮ কিমি। সময় লাগবে মোটামুটি ১ ঘন্টা মত। লাটাগুড়ি গরুমারা সার্কিটটি ঘুরতে হলে নিকটবর্তী স্টেশন হল নিউ ময়নাগুড়ি। এখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে আপনি সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন লাটাগুড়ি যার দূরত্ব এখান থেকে সড়কপথে গাড়িতে ২২ কিমি। সময় লাগবে মোটামুটি ৩০ মিনিট মত। গাড়ি ভাড়া লাগবে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে। নিউ আলিপুরদুয়ার বা নিউ ময়নাগুড়ি স্টেশন অবধি পৌঁছানোর ট্রেন না পেলে আপনাকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন নামতে হবে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে লাটাগুড়ি কিংবা আলিপুরদুয়ার যাওয়ার অনেক গাড়ি পেয়ে যাবেন। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে লাটাগুড়ির সড়কপথে দূরত্ব ৫৪ কিমি। গাড়িতে সময় লাগবে দেড় ঘন্টা মত। গাড়ি ভাড়া পড়বে ২৬০০ – ৪২০০ টাকার মধ্যে।
বাসে যেতে চাইলে শিলিগুড়ি অবধি আপনাকে বাসে আসতে হবে। সরকারি ছাড়াও বেসরকারি প্রচুর বাস আছে যেগুলি শিলিগুড়ি অবধি আপনাকে অনায়াসে পৌঁছে দেবে। শিলিগুড়ি থেকে বক্সা যাওয়ার সরাসরি বাস নেই। উত্তরবঙ্গ পরিবহন নিগমের একটি মাত্র বাস সকাল ৭ টা নাগাদ শিলিগুড়ি থেকে ছেড়ে দুপুর ১২.৩০ মিনিটে আলিপুরদুয়ার পৌঁছে দেয়। আলিপুরদুয়ার থেকে বক্সা পৌঁছানোর সরাসরি বাস নেই। সারা দিনে দুটো বাস কোচবিহার থেকে ছেড়ে আলিপুরদুয়ার হয়ে জয়ন্তী পৌঁছে দেয়। সময় লাগে ১ ঘন্টা। বক্সা জাতীয় অরণ্য যেতে হলে আলিপুরদুয়ার থেকে গাড়ি ভাড়া করে নিকটবর্তী রাজাভাতখাওয়া অবধি যাওয়া যেতে পারেন। সময় লাগবে ৩০ মিনিট মত।
নিজস্ব গাড়িতে সড়কপথে বক্সা জয়ন্তী যেতে হলে আপনাকে শিলিগুড়ি থেকে হিলকার্ট রোড হয়ে ২৭ নং জাতীয় সড়ক ধরে আলিপুরদুয়ার হয়ে ১৮০ কিমি যেতে হবে। সময় লাগবে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা। আর যদি লাটাগুড়ি যেতে চান তাহলে শিলিগুড়ি থেকে গাজলডোবা এবং ক্যানাল রোড ধরে ৬৩ কিমি যেতে হবে। সময় লাগবে দেড় ঘন্টা।
ডুয়ার্সে কোথায় থাকবেন
অত্যন্ত জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হওয়ার কারণে সমগ্র ডুয়ার্স জুড়েই অসংখ্য সরকারি এবং বেসরকারি হোটেল, রিসর্ট এবং হোম স্টে রয়েছে। বক্সা জয়ন্তি সার্কিটে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন উন্নয়ন নিগম এবং বন উন্নয়ন নিগমের বেশ কিছু হোটেল এবং রিসর্ট রয়েছে যার ভাড়া ২০০০ – ৪০০০ টাকার মধ্যে। এগুলির বুকিং অনলাইনে করতে হলে কেবল মাত্র পর্যটন উন্নয়ন নিগম এবং বন উন্নয়ন নিগমের ওয়েবসাইটে গিয়েই করতে পারবেন। এই রিসর্টগুলির অত্যন্ত চাহিদা থাকার কারণে বুকিং পেতে হলে বেশ আগে থেকেই ঘর বুকিং করা ভালো। নাহলে ঘর পাওয়া বেশ মুশকিল হয়ে পড়ে। বেসরকারি প্রচুর হোটেল রিসর্ট এবং হোম স্টে রয়েছে এখানে। হোটেল এবং রিসর্ট ভাড়া মোটামুটি ভাবে ১৮০০ – ৪০০০ টাকার মধ্যে। অবশ্য চাহিদা অনুযায়ী এই ভাড়া কম বেশি হতে পারে। হোম স্টেগুলির ভাড়া জনপ্রতি প্রতি দিনের জন্য তিনবেলা খাওয়া এবং থাকা মিলিয়ে ১৫০০ টাকা থেকে শুরু হয়।
অন্যদিকে গরুমারা লাটাগুড়ি সার্কিটেও সরকারি এবং বেসরকারি স্তরে প্রচুর হোটেল রিসর্ট এবং হোম স্টে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বক্সা জয়ন্তির থেকে এখানে হোটেল রিসর্টের সংখ্যা অনেক বেশি। পর্যটন উন্নয়ন নিগম এবং বন উন্নয়ন নিগমের হোটেল এবং রিসর্টগুলির ভাড়া ১৫০০ – ৪০০০ টাকার মধ্যে। বেসরকারি হোটেল রিসর্টগুলির ভাড়া মোটামুটি ভাবে ১৫০০ – ৮০০০ টাকার মধ্যে। অবশ্য চাহিদা অনুযায়ী এই ভাড়া কম বেশি হতে পারে। হোম স্টেগুলির ভাড়া জনপ্রতি প্রতি দিনের জন্য তিনবেলা খাওয়া এবং থাকা মিলিয়ে ১০০০ টাকা থেকে শুরু হয়।
ডুয়ার্সে কী দেখবেন
ডুয়ার্স বিখ্যাত তার বিস্তীর্ণ অরণ্যরাজি, অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বৈচিত্র্যময় বন্যপ্রাণীর জন্য। ডুয়ার্সের মত এত সবুজের সমারোহ আপনি পশ্চিমবঙ্গের আর কোথাও পাবেন না। বিরল এক শৃঙ্গ বিশিষ্ট গণ্ডার থেকে ভারতীয় বাইসন গৌর, বিরল ধনেশ পাখি থেকে ময়ূরের ঝাঁক, নিভৃতচারি হরিণ যুগল থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাতির পাল – ডুয়ার্স আপনার ভ্রমণপিপাসু মনকে কানায় কানায় ভর্তি করবেই এ কথা হলফ করে বলা যায়। তবে যেহেতু ডুয়ার্স একটি বিশাল বিস্তীর্ণ এলাকা তাই পায়ে হেঁটে দেখার সুযোগ এখানে নেই বললেই চলে। প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে আপনাকে সমস্ত দর্শনীয় স্থানগুলি দেখতে হবে। ভ্রমণ কেন্দ্র হিসেবে ডুয়ার্সকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায় – ১) পূর্ব ডুয়ার্স ২) কেন্দ্রীয় ডুয়ার্স এবং ৩) পশ্চিম ডুয়ার্স ।
পূর্ব ডুয়ার্স
এই অঞ্চলটি মূলত আলিপুরদুয়ার জেলা ও কোচবিহার জেলার কিছু অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে। দ্রষ্টব্য স্থানগুলিকে তিনভাগে ভাগ করা যায় – ১) বক্সা জয়ন্তি ভ্রমণ কেন্দ্র ২) চিলাপাতা ভ্রমণ কেন্দ্র ৩) জলদাপাড়া ভ্রমণ কেন্দ্র। বক্সা জয়ন্তি ভ্রমণ কেন্দ্রের অন্তর্গত প্রধান দ্রষ্টব্য স্থানগুলি হল – বক্সা জাতীয় উদ্যান, বক্সা দুর্গ, জয়ন্তী । অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে – সিকিয়াঝোরা, ছোট মহাকাল মন্দির, পুকরি হ্রদ, রাজাভাতখাওয়া, চুনিয়া ওয়াচ টাওয়ার, হাতিপোতা। চিলাপাতা ভ্রমণ কেন্দ্রের অন্তর্গত দ্রষ্টব্য স্থানগুলি হল – চিলাপাতা অরণ্য ও নলরাজার গড়। জলদাপাড়া ভ্রমণ কেন্দ্রের অন্তর্গত প্রধান দ্রষ্টব্য হল – জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান । এছাড়া এখানকার অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থানগুলি হল – টোটোপাড়া বস্তি, খুটিমারি অরণ্য, গারুচিরা গ্রাম, দক্ষিণ খয়েরবাড়ি, মুজনাই চা বাগান ও ধুমচি অরণ্য, কুঞ্জনগর ইকো পার্ক, রাঙামাটি, রায়মাটাং, নিমতি, জয়গাঁও ও ফুন্টশেলিং ইত্যাদি।
কেন্দ্রীয় ডুয়ার্স
এই অঞ্চলটি মূলত জলপাইগুড়ি জেলাকে কেন্দ্র করে অবস্থান করছে। এই অঞ্চলে অবস্থিত দ্রষ্টব্য স্থানগুলিকে তিনভাগে ভাগ করা যায় – ১) জলপাইগুড়ি ভ্রমণ কেন্দ্র ২) গরুমারা অরণ্য ও তৎসংলগ্ন ভ্রমণ কেন্দ্র ৩) মালবাজার ভ্রমণ কেন্দ্র। ঘন সবুজ অরণ্য ছাড়াও এই কেন্দ্রীয় ডুয়ার্স মনোরম চা বাগান, পাহাড়ি ঝর্না, খরস্রোতা নদী সহ এক অনবদ্য অভিজ্ঞতার ডালি সাজিয়ে আপনাকে স্বাগত জানাবে। তবে কেন্দ্রীয় ডুয়ার্স রেঞ্জে গরুমারা সার্কিটিই সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয়। এখানে সেখানকারই দ্রষ্টব্য স্থানগুলি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
জলপাইগুড়ি ভ্রমণ কেন্দ্র – জলপাইগুড়ি শহর সংলগ্ন বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থানগুলি হল – ভ্রামরী দেবীর মন্দির, জল্পেশ্বর মন্দির, জটিলেশ্বর মন্দির, দেবী চৌধুরানী মন্দির, ভবানী পাঠক মন্দির, বৈকুণ্ঠপুর অভয়ারণ্য ইত্যাদি।
গরুমারা অরণ্য ও তৎসংলগ্ন ভ্রমণ কেন্দ্র – ডুয়ার্স ভ্রমণের সবথেকে জনপ্রিয় ভ্রমণ সার্কিট এই অঞ্চলটি। ঝর্ণা, পাহাড়, অরণ্যের এক ত্রিবেণী সঙ্গম যেন এই অঞ্চলটি। সঙ্গে এখানে থাকা অসংখ্য হোটেল এবং রিসোর্ট এখানে পর্যটকদের মধ্যে ভ্রমণ স্থল হিসেবে এলাকাটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রেখেছে। এখানকার মূল দ্রষ্টব্য হল – গরুমারা জাতীয় উদ্যান, মূর্তি নদী, ঝালং, সুন্তালেখোলা ও চাপড়ামারি অরণ্য। এছাড়া এখানকার অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থানগুলি হল -ধুপঝোরা গাছ বাড়ি, কালীপুর গ্রাম, সামসিং, রকি আইল্যান্ড, বিন্দু, লালিগুরাস ভিউ পয়েন্ট, মেটেলি, জুরান্তি চা বাগান, পারেন, জলঢাকা ও রঙ্গো।
মালবাজার ভ্রমণ – মালবাজার ভ্রমণ কেন্দ্রটি জলপাইগুড়ি জেলার মাল সাবডিভিশন এবং দার্জিলিং জেলার কালিম্পং সাবডিভিশনের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। মূলত অসংখ্য নয়নাভিরাম চা বাগানের জন্যই এই অঞ্চলটি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়। এই পর্যটন কেন্দ্রের অন্তর্গত বিশেষ দ্রষ্টব্যগুলি হল – চুইখিম গ্রাম, গরুবাথান গ্রাম, ওদলাবাড়ি, কাথামবাড়ি অরণ্য ও ফাগু।
পশ্চিম ডুয়ার্স
এই অঞ্চলটি মূলত তিনভাগে বিভক্ত যথা – ১) শিলিগুড়ি ভ্রমণ কেন্দ্র ২) তরাই ডুয়ার্স ভ্রমণ কেন্দ্র এবং ৩) মহানন্দা অভয়ারণ্য ভ্রমণ কেন্দ্র। পূর্ব ও কেন্দ্রীয় ডুয়ার্সের মত এত সুবিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত না হলেও এই অঞ্চলটি মূলত কার্শিয়াং , কালিম্পং , দার্জিলিং ও সিকিম সহ নেপাল,ভুটান প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সীমানাগুলির প্রবেশদ্বার হিসেবে বিখ্যাত।
১) শিলিগুড়ি ভ্রমণ কেন্দ্র – শিলিগুড়ি শহর ও শহরের মধ্যে অবস্থিত দর্শনীয় স্থানগুলি হল – বেঙ্গল সাফারি পার্ক, বাঘপুল বা করোনেশন ব্রিজ, নর্থ বেঙ্গল সায়েন্স সেন্টার, ড্রিমল্যান্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, গজলডোবা, রোহিনী লেক, হংকং বাজার, ইস্কন মন্দির, মধুবন পার্ক, দুধিয়া, সাভিন কিংডম, সালুগাড়া গুম্ফা, সিপাই ধুরা চা বাগান, সেবকেশ্বরী কালী মন্দির ইত্যাদি। ২) তরাই ডুয়ার্স ভ্রমণ কেন্দ্র – এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলি হল – ভারত নেপাল সীমান্ত, নক্সালবাড়ি, ফাঁসিদেওয়া, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, শিবখোলা অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প প্রভৃতি। ৩) মহানন্দা অভয়ারণ্য ভ্রমণ কেন্দ্র – এখানে রয়েছে স্রোতস্বিনী নদী, বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত যা আপনাকে মুগ্ধ করবে।
ডুয়ার্সে কখন যাবেন
বছরের যে কোন সময়েই ডুয়ার্স যাওয়া যেতে পারে। তবে বর্ষাকালে না যাওয়াই ভালো। ডুয়ার্সের মূল আকর্ষণ অভয়ারণ্যগুলি এই সময় বন্ধ থাকে। ডুয়ার্স যাওয়ার আদর্শ সময় হল সেপ্টেম্বর থেকে মে মাস। মনোরম আবহাওয়ার সাথে বিভিন্ন স্থানীয় উৎসব প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে ডুয়ার্সকে অনুভব করার আদর্শ সময় এটি।
ডুয়ার্সে কী খাবেন
ডুয়ার্স বেড়াতে যাবেন আর বোরোলি মাছ খাবেন না তাহলে আপনার ডুয়ার্স ভ্রমণ অনেকটাই বৃথা। তিস্তার বোরোলি মাছকে উত্তরবঙ্গের ইলিশ বলা হয়। এই মাছের স্বাদে মজেছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় থেকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। এছাড়া বেলাকোবার বিখ্যাত চমচম না খেলেও এই ভ্রমণ বৃথা। চমচমের কথাই যখন উঠল তখন লাটাগুড়ির বিখ্যাত দৈত্যাকৃতি চমচমের কথাই বা বাদ দেওয়া যায় কীভাবে। ৫০০ গ্রাম থেকে সর্বাধিক ১ কেজি ওজনের চমচম হয়। এছাড়া লাটাগুড়ি ঘুরতে গেলে একবার অবশ্যই স্বাদ নিতে হবে মাদারিহাটের বিখ্যাত কমলাভোগের। আসল কমলালেবুর খোসা থেকে বানানো হয় এই মিষ্টি।
ডুয়ার্সে কী কিনবেন
ডুয়ার্সে বেড়াতে গিয়ে চা কেনা যেতেই পারে। তবে খেয়াল রাখবেন এটি কিন্তু দার্জিলিং চা নয়। ডুয়ার্স চা কিন্তু দার্জিলিং চায়ের থেকে আলাদা জাতের চা। মূলত লাটাগুড়ি জলপাইগুড়ি ও শিলিগুড়ি সংলগ্ন চা বাগানগুলিতে এই চায়ের চাষ করা হয়। স্বাদে এবং গন্ধে দার্জিলিং চায়ের ধারে কাছে না এলেও একবার কিনে দেখতেই পারেন। এছাড়া তিব্বতীয় শিল্পরীতিতে তৈরি বিভিন্ন ঘর সাজানোর উপকরণ এবং বেত ও পাটের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী আপনি লাটাগুড়ি ও জলপাইগুড়ি তে কিনতে পারেন।
সতর্কতা ও পরামর্শ
- বর্ষাকালে ডুয়ার্স না যাওয়াই ভালো। অভয়ারণ্যগুলি অত্যাধিক বৃষ্টি হওয়ার কারণে জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ অবধি বন্ধ থাকে। নির্দিষ্ট তারিখ জানার জন্য পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের ওয়েবসাইট দেখতে হবে।
- বক্সা টাইগার রিজার্ভ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কের বেশ সমস্যা আছে। সুতরাং ইন্টারনেটের আশা না করাই ভাল। জয়ন্তিতে তুলনায় নেটওয়ার্কের সমস্যা কম।
- জঙ্গলের মধ্যে যে হোম স্টেগুলি আছে সেখানে কিন্তু এ সি’র ব্যবস্থা নেই। তাই গ্রীষ্মকালে বেড়াতে গেলে এই বিষয়টি মাথায় রেখেই ঘর বুক করবেন।
- জিপ সাফারি করবার সময় উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরবেন না, গায়ে সুগন্ধি মাখবেন না। এতে বন্যপ্রাণীরা আকৃষ্ট হতে পারে। হালকা সুতির ও জলপাই সবুজ বা হাল্কা রঙের পোশাক পরাই ভাল।
- বক্সার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি যাতায়াতের রাস্তা রয়েছে। ফাঁকা রাস্তা হওয়ার কারণে অত্যন্ত দ্রুত বেগে গাড়ি যাতায়াত করে যার ফলে বন থেকে আচমকা বড় কোন বন্যপ্রাণীর সাথে যেমন সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তেমনি আপনার গাড়ির আঘাতে বাঁদর জাতীয় ছোট বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর সম্ভাবনাও থাকে। তাই গাড়ির গতি দ্রুত না রাখাই ভাল।
- বক্সার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় বাঁদরদের উদ্দেশ্যে খাবার ছড়াবেন না। বাঁদররা খাবারের লোভে রাস্তায় এসে দ্রুতগতির যানবাহনের ধাক্কায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
- রাস্তার মাঝে আচমকা হাতি বা হাতির পাল বা বাইসন এসে পড়লে বা রাস্তা পেরোলে সাহস দেখিয়ে ওভারটেক করতে যাবেন না। হাতি বা হাতির পাল বা বাইসন রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে না ঢোকা অবধি নিরাপদ দূরত্বে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবেন।
- হাতি বা বাইসন গাড়ি যাতায়াতের রাস্তায় বেরিয়ে পড়লে গাড়ি থামিয়ে দুঃসাহস দেখিয়ে হাতির ছবি বা হাতির সাথে সেলফি তুলতে যাবেন না। এতে হাতি ভয় পেয়ে আক্রমণ করতে পারে তখন পালানো মুশকিল হবে।
- জলদাপাড়া ও ধুপঝোরায় হাতি সাফারি হয়। তবে বুকিং কিন্তু অনলাইনে হয়। মনে রাখবেন হলং টুরিস্ট লজে যারা থাকবেন এই হাতি সাফারির ক্ষেত্রে তাঁরা আগে সুযোগ পাবেন। প্রতি ব্যক্তি ১২০০ – ১৪০০ টাকা করে ভাড়া পড়বে এক ঘন্টা ভ্রমণের।
- গরুমারা অভয়ারণ্য ভ্রমণের ক্ষেত্রে মেদলা ওয়াচটাওয়ারে মোষের গাড়িতে সাফারি হয়। সমগ্র ডুয়ার্সে কেবল এখানেই আপনি এই সুযোগ পাবেন।
- রাতে তো নয়ই এমনকি দিনেও একা একা জঙ্গলে বা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া গাড়ি যাতায়াতের রাস্তায় ঘুরতে বা ফটোগ্রাফি করতে যাবেন না।
- সিকিয়াঝোরায় নৌকো ভ্রমণকালে নদীর জলে প্লাস্টিক বা কোন বর্জ্য পদার্থ ফেলবেন না। মাঝিকে লাগোয়া জঙ্গলে যাওয়ার জন্য নৌকোকে পাড়ে লাগানোর জন্য জোর করবেন না। লাগোয়া জঙ্গলে হাতির উপদ্রব আছে মাথায় রাখবেন।
- মূর্তি নদী এবং রকি আইল্যান্ডে জলে ডোবা নুড়ির পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে ফটো তোলবার আগে পা দিয়ে দেখে নেবেন শ্যাওলা জমে আছে কিনা। সাধারণত এই পাথরগুলি শ্যাওলা জমে খুব পিচ্ছিল প্রকৃতির হয়ে থাকে। পা পিছলে এখানে একবার পড়লে বড় বিপদ হতে পারে। কাছে পিঠে ডাক্তার কিংবা হাসপাতাল পাবেন না।
- জঙ্গলে সাফারি কালে কোনভাবেই ধূমপান করবেন না। এটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
- সরকারি সমস্ত টুরিস্ট লজের বুকিং আগে থেকে আপনাকে করে আসতে হবে। এখানে কিন্তু স্পট বুকিং হয় না। আপনি অনলাইনে বা বন উন্নয়ন দপ্তরের অফিসে গিয়েও বুকিং করতে পারেন।
- ভারত সরকার প্রদত্ত আপনার সচিত্র পরিচয় পত্র এবং তার ফটোকপি আপনার সঙ্গে রাখবেন সর্বদা।
- ফার্স্ট এইড ও আপনার প্রয়োজনীয় ওষুধ পত্র সাথে নিয়ে আসবেন। এখানে কিন্তু ধারে কাছেও ওষুধের দোকান পাবেন না।
- দূরবীন বা উচ্চ জুম সম্পন্ন ক্যামেরা সঙ্গে আনলে ভাল হয়। জঙ্গলে সাফারি কালে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বন্যপ্রাণী বা পাখি দেখতে আপনার মোবাইল ক্যামেরা বিশেষ কাজে আসবে না।
- যাত্রা শুরুর আগে দর্শনীয় স্থান এবং ডুয়ার্স নিয়ে প্রাথমিক কিছু পড়াশোনা করে আসবেন। এতে ঘোরার আনন্দ আরও বেড়ে যাবে।
ট্রিপ টিপস
- ডুয়ার্সে ভ্রমণের সময় মাথায় রাখবেন এখানে কিন্তু এটিএম পাবার সম্ভাবনা খুবই কম। এখন অবশ্য ইউপিআই পেমেন্টের সুবিধা এসে গেছে । তবুও জঙ্গল ভ্রমণে পর্যাপ্ত নগদ টাকা সঙ্গে রাখাই শ্রেয় ।
- এখানকার বিখ্যাত বেলাকোবার চমচম, লাটাগুড়ির দৈত্যাকৃতি চমচম ও মাদারিহাটের কমলাভোগ না খেয়ে বাড়ি ফিরবেন না। লাটাগুড়িতেই আপনি এইসব মিষ্টি পেয়ে যাবেন।
সর্বশেষ সম্পাদনার সময়কাল – ২০২৪
তথ্যসূত্র
- নিজস্ব প্রতিনিধি
- https://en.wikipedia.org/
- https://coochbehar.gov.in/
- https://www.anandabazar.com/
- https://bengali.news18.com/
- https://monerutthone.wordpress.com/
- http://simanachariya.weebly.com/
- http://simanachariya.weebly.com/
- https://bangla.gkbooks.in/
- https://www.bongodorshon.com/
- https://bangla.aajtak.in/
আপনার মতামত জানান