অ্যারিস্টোফেনিস

অ্যারিস্টোফেনিস

প্রাচীন গ্রিসের একজন বিখ্যাত কমেডি নাটক রচয়িতা ছিলেন অ্যারিস্টোফেনিস (Aristophanes)। তাঁকে ‘কমেডির জনক’ তথা ‘প্রাচীন কমেডির যুবরাজ’ বলে সম্মানিত করা হয়। তাঁর লেখা নাটক ‘দ্য ক্লাউডস’কে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ঈশ্বরের অপবাদ বলে দাবি করেছিলেন। সক্রেটিসের মৃত্যুকে নিয়ে বিদ্রুপ করা হয়েছিল এই নাটকে। অ্যারিস্টোফেনিসের দ্বিতীয় নাটক ‘দ্য ব্যাবিলনিয়ান্স’ নাটকে এথেন্সের রাজা ক্লিওনকে বিদ্রুপ করা হয়েছিল এবং তাঁর পরবর্তী নাটকগুলিতেও অনেকাংশেই ক্লিওনকে বিদ্রুপ করা হয়। ফিলিপের পুত্র অ্যারিস্টোফেনিসের লেখা কমেডি নাটকের মোট সংখ্যা ৪৬টি হলেও, তার মধ্যে ১১টিই কেবল উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। প্রাচীন এথেন্সের কমেডি অর্থাৎ ওল্ড কমেডির জনক বলা হয় তাঁকে। তাঁর জীবন সম্পর্কে খুব কম তথ্যই জানা যায়, তাঁর লেখা নাটকগুলি নিয়েই বেশি আলোচনা হয়েছে। পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধের শেষে নাটককার সোফোক্লিস ও ইউরিপিডিসের হাত ধরে যেমন ট্র্যাজেডি নাটকের বিকাশ ঘটে, ঠিক তেমনি যুদ্ধে এথেন্সের পরাজয়ের পরে অ্যারিস্টোফেনিসের হাত ধরে কমেডি নাটকের বিকাশ ঘটে।

আনুমানিক ৪৪৬ অথবা ৪৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এজিনা দ্বীপে অ্যারিস্টোফেনিসের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম ফিলিপ। মনে করা হয় এথেন্সেই তিনি শিক্ষালাভ করেছিলেন। প্লেটো তাঁর ‘সিম্পোজিয়াম’ গ্রন্থে অ্যারিস্টোফেনিসকে সক্রেটিসের বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর যৌবনে পেরিক্লিসের শাসন চলছিল সমগ্র এথেন্সে। বলা হয় তাঁর আমলেই এথেন্সের স্বর্ণযুগ ছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে এথেন্স ক্রমেই উন্নতির চূড়ায় উঠছিল। ইতিমধ্যে ৪৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু হয় পেলোপনেশীয় যুদ্ধ। ৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলে যাতে এথেন্সের শক্তি একেবারে ভেঙে যায়। সমাজ-পরিবার একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। যুদ্ধের সময় সমগ্র এথেন্সের সমাজে এক অনিশ্চয়তার বাতাবরণ তৈরি হয় এবং সফিস্ট দার্শনিকদের মতবাদে অ্যারিস্টোফেনিস বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। এই পেলোপনেশীয় যুদ্ধের সময়কালেই তিনি তাঁর সমস্ত নাটকগুলি লিখেছিলেন। বরাবর যুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন তিনি। এথেন্সের গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর দুর্বলতাকেই যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ বলে মনে করেন অ্যারিস্টোফেনিস। ফলে এই সমাজবাস্তবতার নিরিখে তিনি তাঁর কমেডিগুলিতে এথেন্সের গণতন্ত্রকে বিদ্রুপ করেছেন।

অ্যারিস্টোফেনিসের জীবনের অধিকাংশ তথ্যই সেভাবে পাওয়া যায় না। তবে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায়, তা সবই পাওয়া যায় তাঁর লেখা নাটকগুলি থেকেই। প্রাচীন এথেনিয়ান কমেডির নিয়মানুযায়ী কোরাসের মুখ দিয়ে লেখকের নিজের জীবনের অনেক কথাই বলা যেত, একে বলা হতো প্যারাবেসিস। সেকালে তিনি একজন কমেডি-কবি ছিলেন। তৎকালীন রীতি অনুযায়ী কমেডি কবিরা পেশায় শিক্ষক হতেন। কোরাসের মুখ দিয়ে এই তথ্যগুলি বলার মধ্য দিয়ে দর্শকের সঙ্গে তাঁর একটি বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অ্যারিস্টোফেনিসের নাটকগুলিতে প্রায়ই এথেন্সের সমাজে কিছু বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা প্রচার করা হত। তাঁর কমেডি নাটকগুলি এথেন্সের তৎকালীন কলাবিদ্যা, রাজনীতি এবং দর্শন ও ধর্মের নানা দিক ও ব্যক্তিকে বিদ্রুপ করত। কলাবিদ্যার ক্ষেত্রে ইউরিপিডিস, রাজনীতির ক্ষেত্রে জনপ্রিয় শাসক ক্লিওন এবং দর্শনের ক্ষেত্রে সক্রেটিস ছিলেন তাঁর বিদ্রুপের কেন্দ্রে। অনেকেই বলে থাকেন যে, অ্যারিস্টোফেনিসের নাটকগুলি দর্শক মনোরঞ্জনের জন্য এবং সম্মানীয় প্রতিযোগিতা জেতার জন্য লেখা হয়েছিল। এথেন্স, দ্য লেনানিয়া এবং ডায়োনিসিয়া সিটিতে আয়োজিত বিশাল নাট্যোৎসবের জন্যেই সম্ভবত অ্যারিস্টোফেনিস তাঁর নাটকগুলি লিখেছিলেন। তাঁর প্রথম নাটক ‘দ্য ব্যাঙ্কোয়েটার্স’ যখন মঞ্চস্থ হয়, সেই সময়ে এথেন্স ছিল একটি শক্তিশালী এবং উচ্চাভিলাষী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। তখন পেলোপনেশীয় যুদ্ধ চার বছর অতিবাহিত হয়েছে। তাঁর নাটকগুলি প্রায়ই প্রাচীন প্রজন্মের গর্বের কথা তুলে ধরতো যারা কিনা স্পার্টার সঙ্গে এথেন্সের যুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন। যুদ্ধকালীন মুনাফালোভী এবং স্বার্থান্বেষীদের তীব্র বিদ্রুপ করেছেন অ্যারিস্টোফেনিস। ৩৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ তাঁর শেষ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। এথেন্সের পরাজয়ের পরে এথেন্স নগরী সমগ্র গ্রিসের রাজনৈতিক কেন্দ্র থেকে ক্রমেই বৌদ্ধিক বিকাশের কেন্দ্রে পরিণত হয় আর এথেন্সের এই পরিবর্তনের কাণ্ডারি ছিলেন তিনি। তাঁর প্রথম দিককার নাটকগুলিকে ওল্ড কমেডির রীতিতে ধরা হলেও, পরের দিকে লেখা তাঁর নাটকগুলিকে বলা হয় নিউ কমেডি। ৪২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ডায়োনিসিয়া সিটিতে আয়োজিত উৎসবে তাঁর প্রথম নাটক ‘দ্য ব্যাঙ্কোয়েটার্স’ মঞ্চস্থ করে দ্বিতীয় পুরস্কার অর্জন করেন অ্যারিস্টোফেনিস। এছাড়া তাঁর ‘দ্য ব্যাবিলনিয়ান্স’ নাটকটির জন্য তিনি প্রথম পুরস্কার অর্জন করেন। কিন্তু এই নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়ার সময়ে উপস্থিত রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা বুঝতে পারেন যে নাটকে তাঁদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হয়েছে। এর ফলে ক্লিওন নাটককারের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেন তাঁরা। সেই বিচারে আসলে কী হয়েছিল সেই তথ্য কোথাও সংরক্ষিত হয়নি। পরে লেনিয়ানাতে তাঁর তৃতীয় নাটক ‘দ্য আরকানিয়ান্স’ মঞ্চস্থ হওয়ার সময় অ্যারিস্টোফেনিস এইরূপ প্রকাশ্য বিদ্রুপ করা থেকে কিছুটা সংযত রাখেন নিজেকে। কিন্তু পরবর্তী নাটকগুলিতে বারবার ক্লিওনকে আক্রমণ করেছেন অ্যারিস্টোফেনিস। তবে এতে ক্লিওনের রাজনৈতিক জীবনে খুব একটা প্রভাব পড়েনি। ‘দ্য নাইট’ নাটকে যেখানে ক্লিওন-বিরোধী নানাবিধ চটুল তির্যক মজার উপাদান ছড়িয়ে রয়েছে, তা বহুবার মঞ্চস্থ হওয়ার পরেও দশজন জেনারেলের বোর্ডে নির্বাচিত হন ক্লিওন। যেহেতু অ্যারিস্টোফেনিসের জীবনী কেউই স্পষ্ট করে সেভাবে লিখে যাননি, তাই হেলেনিস্টিক ও বাইজান্টাইন গবেষকদের অনুমান এবং নাটকের বয়ান, শিলালিপি বা প্রত্নলেখ থেকেই তাঁর জীবনের নানা ঘটনার কথা অনুমান করে নেওয়া হয়েছে। ‘দ্য নাইট’ এবং ‘দ্য ক্লাউড’ নাটক দুটিতে অ্যারিস্টোফেনিস নিজে মন্তব্য করেছেন যে তাঁর আগের নাটকগুলি তিনি নিজে পরিচালনা করেননি, সেই নাটকগুলির পরিচালক ছিলেন ক্যালিস্ট্রেটাস এবং ফিলোনেইডেস।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

তাঁর প্রথম নাটক যখন মঞ্চস্থ হয়, তখন তাঁর বয়স আঠারো বছরের কিছু বেশি। এই নাটকগুলির প্যারাবেসিস থেকে জানা যায় যে, তাঁর লেখা নাটকগুলির মাধ্যমে ক্লিওনের যে বিদ্রুপ করা হয়েছিল তার ফলে ক্লিওনের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন অ্যারিস্টোফেনিস এবং পরে উভয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়। তাছাড়া অকালেই যে তাঁর সব চুল ঝরে গিয়েছিল সেকথাও তিনি নাটকের বয়ানে স্বীকার করেছিলেন বলে জানা যায়। ৪২৫, ৪২৪ এবং ৪০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যথাক্রমে ‘দ্য আকারনিয়ান্স’, ‘দ্য নাইটস’ এবং ‘দ্য ফ্রগস’ এই তিনটি নাটকের জন্য ডায়োনিসিয়া সিটিতে পুরস্কৃত হন অ্যারিস্টোফেনিস। অ্যারিস্টোফেনিসের এক পুত্র অ্যারারোস তাঁর সঙ্গেই নাটকের প্রযোজনায় যুক্ত থাকতেন। অ্যারারোস নিজেও একজন কমেডি-কবি ছিলেন যিনি প্রত্যক্ষভাবে ৩৮৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ‘ওয়েলথ টু’ নাটকের প্রযোজনায় যুক্ত ছিলেন। এছাড়া অ্যারিস্টোফেনিসের লেখা ‘এওলেসিয়ান টু’ এবং ‘ককেলাস’ নাটকের বহুল প্রযোজনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন অ্যারারোস। প্লেটোর ‘সিম্পোজিয়াম’ গ্রন্থে অ্যারিস্টোফেনিসকে সক্রেটিসের বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং ‘দ্য ক্লাউডস’ নাটকে অ্যারিস্টোফেনিস যে সক্রেটিসের তীব্র ব্যঙ্গ করেছেন তাও উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকেই উল্লেখ করেছেন যে তিনি সক্রিয় রাজনৈতিক নাটক লিখলেও, নিজে কখনোই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না।

অ্যারিস্টোফেনিসের নাটকগুলির কাব্যিক রূপ উপলব্ধি করার জন্য আয়াম্বিক সংলাপ, টেট্রামিটার ভার্স এবং গানের প্রয়োগের কথা উল্লেখ করেন ভাষাতাত্ত্বিকেরা। অ্যারিস্টোফেনিসের নাটকগুলিকে বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য তিনটি প্রধান স্তম্ভের কথা উল্লেখ করেন সমালোচকেরা – প্রাসঙ্গিকতা, উৎসবের প্রাধান্য এবং জটিলতা। তাঁর ওল্ড কমেডি জাতীয় নাটকগুলিতে মঞ্চস্থ হওয়ার সময় প্রত্যেক অভিনেতার পৃথক মুখোশ ব্যবহার করা হতো। তাঁর ওলড কমেডিগুলিতে উৎসবের প্রাধান্যও নজরে পড়ে। ডায়োনিসিয়া সিটি ও লেনায়না শহরের উৎসবের জন্য উপযোগী পোশাক, উপযুক্ত সাঙ্গীতিক বর্ণাঢ্যতা ইত্যাদির সমাবেশ দেখা যায় তাঁর নাটকে। অ্যারিস্টোফেনিসের নাটকের প্লট মোটামুটিভাবে কতগুলি উপাদান ও ধারাক্রমে বিভক্ত – প্রোলগ, প্যারোডস, সিমেট্রিক্যাল সিন, প্যারাবেসিস, অ্যাগন, এপেইসোডস, সংস এবং এক্সোডাস। তাত্ত্বিকেরা আবার এই ‘প্যারাবেসিস’ উপাদানটির আরো জটিল বিভাজন করেছেন।

গ্রিক থিয়েটারের বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল অ্যারিস্টোফেনিসের নাটকগুলি। বিশেষত কোরাসের ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁর নাটক এক আমূল পরিবর্তন সূচিত করে। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এবং হাসির অতিরঞ্জনের মাধ্যমে তিনি এথেন্সের নগর-জীবনের নানাবিধ অসম্পূর্ণতা ও ভ্রান্তিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাইতেন দর্শকদের। প্যারোডি, পান, উচ্চকিত ভাষা ব্যবহার তাঁর নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

আনুমানিক ৩৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসে অ্যারিস্টোফেনিসের মৃত্যু হয়।         

আপনার মতামত জানান