হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাতিয়ালা ঘরানার একজন উল্লেখযোগ্য খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পী ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান (Bade Ghulam Ali Khan)। অনেকেই তাঁকে ‘বিংশ শতাব্দীর তানসেন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর কণ্ঠের বৈচিত্র্য আর নমনীয়তা তাঁকে তাঁর সমকালীন অন্যান্য শিল্পীদের থেকে অনেক বেশি খ্যাতিমান করে তুলেছিল। মাত্র কয়েক বছরের সঙ্গীত জীবনের মধ্যেই শ্রেষ্ঠতার স্বীকৃতি হিসেবে ‘সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার’ এবং ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন ঘরানার গানের শৈলী তাঁর কণ্ঠে মিলেমিশে এক নতুন অভিনব এবং স্বতন্ত্র শৈলীতে রূপ পেয়েছিল। উৎসাহের খানিক ছোঁয়ার সঙ্গে তাঁর মাধুর্যপূর্ণ উদাত্ত কন্ঠের জাদুতে সঙ্গীতের অন্তর্নিহিত রূপ প্রকাশিত হত। তাঁর সময়ে এবং তাঁর পরবর্তীকালে এই অনন্য শৈলীর অধিকারী কোনও শিল্পীই ভারতে জন্মাননি।
১৯০২ সালের ২ এপ্রিল ব্রিটিশ শাসিত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অন্তর্গত কসুরে বড়ে গুলাম আলীর জন্ম হয়। পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই কসুর জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁদের পরিবারে তথা বংশে বহু আগে থেকেই সঙ্গীতচর্চার একটা ধারা বজায় ছিল। তাঁর বাবা ওস্তাদ আলী বক্স খান নিজেও একজন খুব বড় মাপের সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। খুব ছোটবেলা থেকেই হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেওয়া শুরু করেন বড়ে গুলাম আলী। তাঁর কাকা ওস্তাদ কালে খান ছিলেন তাঁর প্রথম গুরু এবং মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই তাঁর কাছে সঙ্গীত শিক্ষা শুরু করেন তিনি। তাঁর তিন ভাইয়ের নাম ছিল যথাক্রমে বরকত আলী খান, মুবারক আলী খান এবং আমানত আলী খান। পরবর্তীকালে আলি জিওয়াই-এর সঙ্গে তাঁর বিবাহহয়। তাঁদের পুত্র ওস্তাদ মুনওয়ার আলি খানও একজন অন্যতম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন।
তাঁর বাবা আর কাকার কাছ থেকে পাতিয়ালা ঘরানার সঙ্গীতে তালিম নেওয়ার পরে বড়ে গুলাম আলী খান এই ঘরানার সঙ্গীতকেই আরও উন্নত করে তোলার চেষ্টা করেন। তিনি সনাতন ঐতিহ্যটিকে ভেঙে নতুন শৈলী আনতে চেয়েছিলেন। তিনি স্পষ্টই বুঝেছিলেন, সেই সময়কার রসজ্ঞ শ্রোতার কাছে তাঁর এই নতুন ধারার গায়নরীতি উপভোগ্য হবে। সঙ্গীতপ্রিয় মানুষদের রুচির যে সামান্য বদল ঘটতে শুরু করেছিল, তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই অন্য ঘরানার গানের ধারাও চর্চা করতে শুরু করেছিলেন গুলাম আলী। এর ফলেই ক্রমে ক্রমে পাতিয়ালা-কসুর, ধ্রুপদ, গোয়ালিয়র এবং জয়পুর ঘরানার এক সুমিষ্ট মিশ্রণ গড়ে তুলেছিলেন তিনি। ঠুমরি গানের ধারার যে ঐতিহ্যবাহী ‘বোল-বানভ’ রীতি, তার সীমা অতিক্রম করে নতুন কোনও রীতির সন্ধান করছিলেন তিনি। তাঁর আগে এভাবে কোনও সঙ্গীতশিল্পীই পাতিয়ালা-কসুর ঘরানাকে এভাবে নতুনত্বের মোড়কে মোড়ার চেষ্টা করেননি। শুধুমাত্র গানের ধারায় পরিবর্তনই নয়, সেই নতুন রীতিতে গান গেয়ে খুব অল্পসময়ের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। এই কারণেও তাঁকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা সঙ্গীতশিল্পীর মর্যাদা দেওয়া হয়। এখনও তাঁর নিজস্ব ঠুমরি গানের ধারা আধুনিক প্রজন্মের সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে প্রবহমান। এছাড়া খুব বেশি পরিবর্তন না করেই খেয়াল গানের ধারায় নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছিলেন বড়ে গুলাম আলী খান। অন্যান্য গানের উপস্থাপনের সঙ্গে এই রীতিকে মিলিয়ে ফেলতে চাননি তিনি। একেবারে সোজা-সাপ্টা সরল রীতিতে খেয়াল গাইতেন গুলাম আলী, এই গানের ধারায় খুব বড় ধরনের কোনও পরিবর্তন করেননি তিনি। প্রায়ই নতুন প্রজন্মের রীতিকে আত্মস্থ করতে চাইতেন তিনি আর তাই ঐতিহ্যবাহী রীতির মধ্যেও এক অভিনবত্বের মিশেল ঘটে যেত গুলাম আলীর উপস্থাপনে। একেবারে নিখুঁত মাধুর্য ফুটিয়ে তুলতে গানের স্বরলিপিকেও খানিক পেলব করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তাছাড়া স্বরলিপিতে খুব সূক্ষ্ম মড্যুলেশনের মধ্য দিয়ে নিখুঁত অভিব্যক্তি এবং মাধুর্য ফুটিয়ে তোলার জন্য কণ্ঠে যেন সুর নিয়ে খেলা করতেন বড়ে গুলাম আলী খান।
তাঁর সঙ্গীত জীবনের ব্যাপ্তি খুব বেশি ছিল না। ১৯৩৮ সালে কলকাতায় এবং ১৯৪৪ সালে বম্বেতে অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে প্রথম ভারতীয় সঙ্গীত জগতে নিজের দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন। যে ঘরানাতেই তিনি চর্চা করেছিলেন, তাতেই তাঁর দক্ষতার জন্য গুরু হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল গুলাম আলীকে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরে পাকিস্তানের কসুরে চলে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কিছুদিন পরেই ১৯৫৭ সালে তিনি আবার ভারতে ফিরে আসেন। বম্বের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোরারজী দেশাই-এর সহায়তায় ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করেন তিনি। প্রথমে লাহোর, তারপরে কলকাতা এবং শেষে হায়দ্রাবাদে এসে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন। বহু দিন পর্যন্ত চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক গায়ক হিসেবে কাজ করতে অসম্মত ছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৬০ সালে চিত্র প্রযোজক কে. আসিফ তাঁকে রাজি করান এবং নৌশাদের করা সুরে ‘মুঘল-ই-আজম’ ছবিতে প্রথম গান গেয়েছিলেন বড়ে গুলাম আলী খান। সোহনি ও রাগেশ্রী রাগের উপর সুর করা মোট দুটি গান গেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু তারপর থেকে ছবিতে গান গাওয়ার জন্য তাঁর পারিশ্রমিক বাড়তে শুরু করে। সেই সময় ছবিতে গান গাওয়ার জন্য লতা মঙ্গেশকর বা মহম্মদ রফি যেখানে প্রত্যেক গানের জন্য ৫০০ টাকা পারিশ্রমিক পেতেন, সেখানে বড়ে গুলাম আলী খানের পারিশ্রমিক ছিল ২৫ হাজার টাকা। ছবিতে তাঁর গাওয়া দুটি গান ছিল ‘প্রেম জোগান বন কে’ এবং ‘শুভ দিন আয়ো রাজ দুলহারা’। এছাড়াও ‘ইয়াদ পিয়া কে আয়ে’, ‘আয়ে না বালাম’, ‘প্রেম কে ফান্দে মে’ ইত্যাদি তাঁর গাওয়া সব বিখ্যাত ঠুমরি গান।
ছবিতে তাঁর গাওয়া বহু গান পরবর্তীকালে নব্বই-এর দশকে মিউজিক কোম্পানিগুলি পুনর্প্রকাশ করে। তাঁর গানের অ্যালবামগুলির মধ্যে জনপ্রিয় হল ‘মেহফিল’, ‘এচ্ড ইন টাইম’, ‘গোল্ডেন হেরিটেজ’, ‘হিন্দুস্তানি ক্লাসিকালস’ ইত্যাদি। প্রথম অ্যালবামটিতে মূলত তোড়ি, পিলু, ভৈরবী রাগের উপর আলাপ ছিল, দ্বিতীয়টিতে প্রাধান্য পেয়েছিল বাগীশ্বরী এবং মালকোশ রাগ। তৃতীয় ও চতুর্থ অ্যালবামটিতে ঠুমরি,দাদরা, ভূপালি, রাগেশ্রী, পিলু, কামোদ ইত্যাদি রাগের উপর আলাপ গেয়েছিলেন তিনি। শুধুমাত্র ঠুমরি গানের উপরেই তাঁর আলাদা একটি অ্যালবাম রয়েছে।
১৯৬২ সালে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তাঁর কৃতিত্বের জন্য ভারত সরকার তৃতীয় শ্রেষ্ঠ বেসামরিক সম্মান পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে বড়ে গুলাম আলী খানকে। ঐ একই বছরে তিনি সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার পান। এছাড়া ওস্তাদ ফৈয়াজ খানের স্মৃতিতে তিনি আফতাব-ই-মুসাকি পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া সঙ্গীতের জগতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সঙ্গীত সম্রাট পুরস্কার পান ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান।
ভারতীয় চিত্র পরিচালক হরিসাধন দাশগুপ্ত তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন যা ১৯৬৮ সালে ‘বড়ে গুলাম আলী খান সাহেব’ নামে মুক্তি পেয়েছিল। ২০১৭ সালে তাঁর শিষ্যা মালতী গিলানী তাঁর স্মৃতিতে স্থাপন করেন ‘বড়ে গুলাম আলী খান ইয়াদগার সভা’। বশিরভাগে সদর রাস্তাটি তাঁর নামে নামাঙ্কিত হয়েছে বড়ে গুলাম আলী খান মার্গ নামে।
১৯৬৮ সালের ২৫ এপ্রিল হায়দ্রাবাদে বশির বাগ প্রাসাদে ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খানের মৃত্যু হয়।
2 comments