বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ইতিহাস যে সমস্ত মহান মানুষের অবদানকে বাদ দিয়ে লেখা প্রায় সম্ভব নয়, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী (A. Q. M. Badruddoza Chowdhury)। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিদের তালিকায় তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে। তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে পদার্পণ করার আগে তিনি মূলত ছিলেন চিকিৎসক এবং চিকিৎসাবিদ্যার একজন অধ্যাপক। বাংলাদেশের জাতীয় যক্ষ্মা প্রতিরোধ সমিতির সভাপতি হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব হিসেবে তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে। এরপর কখনও স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়, কখনও বা শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি দক্ষ হাতে। প্রায় পাঁচবার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন বদরুদ্দোজা চৌধুরী। পরবর্তীকালে সন্ত্রাসমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে গঠন করেছিলেন ‘বিকল্পধারা’ নামে একটি রাজনৈতিক দল। তাঁর আমলে স্বাস্থ্য ও কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে বাংলাদেশে মহিলাদের জন্য প্রথম মেডিকেল কলেজ গঠিত হয়। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি যেমন চিকিৎসাকর্ম চালিয়ে গিয়েছেন, তেমনি প্রবন্ধ, নাটক রচনাতেও পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বও করেছিলেন এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী।
১৯৩২ সালের ১ নভেম্বর ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতের কুমিল্লা জেলার (বর্তমানে বাংলাদেশ) মুন্সিফ বাড়ি অঞ্চলে মাতামহের বাড়িতে এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর জন্ম হয়। তাঁর পূর্বপুরুষরা মুন্সিগঞ্জ, মজিদপুর, দাইহাটা, শ্রীনগরের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মানুষ ছিলেন। বদরুদ্দোজার বাবা কফিলউদ্দিন চৌধুরী (Kafiluddin Chowdhury) ছিলেন ঐতিহাসিক আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় রাজনৈতিক নেতা এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক মন্ত্রীসভার একজন মন্ত্রী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়াও ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনের নেপথ্যেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল কফিলউদ্দিনের। বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মায়ের নাম ছিল সুফিয়া খাতুন (Sufia Khatun)। বদরুদ্দোজা ছিলেন তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান। বদরুদ্দোজার স্ত্রীয়ের নাম হাসিনা ওয়ারদা চৌধুরী (Hasina Warda Chowdhury)। পরবর্তীকালে তাঁদের একটি পুত্র সন্তান জন্মায় যার নাম মাহী বি. চৌধুরী।
ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে পড়াশোনা শুরু হয় বদরুদ্দোজার৷ ১৯৪৭ সালে সেই স্কুল থেকেই তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৪৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে সাফল্য অর্জন করেন তিনি। বিদ্যালয়স্তর অতিক্রমের পর ডাক্তারি পড়বার জন্য আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর। ১৯৫৪-৫৫ সালে এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন এবং যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েলসেও পড়াশোনা করতে যান। এছাড়াও লন্ডন ব্রম্পটন চেস্ট ইন্সটিটিউট, লন্ডনের হ্যামারস্মিথের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল স্কুল, এডিনবার্গ থেকে চিকিৎসাবিদ্যার স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। এমবিবিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেন তিনি। এডিনবার্গ ও গ্লাসগোর রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিশিয়ান থেকে এমআরসিপি এবং ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টিডিডি অর্জন করেছিলেন বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ১৯৭৮ সালে সম্মানীয় সদস্য হিসেবে এফসিপিএস নির্বাচিত হন তিনি। এছাড়াও গ্লাসগো এবং এডিনবার্গের রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিশিয়ানের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
চিকিৎসক হিসেবেই বদরুদ্দোজার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে, ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে এবং ১৯৭০ সালে সিলেট মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষাদান করেন তিনি। যক্ষ্মা প্রতিরোধকারী সংস্থা ‘ন্যাশনাল অ্যান্টি-টিউবারকুলোসিস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ’-এর (NATAB) সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। এশিয়া প্যাসিফিক জোনের ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন এগেইনস্ট টিউবারকুলোসিস অফ লাং ডিজিজ’ (IUATLD)-এরও সভাপতি পদের দায়িত্ব পালন করেন তিনি দক্ষ হাতে। তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় ইন্টারনাল মেডিকেল বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একজন হিসাবে বিবেচিত হন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু জার্নালে বিভিন্ন সময়ে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর লেখা চিকিৎসা সংক্রান্ত মূল্যবান গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।
চিকিৎসা-কর্মের পাশাপাশি রাজনীতিতেও পদার্পণ করেছিলেন বদরুদ্দোজা। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (BNP) প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের অনুপ্রেরণায় উক্ত দলের মহাসচিব হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি। তারপর ১৯৭৯ সালে মুন্সিগঞ্জ থেকে বিএনপি-এর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করেন এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের ক্যাবিনেটে প্রবীণ উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিন বছর ক্যাবিনেটের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে বিএনপি পুনরায় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং খালেদা জিয়ার মন্ত্রীসভায় শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। নিজের নির্বাচনী এলাকা মুন্সিগঞ্জ-১ থেকে বিএনপির মনোনয়নে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এছাড়াও জাতীয় সংসদের উপনেতা এবং জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা হিসেবে অসাধারণ দক্ষতা সহকারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারে তাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করতে হয়েছিল।
অবশেষে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে, অনেক প্রশাসনিক পদের দায়িত্ব পালন করে বদরুদ্দোজা ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদের সদস্যদের দ্বারা রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। শপথ নেওয়ার আগে অবশ্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সমস্ত পদ ত্যাগ করে আসেন তিনি। রাষ্ট্রপতি হলেও দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের জেরে খুব বেশিদিন সেই পদে বহাল থাকতে পারেননি তিনি। রাষ্ট্রপতি হওয়ার সাত মাস পরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর কবরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বদরুদ্দোজা। তাঁর এই পদক্ষেপের ফলেই দলের নেতা-কর্মীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তাঁর বিরুদ্ধে দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার অভিযোগ আনা হয়। যত দিন গেল এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি জটিল হতে শুরু করে। অবশেষে ২০০২ সালের জুন মাসে ক্ষমতাসীন দলের অনুরোধে এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী রাষ্ট্রপতি পদ ত্যাগ করে বেরিয়ে আসেন।
রাষ্ট্রপতি পদ ছাড়ার পর বদরুদ্দোজা বাংলাদেশের দ্বি-দলীয় গণতন্ত্রে একটি শক্তিশালী তৃতীয় শক্তির প্রয়োজন অনুভব করেন। রাজনীতিতে সুশীল সমাজের সভ্যদের নিয়োগের জন্য দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য ‘বিকল্প ধারা’ নামক একটি রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার কথা ঘোষণা করেন তিনি। পুত্র মাহী বি. চৌধুরী এবং বিএনপির সংসদ সদস্য এম. এ. মান্নানের সঙ্গে নতুন এই রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করবার জন্য বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন বদরুদ্দোজা। ২০০৪ সালের মার্চ মাসে নতুন দল ‘বিকল্প ধারা’ গঠিত হয়। বদরুদ্দোজা হলেন দলের সভাপতি এবং এম.এ মান্নান হলেন দলের সেক্রেটারি-জেনারেল। ‘বিকল্প ধারা’ সরকারের কঠোর সমালোচনা করা শুরু করেছিল। এরই মধ্যে কিছু সময়ের জন্য বদরুদ্দোজা সিনিয়র রাষ্ট্রনায়ক ড: কর্নেল অলি আহমেদ বীরের সঙ্গে হাত মেলান এবং বিএনপির মন্ত্রিসভার বিভিন্ন সিনিয়র মন্ত্রীদের নিয়ে তারা ‘লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি’ বাংলাদেশ’ গঠন করেন। কিন্তু এই জোট স্থায়ী হয়নি। অল্পদিনের মধ্যেই এলডিপি ছেড়ে বেরিয়ে পুনরায় বিকল্প ধারার বিকাশে মনোনিবেশ করেন তিনি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত একটি সংক্ষিপ্ত সময় ব্যতীত পার্টির প্রতিষ্ঠার পর থেকে বদরুদ্দোজা সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। তবে নবম সংসদ নির্বাচনে দলটি কোনও আসন না পাওয়ায় অবশেষে বদরুদ্দোজা পদত্যাগ করেন। রাজনীতির পাশাপাশি চিকিৎসাকর্ম চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। স্বাস্থ্য ও কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা-চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তাঁর সময়কালেই স্বাস্থ্য ও কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে দেশে প্রথম মহিলাদের জন্য মেডিকেল কলেজ নির্মিত হয়েছিল। সেই কলেজেই মেডিসিন বিভাগে অধ্যাপনার কাজ করেন বদরুদ্দোজা।
বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানা বিষয়ে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তিনি ১৯৭৪ সালে নিউ দিল্লিতে যক্ষ্মা এবং বক্ষব্যাধি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এছাড়াও ১৯৭৬ সালে কোরিয়ায়, ১৯৭৭ সালে ইস্তাম্বুলে, ১৯৭৮ সালে ব্রাসেলসে, এবং যুক্তরাজ্যের ব্রাইটনে এই ধরনের সম্মেলনে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। ১৯৭৮ এবং ১৯৭৯ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনেও বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলেন এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের বিকল্প নেতা এবং রাষ্ট্রসংঘের ৫০তম বার্ষিকীতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী।
রাজনীতি এবং চিকিৎসাকর্ম ছাড়াও বদরুদ্দোজার মধ্যে এক শিল্পীসত্তা বর্তমান ছিল। প্রাবন্ধিক এবং নাট্যকার হিসেবেও নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট বক্তা এবং টেলিভিশন উপস্থাপক। ১৯৭৬ সালে বদরুদ্দোজা জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯৩ সালে তাঁকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়।