ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু

অশ্বত্থামার বর্বরতা

মহাভারতের সৌপ্তিকপর্বে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দ্রোণের ছেলে অশ্বত্থামার এক ভয়ঙ্কর ও নৃশংস কাণ্ডের কথা জানা যায়। দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গের পর কৃপ, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা সেই সংবাদ পেয়ে দুর্যোধনের কাছে এসে তাঁকে সাংঘাতিক আহত অবস্থায় দেখে রাগে-দুঃখে পাগলের মত হয়ে কাঁদতে লাগলেন। তখন দুর্যোধন তাঁদের সান্ত্বনা দিলে অশ্বত্থামা বলেন, “মহারাজ! আমি প্রতিজ্ঞা করছি, যেমন করেই হোক আপনার সমস্ত শত্রুদের আমি হত্যা করবই।” তাঁর এই প্রতিজ্ঞা শুনে দুর্যোধন তখনই অশ্বত্থামাকে কৌরবপক্ষের সেনাপতি করে দিলেন। দুর্যোধনকে সেই অবস্থায় রেখেই তিন বীর সিংহনাদ করতে করতে সেখান থেকে চলে গেলেন।

তাঁরা তিনজন শত্রুদের ধ্বংস করার উপায় খুঁজতে খুঁজতে পান্ডবদের শিবিরের আশেপাশে ঘুরতে লাগলেন। কিন্তু শিবিরের ভিতর থেকে পান্ডবদের সিংহনাদ শুনে তাঁরা ভয় পেয়ে যান এবং সেখান থেকে পালিয়ে যান। যেতে যেতে এক বনের ভিতর এসে পৌঁছালেন তাঁরা। সেই সময় সন্ধ্যা নামল। সারাদিন পরিশ্রমের ফলে তারা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই তাঁরা একটি গাছের নিচে বিশ্রাম করতে বসলেন। কৃপ ও কৃতবর্মা ঘুমিয়ে পড়লেও অশ্বত্থামার ঘুম এলোনা। তিনি চারদিকে দেখতে লাগলেন।
সেই সময় অশ্বত্থামা একটি আশ্চর্য ঘটনা দেখতে পেলেন। ওই গাছটির ডালে একটি কাকের বাসা ছিল। কাকগুলি বাসার ভিতর ঘুমাচ্ছিল, এমন সময় একটি প্যাঁচা এসে ঘুমন্ত কাকগুলিকে হত্যা করতে লাগল। কাকগুলি বাধা দিতে পারল না এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই প্যাঁচাটি সব কাকদের মেরে শেষ করে ফেলল। এই ঘটনা দেখে অশ্বত্থামার মনে হল যে তিনিও এই উপায়েই নিজের শত্রুদের বধ করতে পারেন।

অশ্বত্থামা এরপর কৃপ ও কৃতবর্মাকে ঘুম থেকে তুলে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানালেন। প্রথমে তাঁরা কিছুতেই এই অধর্ম করতে রাজি হলেন না। কিন্তু অশ্বত্থামা বারবার পীড়াপীড়ি করায় বাধ্য হয়ে তাঁরা রাজি হলেন। তখন তাঁরা বন ছেড়ে পান্ডবদের শিবিরের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। শিবিরের দরজায় পৌঁছে অশ্বত্থামা দেখলেন, সূর্যের মত উজ্জ্বল ও তেজস্বী একজন পুরুষ পান্ডবদের শিবিরের দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে অগ্রাহ্য করে অশ্বত্থামা শিবিরে ঢুকতে গেলে সেই তেজস্বী পুরুষ বললেন, “আগে আমাকে যুদ্ধে হারাও, তারপর তুমি ভিতরে যেতে পাবে।” তিনি ছিলেন স্বয়ং মহাদেব। কিন্তু অশ্বত্থামা তাঁকে চিনতে না পেরে তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

অশ্বত্থামা যতই অস্ত্র ছুঁড়তে লাগলেন মহাদেব তা সবই গিলে ফেলতে লাগলেন। দেখতে দেখতে অশ্বত্থামার সব অস্ত্র শেষ হয়ে গেল। তখন তিনি কি করবেন কিছুই ঠিক করে উঠতে পারলেন না। হঠাৎ তাঁর মনে হল শিবের পুজো করলে হয়তো শিব তাঁর সহায় হবেন। এই ভেবে তিনি শিবের পুজো শুরু করলেন। কিন্তু তাঁর প্রার্থনায় মহাদেব সাড়া দিচ্ছেন না দেখে অশ্বত্থামা তাঁর নিজের শরীর শিবের উদ্দেশ্যে উপহার দিতে উদ্যত হলেন। এই কথা ভেবে তিনি একটি অগ্নিকুন্ড তৈরি করলেন এবং সেই আগুনে ঝাঁপ দিতে গেলেন। এইবার মহাদেব সন্তুষ্ট হয়ে অশ্বত্থামাকে নিজের রূপে দেখা দিলেন। তিনি বললেন, “হে দ্রৌণী! তোমার প্রার্থনায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। যিনি সাক্ষাৎ নারায়ণের অবতার, সেই বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ আমার অত্যন্ত প্ৰিয়। তাই আমি তাঁর সম্মান রক্ষার জন্যই পান্ডবদের শিবিরের দ্বারপাল হয়েছিলাম। কিন্তু কালের নিয়মকে কেউ পাল্টাতে পারে না। তাই আজ পঞ্চপান্ডব ও সাত্যকি বাদে শিবিরের বাকি সবাই তোমার হাতে নিহত হবে।” এই বলে মহাদেব অশ্বত্থামাকে একটি উজ্জ্বল খড়্গ উপহার দিলেন এবং নিজে তাঁর শরীরে প্রবেশ করে তাঁর বল আরো বাড়িয়ে তুললেন।

তারপর অশ্বত্থামা কৃপ ও কৃতবর্মাকে শিবিরের দরজায় দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে একাকী শিবিরে ঢুকলেন। তখন পান্ডবপক্ষের সবাই নিজের নিজের ঘরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অশ্বত্থামা আস্তে আস্তে শিবিরে ঢুকে প্রথমেই তাঁর বাবার হত্যাকারী ধৃষ্টদ্যুম্নের ঘরে গেলেন। ঘরে ঢুকেই তিনি ঘুমন্ত ধৃষ্টদ্যুম্নকে জোরে জোরে লাথি মারতে লাগলেন। ফলে তাঁর ঘুম ভেঙে যাওয়ায় তিনি চিৎকার করতে লাগলেন। কিন্তু অশ্বত্থামা তাঁকে খাট থেকে টেনে মাটিতে নামিয়ে এনে তাঁর সমস্ত মর্মস্থানে নিষ্ঠুরভাবে লাথি মারতে লাগলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন কোনোরকমে বললেন, “আমাকে অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করুন, তাহলে আমার স্বর্গলাভ হবে।” কিন্তু অশ্বত্থামা তাঁর কথা না শুনে তাঁর বুকে লাথি মেরে তাঁকে হত্যা করলেন।

ততক্ষণে ধৃষ্টদ্যুম্নের চিৎকারে শিবিরের সবার ঘুম ভেঙে গেছে। কিন্তু কেউই বুঝতে পারছেন না যে কি ঘটছে। মহিলারা কান্নাকাটি শুরু করেছেন। সেই হট্টগোলের মধ্যেই অশ্বত্থামা নিজের রথে উঠে সিংহনাদ করতে শুরু করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের অনুচরেরা তাঁকে আক্রমণ করলে তিনি মহাদেবের দেওয়া খড়্গ দিয়ে তাদের সবাইকেই বধ করলেন। এরপর তিনি ঘুমন্ত উত্তমৌজাকে দেখতে পেয়ে তাঁকে পশুর মতো মারতে লাগলেন। সেই ভীষণ প্রহারে উত্তমৌজা প্রাণত্যাগ করলেন। তাঁকে প্রাণহীন দেখে অশ্বত্থামাকে আক্রমণ করলেন যুধাজিৎ। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই তাঁরও মৃত্যু হল। এইভাবে অশ্বত্থামা অসতর্ক অবস্থায় একের পর এক পান্ডবপক্ষের মহারথীদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে লাগলেন। যারা যারা প্রাণ বাঁচাবার জন্য শিবির থেকে বেরোতে গেল, তাঁদের কৃপ ও কৃতবর্মা হত্যা করলেন। ক্রমে ক্রমে অশ্বত্থামা দ্রৌপদীর পাঁচ ছেলেকে দেখতে পেলেন, তাঁরা এর মধ্যেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। অশ্বত্থামাকে দেখে তাঁরা পাঁচজনে একসাথে অশ্বত্থামার দিকে বাণ ছুঁড়তে লাগলেন। তখন বাবার মৃত্যুর কথা ভেবে অশ্বত্থামা তাঁদেরও বধ করার ইচ্ছায় ভীষণ সিংহনাদ করলেন। তারপর ঢাল ও তরবারি হাতে তাঁদের দিকে এগিয়ে এলেন।

প্রথমে যুধিষ্ঠিরের ছেলে প্রতিবিন্ধ্য এগিয়ে এলে অশ্বত্থামা তরবারি দিয়ে তাঁর পেটে আঘাত করলেন, সেই আঘাতেই তাঁর মৃত্যু হল। তা দেখে ভীমের ছেলে সুতসোম তরবারি নিয়ে অশ্বত্থামাকে আক্রমণ করলে অশ্বত্থামা তাঁর ডান হাতটি কেটে ফেলে তাঁর বুকে তরবারির আঘাত করে তাঁকে হত্যা করলেন। তারপর নকুলের ছেলে শতানীক একটি রথের চাকা তুলে নিয়ে অশ্বত্থামাকে আক্রমণ করতে যেতেই অশ্বত্থামা তাঁকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে তাঁর মাথা কেটে তাঁকে হত্যা করলেন। এরপর তিনি অর্জুনের ছেলে শ্রুতকর্মা ও সহদেবের ছেলে শ্রুতসেনকেও তরবারির আঘাতে হত্যা করলেন।

এইভাবে অশ্বত্থামা নির্বিচারে শিবিরের সবাইকে হত্যা করতে লাগলেন। কিছু লোক ঘোড়া ও হাতিদের পায়ের তলায় পিষে মারা গেল। কিছু লোক যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছিল, অশ্বত্থামা তরবারি দিয়ে কারও পা, কারও হাত আবার কারও পেটে তরবারি ঢুকিয়ে তাদের বধ করতে লাগলেন। রক্ত ও মাংসের গন্ধ পেয়ে দলে দলে নিশাচর মাংসাশী পশু ও পাখিরা শিবিরে ঢুকে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে লাগল। নানারকম পিশাচ ও রাক্ষসেরাও এসে মৃতদেহের মাংস ও রক্ত খেতে লাগল। তখন কৃপ, কৃতবর্মা ও অশ্বত্থামা শিবিরের তিনদিকে আগুন লাগিয়ে দিলেন। দেখতে দেখতে সেই আগুনে শিবির পুড়ে ছাই হয়ে যেতে লাগল।
নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে অশ্বত্থামা শান্ত হলেন। তাঁরা তিনজনে মিলে তখন ধ্বংস হয়ে যাওয়া পান্ডবদের শিবির ত্যাগ করে আহত দুর্যোধনকে এই সুখবর জানানোর জন্য সেখান থেকে চলে গেলেন।

তথ্যসূত্র


  1. ‘মহাভারত’,কালীপ্রসন্ন সিংহ,সৌপ্তিকপর্ব, অধ্যায় ১-৯, পৃষ্ঠা ১-১৯
  2. ‘ছেলেদের মহাভারত', উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় মুদ্রণ, শল্যপর্ব, পৃষ্ঠা ১৮৫-১৮৬, সৌপ্তিকপর্ব, পৃষ্ঠা ১৮৭-১৯০
  3. ‘মহাভারতের একশোটি দুর্লভ মুহূর্ত', ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, দ্বিতীয় প্রকাশ, অধ্যায় ৮৭, ‘নিদ্রিত পান্ডব-পাঞ্চাল বধ', পৃষ্ঠা ৫৯৫-৫৯৮

আপনার মতামত জানান