রিচার্ড ফিলিপস ফাইনম্যান (Richard Philips Feynman)। আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের দুনিয়ার একমাত্র রকস্টার বিজ্ঞানী বলা যেতে পারে তাঁকে। অসামান্য মেধার সঙ্গে তাঁর একেবারে স্বতন্ত্র ঘরানার চিন্তা পদ্ধতি তাঁকে একদিকে যেমন বিজ্ঞান জগতের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে তেমনই অন্যদিকে তাঁর হাস্যরসাত্মক মননটি তাঁকে বিজ্ঞানীর স্বভাব সুলভ ভাব গাম্ভীর্যের খোলসের বাইরে বেরিয়ে এক অসামান্য বর্ণময় চরিত্র হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছে। বিজ্ঞানের দুরূহ গাণিতিক সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি তাঁর স্বভাবজাত ‘রেডি উইট’ তাঁকে বিজ্ঞানী মহলে তো বটেই এমনকি সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর এক রকস্টার সুলভ ভাবমূর্তি তৈরি করে দিয়েছে। রিচার্ড ফাইনম্যানের জীবনের এরকমই কিছু অনন্য সাধারণ মজার ঘটনা আসুন আজ আপনাদের সাথে ভাগ করে নিই।
সেটা ১৯৫৭ সাল। আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনায় আয়োজিত হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অন জেনারেল রিলেটিভিটি অ্যান্ড গ্র্যাভিটেশন-এর দ্বিতীয় দ্বিবার্ষিক সম্মেলন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে বিশ্বখ্যাত দুঁদে পদার্থবিদদের আমন্ত্রণ করা হয়েছে। বাদ যাননি ফাইনম্যানও। রালে -ডারহ্যাম এয়ারপোর্টে নেমে দেখলেন তাঁকে রিসিভ করবার জন্য কেউ আসেনি এয়ারপোর্টে। একটু বিস্মিতই হলেন রিচার্ড ফাইনম্যান । এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। আসলে ঠিক এমনটাই হওয়ার কথা ছিল কারণ তিনি সম্মেলন শুরু হওয়ার পরের দিন পৌঁছেছেন যে। এর ওপর তাঁর অভ্যেস হল যেখানে যাচ্ছেন সেখানকার ঠিকানা বা কারও ফোন নম্বর সঙ্গে না রাখা। তাঁর বিশ্বাস ঠিক একটা উপায় হয়ে যাবে গন্তব্যে পৌঁছানোর। তো সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দেখলেন সামনে একজন ব্যক্তি ট্যাক্সি ডেকে দিচ্ছেন এয়ারপোর্টে যারা গাড়ি নিয়ে আসেননি তাঁদের জন্য। ফাইনম্যান দেখলেন এই ব্যক্তিকেই জিগ্যেস করা যাক। সেই ব্যক্তিকে ডেকে বললেন – “ওহে শুনছেন, নর্থ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটি যাব কীভাবে বলতে পারবেন?” সেই ব্যক্তি ট্যাক্সি ডাকতে ডাকতেই উত্তর দিলেন – “দুটো নর্থ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটি আছে। একটা উত্তরে একটা দক্ষিণে। আপনি কোনটায় যাবেন ?” ফাইনম্যান পড়লেন মহা ফাঁপরে। তাঁর তো ঠিকানা বা নাম কিছুই মনে নেই। হঠাৎ মাথায় একটা আইডিয়া খেলে গেল তাঁর। তিনি ওই ব্যক্তিকে ডেকে বললেন – “আমি একটা বিজ্ঞান সম্মেলনে যাব। একদিন দেরীতে পৌঁছেছি। গতকাল এই এয়ারপোর্টে এমন একদল লোককে কি আপনি দেখেছেন যাঁদের দেখে খুব ভাবুক প্রকৃতির মনে হয়? আর তাঁরা নিজেদের মধ্যে যখন আলোচনা করছিল তখন তাঁরা মাঝে মাঝেই জি-মিউ-নিউ, জি-মিউ-নিউ’ (G_{\mu \nu }) এই শব্দগুলি বলছিল ? এই দুটো পয়েন্ট ধরিয়ে দিতেই সেই ব্যক্তির মুখ হাসিতে ভরে উঠলো। “বুঝেছি” বলেই তিনি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললেন – “এনাকে চ্যাপেল হিল-এর ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে দিন।’’ ফাইনম্যানও ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়লেন ট্যাক্সিতে। এটাই রিচার্ড ফাইনম্যান – গোয়েন্দা না পদার্থবিদ বোঝা দায়।
ফাইনম্যানের বিশেষ শখ ছিল ধাঁধা তৈরীতে। কেবল শখ বললে অবশ্য কম বলা হয় এই ধাঁধা বানানোতে তাঁর বিশেষ দক্ষতাও ছিল। এই ধাঁধা তৈরিতে তাঁর স্ত্রীয়েরও বিশেষ আগ্রহ ছিল। লস অ্যালামসের পরমাণু বোমা বানানোর গবেষণাগারে কাজ করাকালীন নিউ ইয়র্কে থাকা স্ত্রীয়ের সাথে এই ধাঁধায় লেখা চিঠির মাধ্যমে কথা বলতেন তিনি। ধাঁধার আশ্রয় নেওয়ার কারণও ছিল অবশ্য – গবেষণাগারের নিরাপত্তা বিভাগের কড়া সেন্সরের রক্তচক্ষু এড়িয়ে একটু মনের কথা লেখা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই সময়ে লস অ্যালামস গবেষণাগারে কর্মরত সকল বিজ্ঞানীর লেখা চিঠি খুলে দেখত সেন্সর বিভাগ। সেই নজরদারি এড়াতেই একবার রিচার্ড ফাইনম্যান চিঠিতে লিখলেন স্ত্রীকে – “ সাত হাজার ফুট উঁচুতে থাকায় নিউ মেক্সিকোর গরমটা আমরা টের পাচ্ছিনা।” সেন্সর বিভাগের প্রধান ম্যাককিলভি ফাইনম্যানের কাছে এসে বললেন – “সরি স্যার, আপনার এ চিঠি পাস হবে না।” “তা কি এমন আপত্তিকর বিষয় পেলেন আমার চিঠিতে ?’’ ফাইনম্যান বেশ খানিকটা বিরক্ত হয়েই জিগেস করলেন। ম্যাককিলভি হাসতে হাসতে বললেন – “আপত্তিকর বলে আপত্তিকর স্যার ! প্রথমত এই লাইনটির মাধ্যমে আপনি আপনার স্ত্রীকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে আপনি এই মুহূর্তে নিউ মেক্সিকোতে আছেন। দ্বিতীয়ত, এবার যদি আপনার মিসেস নিউ মেক্সিকোর ম্যাপ খুলে বসেন তাহলে সাত হাজার মিটার ওপরে আপনি ঠিক কোথায় আছেন তার একজ্যাক্ট লোকেশন উনি সহজেই পেয়ে যাবেন। মাফ করবেন এই লাইনটি আপনাকে কাটতে হবে।” প্রবল বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ রিচার্ড ফাইনম্যান চিঠিটা ছিঁড়ে ফেললেন।
যদি ভেবে থাকেন এখানেই রিচার্ড ফাইনম্যান থেমে গেলেন আর সেন্সর বোর্ডের হাতে এই পরাজয় চুপচাপ হজম করে নিলেন তাহলে বুঝতে হবে আপনি ফাইনম্যানীয় মেধার সাথে এখনও পুরোপুরি পরিচিত হননি। এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর আবার একটি চিঠি সহ খোলা খাম নিয়ে হাজির মি ম্যাককিলভি। ফাইনম্যান তাঁকে দেখেই মিটি মিটি হাসতে লাগলেন। ম্যাককিলভির তো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। কাঁদো কাঁদো মুখে চিঠিটি দেখিয়ে বললেন – “ এই যে আপনি লিখেছেন – “ RETEP কেমন আছে ? SBM OBMOTA মনে হয় এ বছর এসে পৌঁছতে পারবেন বলে মনে হয় না। এই RETEP টা কে আর SBM OBMOTA ইনিই বা কে ? আমি তো মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। ” ফাইনম্যান গম্ভীরভাবে বললেন – “ যাকে চিঠি লিখছি সে বুঝলেই হল। আপনার না বুঝলেও চলবে। ” – “স্যার তা বললে কি করে হয়। দয়া করে বুঝিয়ে দিন না স্যার।” ম্যাককিলভি কাতরভাবে বললেন। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর অবশেষে বরফ গললো। “শব্দগুলো আসলে ওলোট পালট করে লেখা। আমার স্ত্রী বুঝবে। RETEP হল PETER আমার ছেলের নাম। আর SBM OBMOTA হল আমার ছেলের কিউবান গভর্নেস মিসেস OBMOTA” ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়লো ম্যাককিলভির।
এই ঘটনার তিনদিন পরে ম্যাককিলভি ডাক মারফত একটি চিঠি পেলেন। ছোট চিঠি। চিঠিটির উল্লেখ নারায়ণ সান্যাল তাঁর মিথ হয়ে যাওয়া বই ‘বিশ্বাসঘাতক’ এ করেছেন। যে ভঙ্গিমায় তিনি চিঠিটির বর্ণনা করেছেন সরাসরি সেটাই তুলে দিলাম। চিঠিতে লেখা –
“প্রিয় ইডিয়ট,
তোমাকে চারটে খবর জানাচ্ছি। এই চিঠিখানা পড়েই ছিঁড়ে ফেল। আর খবর চারটে বেমালুম গিলে ফেল। হজম করে ফেল। জানাজানি হলেই তোমার চাকরি নট। বুঝলে হাঁদারাম ?
এক নম্বর খবর : প্রফেসর ফাইনম্যানের পীটার নামে কোন পুত্রসন্তান নেই।
দুই নম্বর : পীটার একজন রাশিয়ান এজেন্টের ছদ্মনাম।
তিন নম্বর : মিসেস মোবোটা নামে কোনও চাকরাণী ওঁর নিউ ইয়র্কের ডেরায় কোনদিন ছিল না।
চার নম্বর : চিঠিতে অক্ষরগুলো আদৌ উল্টোপাল্টা করে সাজানো ছিল না। ছিল, স্রেফ উল্টো করে সাজানো। Retep উল্টো করলে হয় Peter ; কেমন তো ? এবার SBMOB MOTA কথাটা উল্টে নিয়ে বুঝবার চেষ্টা করত মূর্খ সম্রাট – ATOM BOMBS – কথাটা জানাজানি হলে তোমার চাকরি থাকবে তো !
ইতি
Guess Who !”
ম্যাককিলভি পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন প্রথম ও তৃতীয় খবরটি সত্য। অজ্ঞাত পরিচয় এই পত্রলেখক যে কে ম্যাককিলভি অনেক খুঁজেও তা বের করতে পারেননি।
ফাইনম্যানের একটি মুদ্রাদোষ ছিল – কথায় কথায় তিনি বলে উঠতেন – “ কী বলছেন আপনি পাগলের মত।” মুদ্রাদোষ হলে যা হয় – স্থান কাল পাত্র জ্ঞান থাকে না কথা বলার সময়ে। ফাইনম্যানের সাথেও একবার তাই হয়েছিল। ঘটনাটা খুলেই বলি তাহলে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা বিশ্বখ্যাত নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী নিলস বোর তাঁর একটি নতুন গবেষণার বিষয়ে লস অ্যালামসে একটি কনফারেন্স করবেন ঠিক করলেন। কনফারেন্স শুরুর একদিন আগেই তিনি লস অ্যালামস পৌঁছে প্রফেসর ফাইনম্যানের সাথে কিভাবে যোগাযোগ করা যাবে খোঁজ নিতে শুরু করেন। অবশেষে ফাইনম্যানের ফোন নম্বর জোগাড় হল। কল করলেন নিলস বোরের ছেলে জিম বেকার। বললেন বাবা আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান। আপনি কি এখন একবার গেস্ট হাউসে আসতে পারবেন ? ফাইনম্যান বেশ খানিকটা তাজ্জবই হয়েছেন এত নামজাদা বাঘা বাঘা সব বিজ্ঞানী থাকতে তাঁর মত এক ছোকরা বিজ্ঞানীর সঙ্গে কেন দেখা করতে এত উদগ্রীব প্রফেসর বোর ! যাইহোক ফাইনম্যান জিম বেকারকে বললেন – “আমি এক্ষুনি আসছি।” গেস্ট হাউসে পৌঁছে দেখলেন নিলস বোর বসে আছেন। “তোমার নামই রিচার্ড ফাইনম্যান তো” – ফাইনম্যানের দিকে তাকিয়ে বললেন নিলস বোর। “আজ্ঞে হ্যাঁ প্রফেসর”, বিস্ময়াবিষ্ট ফাইনম্যানের ছোট্ট উত্তর। “বেশ ! এবার এই রিপোর্টটা একটু দেখতো সব ঠিক ঠাক আছে কিনা।” প্রফেসর বোরের এই অনুরোধে কি বলবেন ভেবে পেলেন না ফাইনম্যান। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর রিপোর্ট কিনা ভেরিফাই করবেন তাঁর মত একজন নগন্য বিজ্ঞানী! কিন্তু বিস্ময়ের রেশ কেটে গেল অচিরেই ফাইনম্যান ডুব দিলেন অংক সাগরের অতল গভীরে। রিপোর্ট দেখতে দেখতে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠেন ফাইনম্যান – “আরে এ কী করেছেন আপনি পাগলের মত! এখানে আটটা ‘আননোন’ আর সাতটা ‘ইকুয়েশন’ লিখেছেন? এ তো কোন দিনই সমাধান করা যাবে না।”
পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন জিম বেকার। লোকটা বলে কী? নিলস বোরকে কিনা ‘পাগল’ বলছে দুদিনের এই ছোকরা? রাগে এবং বাবার অপমানে জিম বেকারের কান লাল হয়ে গেছে ততক্ষণে। নিলস বোর কিন্তু নির্বিকার। তিনি বললেন – “কিন্তু অষ্টম ইকুয়েশনটাও তো আমাদের হাতে আছে। সমাধান কি একেবারেই সম্ভব নয়?” বুলেটের ক্ষিপ্রতায় উত্তর এল ফাইনম্যানের থেকে – “বেশ! চলুন তাহলে অঙ্কটা করে ফেলা যাক।” এরপর সেই যে আল্ফ়া বিটা গামা থিটা ডেল্টার স্রোত শুরু হল সেই স্রোত সুনামি হয়ে যখন শেষ হল ঘড়ির কাঁটায় তখন পাক্কা রাত তিনটে। নিলস বোরকে বিদায় জানিয়ে ফাইনম্যান বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে গাড়ি অবধি এগিয়ে দিতে এলেন জিম বেকার। গাড়িতে উঠতে গিয়েও থমকে গেলেন ফাইনম্যান। জিম বেকারের দিকে তাকিয়ে বললেন – “আচ্ছা একটা কথা বলবো?” “বলুন” – স্মিত হেসে বললেন জিম বেকার। “আচ্ছা আপনার বাবা আমাকেই কেন বাছলেন তাঁর রিপোর্ট ভেরিফাই করার জন্য? আরও অনেক নামজাদা বিজ্ঞানী তো ছিলেন !” “হ্যাঁ নিশ্চয়ই ছিলেন। কিন্তু তাঁরা কেউ আমার বাবাকে ‘পাগল’ বলার ক্ষমতা রাখতেন না।” হতভম্ব ফাইনম্যান। “পাগল! কে বলেছেন প্রফেসর বোরকে ?” “আপনি বলেছেন – শান্ত ভাবে হাসতে হাসতে বললেন জিম বেকার। “কি যা তা বলছেন আপনি পাগলের মত! আমি এমন বলতেই পারি না।” তাজ্জব এবং লজ্জিত ফাইনম্যান। “আমি নিজে কানে শুনেছি। আমি পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম আপনি যখন বললেন।” “তাহলে চলুন আমি গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসি ওনার থেকে” – ফাইনম্যান কাতরভাবে বললেন। “প্লিজ প্রফেসর, অনেক রাত। বাবা এখন শুয়ে পড়েছেন। আমি বাবাকে বলে দেব আপনি ক্ষমা চেয়েছেন।” অত্যন্ত লজ্জিত এবং বিষণ্ণ হয়ে এক প্রকার বাধ্য হয়েই গাড়িতে উঠলেন রিচার্ড ফাইনম্যান ।
ফাইনম্যানের প্রতিভা যেন বর্ণালীর সাত রঙ। প্রতিটা রঙই আপন আপন গুণে উজ্জ্বল। তাঁর এই সাত রঙা প্রতিভার অন্যতম একটি রং হল তাঁর মুখে মুখে চুটকি বলার ক্ষমতা। যেকোন একটা সিচুয়েশন বা যেকোন ব্যক্তির কোন একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে তিনি ছড়া তৈরি করতে পারতেন। নিলস বোরের গবেষণার রিপোর্ট নিয়ে ভোর রাত অবধি আলোচনার পর দুপুরে বোরের লেকচার ছিল। লেকচার শেষে বিজ্ঞানীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে করতে হল থেকে বেরোচ্ছেন। এমন সময় এক বিজ্ঞানী ফাইনম্যানকে জিজ্ঞেস করলেন – “প্রফেসরের বক্তব্য আপনার কেমন লাগলো?” জবাবে ফাইনম্যান তাঁর অনুনকরণীয় স্টাইলে বললেন –
Professor Bohr
Knows no whore
Drinks no liquor
Is no bore .
প্রবাদ প্রতিম বিজ্ঞানীকে নিয়ে অনেকেই অনেক গালভরা বিশেষণে তাঁকে এর আগে ভূষিত করেছেন। কিন্তু মাত্র চার লাইনে ফাইনম্যান যেভাবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করলেন তা বোধ হয় কেবল রিচার্ড ফাইনম্যান নামক এক বিরল প্রতিভাধর ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। এখন যদি ভাবেন এখানেই নটে গাছটা মুরলো তাহলে দাঁড়ান। ফাইনম্যান শোয়ের এখনও কিছু বাকি আছে।
নিলস বোরকে নিয়ে কবিতাটি শোনার পর আরেক বিজ্ঞানী ক্লাউস ফুকস রিচার্ড ফাইনম্যান কে বললেন – “আরে মশাই করেছেন কি? নিলস বোর নামে তো কেউ নেই! শুনলেন না ওনার নাম (নিকোলাস বেকার)।” জাস্ট বলার অপেক্ষা – ফাইনম্যানের মুখ থেকে বুলেটের মত বেরিয়ে এল
Nicholas Baker
Epoch Maker
Atom Breaker !
Yet he is not
A liquor – taker !
পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আরেক বিজ্ঞানী লিও ৎজিলার্ড। আমেরিকার পরমাণু বোমা তৈরিতে অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। ৎজিলার্ড বললেন – “মি ফাইনম্যান, এবার মি. ফুক্সকে নিয়ে একটা হয়ে যাক।
ফাইনম্যানের ব্যাট থেকে আবার একটা লম্বা ছক্কা।
Fuchs
Looks
An ascetic
Theoretic
এখন কথা হচ্ছে প্রফেসর বোর লস অ্যালামসে কর্মরত বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদের ভিড়ে ফাইনম্যানের খোঁজ পেলেন কীভাবে? সেও এক গল্প। নিউ মেক্সিকোর লস অ্যালামসে ঘটে চলা পৃথিবীর প্রথম পরমাণু বোমার প্রস্তুতি যজ্ঞের অন্যতম বড় কর্তা ছিলেন বিখ্যাত পদার্থবিদ রবার্ট উইলসন। এই উইলসন একদিন ফাইনম্যানকে ডেকে বললেন তোমাকে একবার শিকাগো যেতে হবে। শিকাগোতে গিয়ে তোমার কাজ হল ওখানে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা পরমাণু বোমা বানানোর কাজে কতটা এগিয়েছে সেটা দেখে এখানে আমাদের জানানো। আমরা সেই মত এখানে বোমা বানানোর সেট আপ তৈরী করা শুরু করব। ফাইনম্যানও গুরুর আদেশ শিরোধার্য করে বেরিয়ে পড়লেন শিকাগোর উদ্দেশ্যে।
শিকাগোতে পৌঁছে ফাইনম্যান সেখানে কর্মরত বিজ্ঞানীদের সব দলগুলির কাজ মন দিয়ে দেখতে শুরু করলেন। হঠাৎ একদিন শুনলেন কি একটা অঙ্ক নিয়ে সবার মাথা খারাপ। জগৎজোড়া খ্যাতিমান বিজ্ঞানীদের কেউই এই অঙ্কটি বুঝতে পারছেননা। ফাইনম্যানের যা স্বভাব! আগ বাড়িয়ে গিয়ে জিগেস করলেন – কি সমস্যা হয়েছে যদি একটু বলেন। বছর সাতাশের ফাইনম্যান অঙ্ক নিয়ে বসলেন। তারপর? তারপর আর কি! অঙ্ক আর ফিজিক্স একবার মাথায় ঢুকলে যা হয় এখানেও তাই হল। বিশ্ব সংসার ভুলে গিয়ে সেই যে দুর্বোধ্য সব গাণিতিক হিসেবের কোন অতলে ডুব দিলেন উঠলেন পাক্কা আধ ঘন্টা পর। সমাধান সহ অঙ্কটা বিজ্ঞানীদের টেবিলে রেখে যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তখন তিনি সদ্য সাতাশে পা দেওয়া এক উঠতি বিজ্ঞানী। লস অ্যালামসে ফিরে এই বিষয়টি নিয়ে কথা উঠতে উইলসনকে ফাইনম্যান বলেছিলেন – “ওনাদের কাছ থেকে কত কি শিখলাম। তাই আসবার আগে গুরু দক্ষিনাটা দিয়ে এলাম।” এরকম জিনিয়াসকেই প্রফেসর বোর খুঁজবেন শেষ পর্যন্ত তা বলাই বাহুল্য।
এবার আরেকটা ঘটনার কথা বলি। ১৯৮৬ সালের ঘটনা। আমেরিকার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে উৎক্ষেপিত মহাকাশ যান ‘চ্যালেঞ্জার’ উৎক্ষেপণের ৭৩ সেকেন্ডের মধ্যে প্রবল বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে যায় এবং সাত মহাকাশচারীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন দুর্ঘটনার তদন্ত করার জন্য বসালেন কমিশন। ফাইনম্যানকেও রাখা হয়েছে কমিশনের এক জন সদস্য হিসেবে। ফাইনম্যান কাজে নেমে দেখলেন বেশ কিছু গলদ রয়েছে গোড়াতেই যা ঢাকতে নাসা বেশ উদগ্রীব। ফাইনম্যান শাক দিয়ে মাছ ঢাকার এই প্রচেষ্টা বানচাল করে দেবেন মনে মনে ঠিক করে নিলেন। এরপর তিনি একটি সাংবাদিক সম্মেলন ডাকলেন। সেখানে গোটা আমেরিকা জুড়ে প্রচারিত টিভি প্রোগ্রামে ফাইনম্যান দেখিয়ে দিলেন, ঠিক কি কারণে দুর্ঘটনা হল। চ্যালেঞ্জার-এর রাবারের টালিতেই মূলত সমস্যা ছিল। হাতে কলমে দেখিয়ে দিলেন সমস্যা কিভাবে তৈরী হল। এক পাত্র বরফজলে টালির এক টুকরো ফেলে দেখালেন সেই যে রাবার চুপসে গেল তা আর নরম হল না। চ্যালেঞ্জার উৎক্ষেপণের দিন ভোরে কেপ ক্যানাভেরালের তাপমাত্রা ছিল শূন্য ডিগ্রির নীচে। ওই প্রচন্ড ঠান্ডায় রাবারের টালি জমাট বেঁধে ইঁটের মত শক্ত হয়ে গিয়েছিল। এত কমিশন টমিশন সব ব্যর্থ হয়ে গেল। একা একজন এত বড় দুর্ঘটনার কারণ বের করে দিলেন কি অনায়াস দক্ষতায়।
সাধারণত বেশিরভাগ প্রথিতযশা বিজ্ঞানীদেরই কোন না কোন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর শখ থাকে। বিজ্ঞানের শুষ্ক গাণিতিক কচকচি যখন জীবনের সব রস শুষে নেয় তখন সুরের ঝংকার জীবনের রস আস্বাদন করার ইচ্ছাকে আবার জাগিয়ে তোলে। আইনস্টাইন বেহালা বাজাতে ভালোবাসতেন। সত্যেন বোস এস্রাজের ঝংকারে শান্তি খুঁজতেন। ফাইনম্যানও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁর শখ ছিল ড্রাম এবং বঙ্গো বাজানোতে। লস অ্যালামসের দিনগুলোতে সারাদিন অঙ্কের জাঁতাকলে পিষতে পিষতে এক আধদিন দুত্তোর বলে জঙ্গলে ছুটে যেতেন। সেখানে একটি ড্রাম নিয়ে বসে পড়তেন আর তারপর দ্রিমি দ্রিমি দ্রাম দ্রাম সুরে আকাশ বাতাস মথিত হয়ে উঠত। কিন্তু ড্রাম বাদকের নাম যখন রিচার্ড ফাইনম্যান তখন ড্রামের মধ্যেও যে ড্রামা থাকবে সেকথা বলাই বাহুল্য। একটা ঘটনা শোনাই বরং এ প্রসঙ্গে। এক পূর্ণিমার রাতে ফাইনম্যান জঙ্গলে ঢুকে বেদম ড্রাম বাজাতে শুরু করেছেন। এই আরণ্যক পরিবেশে তাঁর নাকি নিজেকে তখন রেড ইন্ডিয়ান উপজাতিদের একজন মনে হচ্ছে। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ বাজানোর পর অবশেষে ক্ষান্ত হন। এর কয়েকদিন পর এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বলেন – “আচ্ছা দিন দুয়েক আগে আপনি কি রাতের দিকে জঙ্গলে ঢুকে ড্রাম বাজাচ্ছিলেন ?” ফাইনম্যান স্মিত হেসে বললেন – “ হ্যাঁ। আমিই বাজাচ্ছিলাম।” “ওহ! তাহলে আমার স্ত্রী ঠিকই বলেছিল” – ব্যক্তিটি খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে এরপর শুরু করলেন – “আসলে দিন দুয়েক আগে রাতের দিক করে আমি হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে থেকে ড্রাম বাজানোর আওয়াজ শুনতে পাই। ঘাবড়ে গিয়ে আমার বাড়ির দোতলায় থাকা আমার প্রতিবেশীর কাছে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি সেও জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ড্রামের আওয়াজ শুনছে। আমরা এর আগে রেড ইন্ডিয়ান প্রজাতির কাউকে কোনদিন দেখিনি। ভাবলাম নিশ্চয়ই আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের কোন উৎসব চলছে। একবার গিয়েই দেখা যাক না। এই ভেবে আমরা বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। যত এগোতে লাগলাম দেখলাম ড্রামের আওয়াজ তত জোরালো হচ্ছে। আমাদের সত্যিই বেশ নার্ভাস লাগছিল তখন। আমাদের যাতে কেউ দেখতে না পায় তাই বুকে ভর করে এগোতে লাগলাম সামনের দিকে। ঝোপঝাড় সরিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি – ওমা এতো একা একজন রেড ইন্ডিয়ান গাছের নিচে একাই নাচতে নাচতে ড্রাম বাজাচ্ছে আবার মাঝে মাঝে অদ্ভুত সুরে দুর্বোধ্য ভাষায় কি সব বলে যাচ্ছে। আমরা ঠিক করলাম ওই আদিবাসী ব্যক্তিটিকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না কারণ উনি বোধহয় কোন গুপ্ত জাদু বিদ্যা প্রয়োগ করছেন কারও ওপর। আমরা বাড়ি ফিরে আসি। বাড়ি ফিরে গোটা ঘটনার রোমহর্ষক বিবরণ দিলাম আমার স্ত্রীকে। সব শুনে স্ত্রী অত্যন্ত স্বভাবিকভাবে কি বলল জানেন?” ফাইনম্যান এক মনে শুনছিলেন। খুব আগ্রহের সঙ্গে এবং ভদ্রলোকের সাসপেন্সের সাথে তাল মিলিয়ে বললেন – “কী বললেন?” “স্ত্রী বললেন – ও বাবা ! লোকটা একা ছিল যখন তখন ওটা ফাইনম্যানই হবে। আমি তাই একবারে আপনার থেকে নিশ্চিত হতে এলাম – ওই দিন রাতে জঙ্গলে সত্যিই আপনি ছিলেন কিনা।” ফাইনম্যানের মুখটা তখন লজ্জায় যা হয়েছিল তা আর বলার নয়।
ফাইনম্যানের অগুনতি শখের একটি ছিল ধাঁধার সমাধান করা এবং তালা বা সিন্দুক ভাঙা। সিন্দুকের তালা খোলায় ফাইনম্যান এতটাই সিদ্ধহস্ত ছিলেন যে বিখ্যাত আমেরিকান ছোট গল্পকার ও হেনরি সৃষ্ট চরিত্র জিমি ভ্যালেন্টাইনের তুলনা তাঁর সাথে হতেই পারে। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। লস অ্যালামসের গবেষণাগারে বিজ্ঞানীদের একবার একটি বোর্ড মিটিং চলছে। মিটিং চলাকালীন বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টেলার (যিনি পরবর্তীকালে হাইড্রোজেন বোমার আবিষ্কারক হিসেবে খ্যাত হবেন) বলেন আমার দায়িত্বে থাকা পরমাণু বোমা তৈরী সংক্রান্ত সমস্ত নথি একটি অত্যন্ত সুরক্ষিত লকারে যত্ন সহকারে রাখা আছে। তৎক্ষণাৎ ফাইনম্যান বলে ওঠেন – প্রফেসর আপনি নিশ্চিত যে আপনার এই লকার অত্যন্ত সুরক্ষিত? টেলার বেশ দম্ভ ভরে বলেন – একশো শতাংশ নিশ্চিত। ফাইনম্যান কেবল বললেন – ও আচ্ছা। একটু বাদে রিচার্ড ফাইনম্যান মিটিংয়ের মাঝে হাত ধুতে যাচ্ছেন বলে বেরিয়ে গেলেন। বেরিয়ে সোজা গেলেন এডওয়ার্ড টেলরের অফিসে। তাঁর অফিস টেবিলের পাশেই রাখা লকারটি। লকারের সামনে গেলেন। আগাগোড়া সামনে পেছন ওপর নিচ খুব ভালোভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। এরপর জাস্ট পাঁচ মিনিট। ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ। লকারের দরজা হাটহাট করে খুলে গেল। গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলো বের করলেন এবং আবার সযত্নে লকারটি বন্ধ করে চুপচাপ মিটিং রুমে গিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়লেন। একটু বাদে আলোচনা প্রসঙ্গে এডওয়ার্ড টেলার বলে উঠলেন – এক মিনিট দাঁড়ান। আমি এক্ষুনি লকার থেকে পেপারগুলো নিয়ে এসে বিষয়টা বোঝাচ্ছি আপনাদের। বলেই চেয়ার থেকে উঠেছেন সবে অমনি ফাইনম্যানও চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে নথিগুলো প্রফেসর টেলরের দিকে বাড়িয়ে বললেন – “দেখুন তো এই পেপারগুলোই কি আনতে যাচ্ছেন আপনি? আমি আসলে হাত ধুতে গিয়ে ভাবলাম একবার আপনার ‘সেফ’ আদৌ কতটা সেফ দেখে আসি। যাওয়া আসার সময় বাঁচিয়ে দিলাম বলে একটা ধন্যবাদ অন্তত আপনার থেকে আমার প্রাপ্য।” এডওয়ার্ড টেলার কি বলবেন কিছু ভেবে না পেয়ে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। গোটা মিটিং রুমে তখন একটা পিন পড়লেও শোনা যাবে এমনই নিস্তব্ধতা।
এ প্রসঙ্গে আরও দুটো ঘটনার কথা না বললেই নয়। ওক রিজে অবস্থিত ইউরেনিয়াম প্লান্টের সুরক্ষা বিধি চেক করবার জন্য প্রায়শই ফাইনম্যানকে যেতে হত। সেখানে কোন একটি বড় কোম্পানির বড় কর্তার সাথে তাঁর আলাপ। সেই কর্তা ফাইনম্যানকে তাঁর অফিসে নিয়ে গিয়ে বসান। সেখানে তাঁরা একটি রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আলোচনা করতে করতে সেই কর্তার মনে হল রিপোর্টটি একবার ফাইনম্যানকে দেখাবেন। লকার খুলে রিপোর্টটি বের করতে গিয়ে দেখলেন লক খোলার কম্বিনেশন ভুলে গেছেন। এই কম্বিনেশনটি আবার একমাত্র জানেন তাঁর সেক্রেটারি। সেক্রেটারিকে ফোন করলে জানতে পারেন তিনি পিকনিক করতে গিয়েছেন। কর্তার তো মাথায় হাত। ফাইনম্যান আসরে নামলেন এবার। কর্তার থেকে অনুমতি চেয়ে নিলেন লকার খোলার চেষ্টা তিনি একবার করে দেখবেন কিনা। অনুমতি মিলতেই কাজ শুরু। তারপর দশ মিনিট। লকারের দরজা চিচিং ফাঁক।
এই ওক রিজেই প্রায় একইরকম আরও একটি ঘটনা ঘটে। একবার এক কর্নেলকে ফাইনম্যান একটি রিপোর্ট পাঠান অনুমোদন করার জন্য। ফাইনম্যান যখন কর্নেলের অফিসে যান তখন কর্নেল তাঁর রিপোর্টটিই পড়ছিলেন। ফাইনম্যান দেখলেন পেছনে তাঁর লকারটি হাঁ করে খোলা। বাঘ রক্তের স্বাদ পেলে যা হয়! ফাইনম্যান কর্নেলকে বললেন – “একবার আপনার লকারটি দেখতে পারি?” রিপোর্ট থেকে চোখ না সরিয়েই কর্নেল অনুমতি দিলেন। ফাইনম্যান লকারের সামনে গেলেন একটু চোখ বুলিয়ে ফের নিজের জায়গায় চলে এলেন। কর্নেল রিপোর্টটি অনুমোদন করে ফাইনম্যানের হাতে দিয়ে লকারটি বন্ধ করে লকারের দরজার ওপর আদর করে হাত বুলিয়ে দিলেন। ফাইনম্যান দূরে দাঁড়িয়ে সবটাই লক্ষ করছিলেন। “আপনি যেভাবে হাত বুলোলেন দরজাটার ওপর আমার ধারণা আপনি মনে করেন লকারটি খুব সুরক্ষিত!” এরকম একটি তির্যক মন্তব্যের জন্য কর্নেল প্রস্তুত ছিলেননা সম্ভবত। ফাইনম্যানের দিকে তাকিয়ে বললেন – “অবশ্যই সুরক্ষিত।” আবার একটি বোমা উড়ে এল ফাইনম্যানের থেকে – “আপনার এই ধারণা যে আপনার সেফ এক্কেবারে সেফ কারণ সিভিলিয়ানরা এটাই বিশ্বাস করে।” এবার কর্নেল বেজায় খাপ্পা। “কেন আপনি কি মনে করেন এটা সেফ নয়?” ঝাঁঝালো উত্তর এল কর্নেলের থেকে। “একজন ভালো সেফ ক্র্যাকার এই লকার ভাঙতে ম্যাক্সিমাম আধঘণ্টা নেবে” – ফাইনম্যানের থেকে উত্তর এল। কর্নেলের মাথা আরও গরম – “তুমি বলছো মাত্র আধঘন্টায় তুমি এটা খুলে দিতে পারবে?” “আমি বলেছি ভালো সেফ ক্র্যাকারের আধঘণ্টা লাগবে এটা খুলতে। আমার কথা বলিনি। আমার কথা যদি বলেন আমার চল্লিশ পয়ঁতাল্লিশ মিনিট মত লাগবে।” ফাইনম্যানের নিরুত্তাপ উত্তর।
কর্নেলের মাথায় ততক্ষণে খুন চেপে গেছে। ফাইনম্যানকে শাসিয়ে বললেন – “শুনুন প্রফেসর, আমার স্ত্রী বাড়িতে আমার জন্য ডিনার রেডি করে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু আমি এখন বাড়ি যাব না। আমি এই বসলাম, দেখি আপনি কেমনভাবে এই লকরাটি খোলেন।” সামনে থেকে একটি চেয়ার টেনে ফাইনম্যান লকারের সামনে গিয়ে বসে কাজ শুরু করলেন। পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই অধৈর্য কর্নেলের মন্তব্য ভেসে এল – “কি বুঝছেন ? লকারটি কি খুলতে পারবেন না পারবেন না?” ফাইনম্যান লকার থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন – “আর দু এক মিনিট সময় দিন স্যার।” ঠিক দু মিনিটের মাথায় খট করে একটা আওয়াজ হল – লকারের দরজা খুলে গেল।
কর্নেলের মুখ এতটাই হাঁ হয়ে গেছে যে অনায়াসে একটা পিংপং বল তার ভেতর ঢুকে যেতে পারে। ফাইনম্যান তখন অত্যন্ত ফাইন একজন ম্যানের মত লকারের দরজাটা আবার বন্ধ করে দিয়ে কর্নেলের কাছে গিয়ে বললেন – “আর কখনো চেনা অচেনা কাউকেই লকার খোলা অবস্থায় লকারের কাছে যেতে দেবেন না। আর হ্যাঁ ম্যাডাম আপনার জন্য ডিনার নিয়ে বসে আছেন বলে একটু তাড়াতাড়ি খুলতে হল। আপনি খামোকাই খেতে দেরি হয়ে যাবে বলে টেনশন নিচ্ছিলেন!”
কি বলবেন ? সিনেমার মত লাগছে ? নাকি সিনেমাকেও হার মানাচ্ছে? ম্যাজিশিয়ান নাকি বিজ্ঞানী নাকি গোয়েন্দা কিভাবে সম্বোধন করব লোকটাকে ? প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ মার্ক কাক এর ফাইনম্যান সম্পর্কে মূল্যায়নটাই তুলে ধরি বরং – “জিনিয়াস আসলে দু’রকম। সাধারণ আর জাদুকর। সাধারণ জিনিয়াস যাঁরা হন তাঁরা তেমন আহামরি কিছু নন, আমরা যদি অনেক অনেকগুণ ভাল হই, তা হলে যেমন দাঁড়াবে, অনেকটা সেরকম। এ রকম জিনিয়াসের কাজকর্ম মোটেও রহস্যময় নয়। আমরা যদি এক বার জানতে পারি, ওঁরা কী করেছেন, তা হলে আমাদের মনে হবে আমরাই হয়তো সেটা করতে পারতাম। অন্যদিকে জাদুকর জিনিয়াসদের ব্যাপারটাই আলাদা।… ওঁদের চিন্তাপদ্ধতির কুলকিনারা পাওয়া মুশকিল। যদিও বা আমরা বুঝি যে, ওঁরা কী করেছেন, তা হলেও ওঁরা কী ভাবে সেটা করেছেন, তা চিরকাল অজানাই থাকবে।… রিচার্ড ফাইনম্যান হলেন উঁচু দরের জাদুকর।’’
তথ্যসূত্র
- Surely you're Joking Mr Feynman: Adventures of a Curious Character : Richard P Feynman
- বিশ্বাসঘাতক : নারায়ণ সান্যাল, দে'জ পাবলিশিং
- https://en.wikipedia.org/
- https://fs.blog/
- https://www.anandabazar.com/
One comment