বুদ্ধদেব বসু

বুদ্ধদেব বসু

বুদ্ধদেব বসু (Buddhadeb Bose) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রপরবর্তী যুগের একজন কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার এবং অনুবাদক। এছাড়াও অনবদ্য একজন সাহিত্য সমালোচক হিসেবে বাংলাসাহিত্যে তাঁর গুরুত্ব চিরকালীন। পত্রিকা সম্পাদক ও গ্রন্থ প্রকাশকরূপে সাহিত্য এবং নতুন লেখকদের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা তাঁকে অনন্য করে তোলে। পড়ানোর প্রতি আগ্রহ থাকলেও তার জন্য কোনকিছুর সঙ্গে আপোস করেননি অধ্যাপক বুদ্ধদেব। বামপন্থী ভাবধারার তরুণ কবি সমর সেন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়দের সাথে সস্ত্রীক বুদ্ধদেব সক্রিয়ভাবে ফ্যাসীবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পীদের গোষ্ঠীভুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু যখন শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হতে দেখলেন তখন থেকেই তাঁর বিভিন্ন লেখায় ব্যক্তিস্বাধীনতা, শিল্পী স্বাধীনতার কথা বারবার ফিরে আসতে থাকল এবং পরবর্তীকালে দল ছেড়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করলেননা।

১৯০৮ সালের ৩০ নভেম্বর তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লায়(অধুনা বাংলাদেশে) বুদ্ধদেব বসুর জন্ম হয়। যদিও তাঁর পরিবারের আদিবাড়ি ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। তাঁর বাবা ছিলেন ভূদেবচন্দ্র বসু এবং মা বিনয়কুমারীদেবী। বুদ্ধদেবের জন্মের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর মা ধনুষ্টঙ্কারে মারা যান। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে ভূদেবচন্দ্র ‘পরিব্রজ্যা’ গ্রহণ করেন এবং কিছু বছর পর তিনি পুনরায় বিবাহ করে নতুন সংসার জীবনে প্রবেশ করেন। অপরদিকে বুদ্ধদেব নোয়াখালিতে দিদিমা স্বর্ণলতাদেবী ও দাদু চিন্তাহরণ সিনহার কাছে বড় হয়ে ওঠেন। বুদ্ধদেব ১৯৩৪ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার পরে তাঁর স্ত্রী রাণু সোমের পরিবর্তে প্রতিভা বসু নামে পরিচিতি লাভ করেন। প্রতিভা বসু প্রথম জীবনে সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। পরে তিনিও বাংলা সাহিত্যের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁদের তিন সন্তান- মীনাক্ষী দত্ত, দময়ন্তী বসু সিং এবং শুদ্ধশীল বসু।

প্রথমে দাদুর কাছে ব্যকরণবর্জিত ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃত শিক্ষা দিয়ে শুরু হয় বুদ্ধদেব বসুর শিক্ষা জীবন। এরপর কুমিল্লা ও নোয়াখালীর বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন ও ১৯২৫ সালে সেখান থেকে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে কুড়ি টাকা বৃত্তিসহ আই. এ. পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণীতে বি.এ. এবং রেকর্ড নম্বর সহ প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৩১ সালে কলকাতায় এসে গৃহশিক্ষকতার মাধ্যমে বুদ্ধদেব বসুর কর্মজীবন শুরু। সাহিত্য প্রীতির সূচনা হয়েছিল বাল্যকাল থেকেই। পড়াশোনার পাশাপাশিই ‘সন্দেশ’, ‘মৌচাক’ পাঠ, লেখালেখি, হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ (‘পতাকা’ ১৯২৩ এবং ‘ক্ষণিকা’ ১৯২৬), সমানতালে সবই চলত।

দাদুর মৃত্যুর পর দিদিমার সঙ্গে পুরনো পল্টনে একটি ছোট্ট বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতেন বুদ্ধদেব। এইসময় অজিতকুমার, পরিমল রায়, সুধীশ ঘটক, মনীশ ঘটক, অনিল ভট্টাচার্য, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রমুখদের সঙ্গে আড্ডা-আলোচনার ফাঁকে জন্ম নেয় ‘প্রগতি’ সাহিত্য পত্রিকা(জুলাই,১৯২৭)। হাতে লেখা পত্রিকাটি অজিতকুমার দত্তের সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হত। এরপর আইএ পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়ে কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করার পর আরো সাহিত্যানুরাগীদের সাহায্যে মুদ্রিত পত্রিকার সূচনা করলেন। রবীন্দ্র ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রগতির হাত ধরে বাংলায় আধুনিক কবিতা ও জীবনানন্দ দাশের মতো কবির আত্মপ্রকাশ ঘটে। বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ এবং বিদেশি সাহিত্য নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা প্রকাশিত হতে ‘প্রগতি’তে। ১৯২৭-১৯২৯সাল পর্যন্ত এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। ১৯৩৫ সাল থেকে পঁচিশ বছরেরও বেশী সময় ধরে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘কবিতা’র তৃতীয় বর্ষ ১ম সংখ্যা থেকে ষষ্ঠ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা পর্যন্ত বুদ্ধদেব ও সমর সেন যৌথভাবে এবং তারপর তিনি একা সম্পাদনা করেন। ১৯২৫ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মর্মবাণী’র নামকরণ ও আরও তিরিশটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব স্পষ্ট দেখা যায়। তবে ১৯৩০ সালে ‘বন্দীর বন্দনা’ থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলিতে (যেমন, ‘দময়ন্তী’, ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ ‘শীতের প্রার্থনা’, ‘বসন্তের উত্তর’ ইত্যাদি) ধীরে ধীরে তাঁর স্বকীয়তা ফুটে উঠতে থাকে। ঢাকা থেকে বুদ্ধদেব বসু ‘কল্লোল’-পত্রিকা তথা গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হন। তখন থেকেই অচিন্ত্য-প্রেমেন-বুদ্ধদেব এই নাম তিনটি একসঙ্গে উচ্চারিত হত।

অতি আধুনিক উপন্যাসের সঙ্গে গীতিকাব্যধর্মী উপন্যাস রচনা করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ‘অকর্মণ্য’, ‘রডোড্রেনড্রন গুচ্ছ’, ‘যেদিন ফুটল কমল’ প্রভৃতি উপন্যাসে বুদ্ধদেব বসু কাব্যপ্রবণতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর ‘তিথিডোর’, ‘নির্জন স্বাক্ষর’, ‘শেষ পাণ্ডুলিপি’ ইত্যাদি উপন্যাস নতুন জীবনসমীক্ষা রীতির পরিচয়বাহী। তাঁর চল্লিশোর্ধ বয়সের রচনাগুলির মধ্যে – গ্রিক, ল্যাটিন, সংস্কৃত সাহিত্যের উপমার ছোঁয়া পাওয়া যায়।

জীবনের শেষের দিকে তিনি নাট্যকাব্য রচনায় মনোনিবেশ করে ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’, ‘কলকাতার ইলেকট্রা ও সত্যসন্ধ’, কালসন্ধ্যা, ‘পুনর্মিলন’, ‘অনামী অঙ্গনা’ ও ‘প্রথম পার্থ’ প্রভৃতি নাট্যকাব্যের মাধ্যমে বাংলাসাহিত্যে একটি নতুন শিল্পরূপ সৃষ্টি করলেন। বাংলা সাহিত্যের সকল শাখায় পা রেখে গেছেন বুদ্ধদেব। প্রবন্ধ,অনুবাদ ছাড়াও ‘সব-পেয়েছির দেশে ‘(১৯৪১), ‘জাপানি জার্নাল’ (১৯৬২),’দেশান্তর’এর মত ভ্রমণকাহিনী,’আমার ছেলেবেলা’ (১৯৭৩), ‘আমার যৌবন'(১৯৭৬) নামক স্মৃতিকথা তাঁর রচনার অজস্রতা এবং অভিনব লিখনভঙ্গীর সাক্ষ্যবহন করে।

বুদ্ধদেব বসুর সৃষ্টিশীল কোন রচনা ছাড়াও কালিদাস থেকে ‘আধুনিক’ বাংলা কাব্যধারার চল্লিশের দশক পর্যন্ত বিবেচনার জন্য অপরিহার্য নাম বুদ্ধদেব বসু। ‘আধুনিক’ কাব্যপাঠের ক্ষেত্রে, বিশেষত তিরিশোত্তর ‘আধুনিক’ বাংলা কাব্যপাঠের ক্ষেত্রে, বুদ্ধদেব বসুর বিকল্প কেবল তিনি নিজেই।

বুদ্ধদেব বসু কেবল প্রতিষ্ঠিত লেখকই ছিলেন না, মেধাবী ছাত্রও ছিলেন। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কলকাতা রিপন কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করে ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ সাংবাদিক হিসেবে স্টেটসম্যান পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫২তে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হুমায়ুন কবিরের সহযোগিতায় ছ’মাসের জন্য বুদ্ধদেব ‘ইউনেস্কো’র বয়স্ক শিক্ষণ-প্রকল্পে উপদেষ্টা হিসেবে মহিশূরে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গের পেনসিলভেনিয়া কলেজ ফর উইমেনে একবছর শিক্ষকতা করেন তিনি। এরপর হুমায়ুনের মধ্যস্থতায় ত্রিগুণা সেনের আহ্বানে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের দায়িত্ব নেবার অনুরোধ এলে তাতে সম্মতি না দিয়ে ১৯৫৬ সালের ১ আগস্ট বুদ্ধদেব তুলানামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা-প্রধান অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন এবং ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত সেখানে তিনি অধ্যাপনা করেন।

সমসাময়িক ও তরুণতর কবিদের প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর লড়াইয়ের সবথেকে বড় সাক্ষী তাঁর উদ্যোগে প্রকাশিত ‘কবিতা’ ও জীবনানন্দ দাশকে প্রকাশ্যে, একক কণ্ঠে, সোচ্চার ঘোষণায় সংবর্ধনা জানিয়ে ইতিহাস সৃষ্টিকারী ‘প্রগতি’ পত্রিকা। তাঁর কলকাতার বাসভবন ‘কবিতা ভবন’ কে প্রকাশনা সংস্থা করে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পদাতিক’, জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’, সমর সেনের ‘কয়েকটি কবিতা’র মতো সৃষ্টির জন্ম।

অশোক মিত্র যথার্থই বলেছিলেন, “এখন আমরা টিকিট কেটে কবিতা শুনতে যাই। আর ৬০-৭০ বছর আগে একটা সময় ছিল, যখন কবিরা বেকার ও মানসিক ভারসাম্যহীন রূপে বিবেচিত হতেন। বুদ্ধদেব বসু যদি পত্রিকা সম্পাদনা না করতেন এই পরিবর্তন সম্ভব হতনা। বাংলা সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসু হয়তো থাকতেন, কিন্তু কোন জীবনানন্দ দাশ থাকতেন না।” তাই ‘কবিতাভবন’ নিঃসন্দেহেই ছিল আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তীর্থস্থান।

১৯৬৭ সালে ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’ নাটকের জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমী পুরস্কার পান বুদ্ধদেব বসু। ১৯৭০ সালে ভারত সরকারের তরফ থেকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।’স্বাগত বিদায়’ কবিতার জন্য ১৯৭৪ সালে তিনি রবীন্দ্রপুরস্কার লাভ করেন।

সন্দেহ, সংস্কারের উর্ধ্বে উঠে সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন বুদ্ধদেব। ফুলশয্যার রাতে বউয়ের শাঁখা ভেঙে দিতে চেয়ে, রবিবারের দুপুরে গরুর মাংসের ঝোল-ভাত খেয়ে বা কবিতা বা গল্পের মধ্যে নারী-পুরুষের প্রেম এবং নারী দেহের বর্ণনা আনতে দ্বিধা না করে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি, “আধুনিক সাহিত্য আমার চোখে পড়ে না। দৈবাৎ কখনো যেটুকু দেখি, দেখতে পাই, হঠাৎ কলমের আব্রু ঘুচে গেছে। আমি সেটাকে সুশ্রী বলি এমন ভুল করো না।” এই চিঠির সঙ্গে সহমত না হয়ে বেশ কড়া চিঠি লিখে ১৯২৬ সালে দ্বিগ্বিজয়ী রবীন্দ্রনাথের কথার উপরে কথা বললেন আঠেরো বছরের বুদ্ধদেব! আবার নির্দ্বিধায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেন, “আমাদের মাতৃভাষাই তাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েছি।… চিরকালের বাঙালি লেখক এই অর্থে রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারী।”

১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চ সন্ধ্যায় কলকাতার বাসভবনে শৌচাগারে সেরিব্রাল অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে রাত ৩টেয় বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যু হয়।

তথ্যসূত্র


  1. মডার্ণ বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড প্রকাশিত উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত-ড: অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায় ও ড: অমিয় বক্সী পঞ্চদশ সংস্করণ ২০১১-২০১২ পৃষ্ঠা-১৫৭-১৫৯ এবং ২২৯-২৩০
  2. https://en.wikipedia.org/
  3. https://www.anandabazar.com/
  4. https://www.anandabazar.com/
  5. https://www.kaliokalam.com/

2 comments

আপনার মতামত জানান