যে সমস্ত চিত্রশিল্পী আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের দেশীয় চিত্রকলাকে তুলে ধরেছেন, তাঁদের মধ্যে যামিনী রায় (Jamini Roy) অন্যতম। স্বদেশের প্রত্যন্ত, অবহেলিত লোকসংস্কৃতিকে তুলির আঁচড়ে, দেশীয় রঙের মাধুর্যে আন্তর্জাতিক সম্মান দিয়েছেন পটুয়া যামিনী রায়। কালীঘাটের অবহেলিত পটশিল্পকে তিনি সমগ্র বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন। তাঁর ছবিতে ফুটে উঠত ভারতীয় সংস্কৃতির শিকড়ে প্রোথিত ভাবনা। ইউরোপীয় পদ্ধতিতে ছবি আঁকা কিংবা ইউরোপীয় ক্যানভাস, রঙ ইত্যাদি ব্যবহারের বদলে যামিনী রায় একেবারে লোকশিল্পের আদলে আজীবন ছবি এঁকেছেন। রামায়ণ, রাধা-কৃষ্ণ, কৃষ্ণ-বলরাম, বধূ ও তার দুই সখী ইত্যাদি তাঁর আঁকা অন্যতম বিখ্যাত সব ছবি।
১৮৮৭ সালের ১১ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড় গ্রামের এক মধ্যবিত্ত জমিদার পরিবারে যামিনী রায়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবা রামতারণ রায় ছিলেন যথেষ্ট শৌখিন ও শিল্পী মনের মানুষ। শিল্পচর্চা করবেন বলে তিনি সরকারি চাকরিতেও ইস্তফা দিয়েছিলেন। ছোটবেলায় ঘরের মেঝেতে, দেয়ালে প্রায়ই হাতি,পুতুল কখনও বা বাঘ এঁকে রাখতেন যামিনী। দুর্গাপূজার সময় ঠাকুর তৈরি দেখার জন্য তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল।
১৬ বছর বয়সে তিনি শিল্পচর্চা ও শিক্ষার জন্য কলকাতায় এসে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি হন। সেই সময় ওই প্রতিষ্ঠানের সহকারী অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যামিনী রায় ক্রমেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় শিষ্য হয়ে উঠেছিলেন। এই কলেজ থেকে ১৯০৮ সালে ফাইন আর্টসে ডিপ্লোমা সম্পূর্ণ করেন যামিনী রায়।
বিদেশি শাসনাধীন ভারতে স্বাভাবিকভাবেই আর্ট স্কুলে ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক রীতিতেই চিত্রকলায় শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি। আর্ট স্কুলের বিখ্যাত শিল্পীদের সান্নিধ্যে এসে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিল্পরীতির সঙ্গে পরিচিত হন তিনি। পাশ্চাত্য রীতির চিত্রকলা তাঁকে আকৃষ্ট করে। পাশ্চাত্যের বিখ্যাত শিল্পী পল সেজান, ভ্যান গগ, পাবলো পিকাসো, পল গগ্যাঁর প্রভাব দেখা যায় তার চিত্রকলায়। কিন্তু এতে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। পরবর্তীকালে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তার লক্ষ্যে তিনি লোকশিল্পকে বেছে নেন। নিজস্ব বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাবধারার জন্য তিনি গর্বিত ছিলেন। তিনি বহুবার বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ পেলেও কখনও বিদেশে যাননি। একজন পোর্ট্রেট শিল্পী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন তিনি। ১৯১৮-১৯ সাল থেকে তাঁর ছবি ‘ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯২১ থেকে ১৯২৪ সালের মধ্যে যামিনী রায় সাঁওতাল আদিবাসীদের নিয়ে গবেষণা চালান এবং তাদের প্রতিদিনের জীবনচর্চাকে তিনি ফুটিয়ে তোলেন তাঁর শিল্পে। তাঁর সব ছবিই যেন দেশীয় উপাদান আর রঙে জীবন্ত হয়ে উঠত। ১৯২৫ সালে কালীঘাটের পটুয়াদের দেখে আত্মার টান অনুভব করেন যামিনী রায়। তিনি ক্রমেই বুঝতে পারছিলেন যে বাংলার লোকশিল্প একাধারে সহজ-সরল ভঙ্গিতে একটি নিটোল কাহিনী বলতে পারে, সেই শিল্পকর্মে যেমন ফুটে ওঠে লোকজীবনের ছবি আবার তেমনিই সকল স্তরের মানুষের কাছেই তা গ্রহণযোগ্য হয়। এই লক্ষ্যে নিজের শিল্পকর্মকে উন্নীত করে তোলার আশায় গভীরভাবে কালীঘাটের এই পটুয়াদের অঙ্কনরীতি দ্বারা প্রভাবিত হন যামিনী রায়। ১৯৩০ সাল থেকে কালীঘাটের পটশিল্পের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি পটশিল্পকে তাঁর শিল্পচর্চার জন্য বেছে নেন। যামিনী রায় বলতেন “আমি পটুয়া”, তাই তাঁর ছবিও পটুয়া শৈলীর। ছবির চরিত্র শান্ত ও কোমল। কোথাও পুরাণ, কোথাও বা লোকজীবন যামিনী রায়ের ছবিতে উঠে এসেছে ভারতের নিজস্ব চিন্তন ও দর্শনে সমৃদ্ধ হয়ে। তবে পল গগ্যাঁ কিংবা ভ্যান গগের ছবির প্রভাব রয়ে গিয়েছিল তাঁর অন্তরে। আটপৌরে, জনমুখী, প্রসাধনহীন, সরলরেখা ও রং থাকে তাঁর ছবিতে। তিনি তাঁর এই শৈলীর নাম দিয়েছিলেন ‘ফ্ল্যাট টেকনিক’। ১৯৩৮ সালে প্রথম তাঁর ছবিই কলকাতার রাস্তায় প্রদর্শিত হতে শুরু করে যা ব্রিটিশ শাসিত ভারতে অন্য কোনও ভারতীয় শিল্পীর ক্ষেত্রে ঘটেনি। ব্রিটিশ কলকাতার রাস্তায় এই প্রথম প্রদর্শিত হল ভারতীয় শিল্পীর আঁকা ছবি। মধ্যবিত্তদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই ছিল তাঁর ছবির মূল্য। বাংলার লোকজন, পুতুল, শিশু, গ্রাম বাংলার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখের চিত্র ইত্যাদি তাঁর ছবির বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৪০-এর দশকে যখন সাধারণ ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালিরা তাঁর ছবি কিনতে শুরু করেন, সেই সময় যামিনী রায়ের চিন্তা-চেতনায় খানিক বদল আসে। এমনকি ইউরোপীয় শিল্পবোদ্ধারাও তাঁর ছবি কিনতে শুরু করেন। এই সময়ের মধ্যেই ১৯৪৬ সালে ও ১৯৫৩ সালে প্রথমে লণ্ডনে ও পরে নিউ ইয়র্ক সিটিতে যামিনী রায়ের ছবির দুটি প্রদর্শনীও অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্যারিস, আমেরিকা এবং ব্রিটেনেও যামিনী রায়ের ছবি পৌঁছে গিয়েছিল। এই সময় ভারতে আগত মার্কিন সৈনিক ও অফিসারেরা যামিনী রায়ের ছবিগুলি অনেক বেশি মূল্যে কেনার ফলে তাঁর ছবির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। কালীঘাটের পটচিত্রের আদলে যামিনী রায় তৈরি করেন রামায়ণ কথা, সাঁওতাল জীবনযাপন, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদি অনেকগুলি ছবি। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সাঁওতাল জননী’, ‘মা ও শিশু’, ‘গণেশ জননী’, ‘নৃত্যরত সাঁওতাল’, ‘যীশু’, ‘রাধাকৃষ্ণ’ ইত্যাদি। ভিক্টোরিয়া ও আলবার্ট মিউজিয়ামসহ বেশ কিছু বিখ্যাত জায়গায় আজও সংরক্ষিত আছে তাঁর চিত্রকর্মগুলি।
একেবারে দেশীয় পদ্ধতিতে পটুয়াদের মতো ভুসোকালি, খড়িমাটি, বিভিন্ন লতা পাতার রস থেকে আহরিত রং ব্যবহার করতেন তিনি। ক্যানভাসের বদলে যামিনী রায় ব্যবহার করতেন কাপড় দিয়ে তৈরি পর্দা। তাঁর ছবিতে বেশিরভাগ সময়েই ধরা পড়ে রঙের ঔজ্জ্বল্য যা এক প্রকার উৎসবের আমেজ নিয়ে আসত। তাঁর বেশিরভাগ ছবিতেই লম্বা ও সরু চোখের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যাবে। প্রথম জীবনে ইম্প্রেশনিস্ট ধারার ছবি আঁকলেও পরবর্তীকালে লোকশিল্পের আদলে লাঙল হাতে চাষী, ঘরের বধূ, কীর্তন গায়ক, বংশীবাদক ক্লান্ত পথিক, নৃত্যরত তরুণী, বাঘ, বিড়াল, সাঁওতাল জনজীবনই তাঁর ছবির মূল প্রেক্ষাপট হয়ে উঠেছে।
যামিনী রায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য এবং শিল্প কর্ম দ্বারাও প্রভাবিত ছিলেন। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথের ছবি’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ও যামিনী রায়ের মধ্যে চিত্রকলা বিষয়ে বহু পত্র বিনিময়ও হয়েছে। তাছাড়া রবীন্দ্র-পরবর্তী কবি বিষ্ণু দে‘র সঙ্গেও যামিনী রায়ের গভীর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। বিষ্ণু দে ছিলেন যামিনী রায়ের ছবির প্রধান দর্শক। বিষ্ণু দে’র বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’-এর প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন যামিনী রায়। অন্যদিকে ১৯৫৯ সালে বিষ্ণু দে তাঁর ‘তাই তো তোমাকে চাই’ কবিতায় যামিনী রায়কে উৎসর্গ করে কয়েকটি পংক্তি লিখেছিলেন।
যামিনী রায়কে নিয়ে যত গ্রন্থ, পত্রপত্রিকা, আলোচনা সভা ও প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছে ভারতীয় কোনও চিত্রকরকে নিয়ে তা হয়নি। আজও ভারতীয় শিল্পমহলে যামিনী রায় খুবই প্রাসঙ্গিক। যামিনী রায়ের মৃত্যুর কয়েক বছর পর তাঁর স্কেচ ড্রইং-এর একটি প্রদর্শনী তাঁর নিজস্ব গ্যালারিতে আয়োজন করেছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রদর্শনীতে দেখা যায় সবই ছোট স্কেচ, খসড়া, ড্রয়িং।অতি সাধারণ অপ্রয়োজনীয় বাতিল কাগজ, কোনও পুরনো খাম, বিভিন্ন আমন্ত্রণ পত্র, কার্ড, এমনকি সংবাদপত্রের ফাঁকা অংশে তিনি কাজ করেছেন। যখন যেমন মনে করেছেন দ্রুত স্কেচ করেছেন। এগুলোর কোনওটাতেই প্রায় তারিখ বা সই নেই। সবই লৌকিক পটপ্রধান স্টাইল। নারী-পুরুষের ড্রইং, পশুপাখিরও আছে। রেখা সাবলীল কিন্তু দৃঢ়। এগুলো সাধারণত পৌত্তলিকতা প্রধান স্কেচ।
১৯৩৪ সালে প্রথম ভাইসরয় স্বর্ণপদকে ভূষিত হন যামিনী রায়। ১৯৫৪ সালে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে সম্মানিত হন এই শিল্পী। ১৯৫৫ সালে ললিতকলা অ্যাকাডেমির সদস্যপদ দেওয়া হয় তাঁকে। যামিনী রায়ই সর্বপ্রথম এই সম্মান লাভ করেন। এটি চারুশিল্পের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান। ১৯৫৬ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডি-লিট’ উপাধি পান তিনি। ২০১৩ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তর ‘যামিনী রায় পুরস্কার’ চালু করে। এই পুরস্কার হিসেবে ৫০ হাজার টাকা তুলে দেওয়া হয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের হাতে। বিদ্যালয়গুলির পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, শিশুবান্ধব পরিবেশ, পঠন-পাঠনের মানসহ একাধিক বিষয় বিচার করে স্কুলগুলি নির্বাচন করে ইউনিসেফ (UNICEF)। মূলত সরকারি স্কুলগুলিতে পঠন-পাঠনের মান উন্নয়নের জন্য এই পুরস্কার চালু করা হয়েছে। ১৯৮৬ সালে তাঁর জন্মস্থান বেলিয়াতোড় গ্রামে তাঁর নামে স্থাপিত হয়েছে যামিনী রায় কলেজ।
১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল ৮৫ বছর বয়সে কলকাতায় যামিনী রায়ের মৃত্যু হয়।
এই ধরণের তথ্য লিখে আয় করতে চাইলে…
আপনার নিজের একটি তথ্যমূলক লেখা আপনার নাম ও যোগাযোগ নম্বরসহ আমাদের ইমেল করুন contact@sobbanglay.com এ
তথ্যসূত্র
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.culturalindia.net/
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.britannica.com/
