মহাভারতের দ্রোণপর্বে ১৪২তম অধ্যায়ে ভূরিশ্রবা র নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরব পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধের চৌদ্দ দিনের দিন পান্ডব পক্ষের মহাযোদ্ধা সাত্যকির হাতে ভূরিশ্রবার মৃত্যু হয়।
যদুবংশে শিনি নামে এক মহাবীর রাজা ছিলেন। মথুরার রাজকন্যা দেবকীর যখন স্বয়ম্বর হয়, তখন এই শিনি অন্য সব রাজাদের যুদ্ধে হারিয়ে তাঁর ভাই বসুদেবের জন্য দেবকীকে অপহরণ করেন। দেবকীকে পাওয়ার আশায় এরপর কুরুবংশীয় সোমদত্ত শিনির সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন। শিনি সোমদত্তকে যুদ্ধে হারিয়ে তাঁকে মাটিতে ফেলে লাথি মারলেন এবং মাথার চুল মুঠিতে ধরে মাথা কাটতে উদ্যত হলেন, কিন্তু শেষকালে দয়া করে ছেড়ে দিলেন। এই ঘটনায় খুব অপমানিত হয়ে সোমদত্ত প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মহাদেবের তপস্যা আরম্ভ করলেন। তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব দেখা দিলে সোমদত্ত বর চাইলেন, “দেবাদিদেব! আমাকে এমন একটি ছেলে দিন যে ওই দুরাত্মা শিনির বংশধরকে যুদ্ধে হারিয়ে মাটিতে ফেলে তার বুকে লাথি মারার মতো ক্ষমতা রাখবে।” মহাদেব “তথাস্তু!” বলে অদৃশ্য হলেন। এরপর যথাসময়ে সোমদত্তের একটি ছেলে হল। তাঁর নাম রাখা হল ‘ভূরিশ্রবা’। আর যদুবংশে শিনির বংশে জন্ম হল সাত্যকির।
যুদ্ধের তেরোতম দিনে অভিমন্যুর মৃত্যু হওয়ার পর শোকে কাতর অর্জুন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন পরের দিন সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে হয় তিনি জয়দ্রথকে বধ করবেন, নতুবা জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করে নিজের প্রাণত্যাগ করবেন। ওদিকে কৌরব পক্ষের সেনাপতি দ্রোণাচার্য দুর্যোধনকে কথা দিয়েছিলেন যে, অর্জুন রক্ষা না করলে তিনি যুধিষ্ঠিরকে ধরে আনবেন। দুর্যোধন অর্জুনকে সরিয়ে আনার জন্য ‘সংশপ্তক’ নামে সৈন্যদের নিযুক্ত করলেন। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার আগে অর্জুন মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করার জন্য তাঁর কাছে সাত্যকিকে রেখে গেলেন। কিন্তু অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও অর্জুন ফিরে আসছেন না বা তাঁর ধনুকের টঙ্কার ও শঙ্খের শব্দ, কৃষ্ণের শঙ্খের শব্দ কিছুই শোনা যাচ্ছে না বলে মহারাজ যুধিষ্ঠির চিন্তায় পড়লেন। তিনি অর্জুনকে খোঁজার জন্য সাত্যকিকে যেতে আদেশ করলেন। সাত্যকি প্রথমে যেতে না চেয়েও যুধিষ্ঠিরের আদেশ অমান্য করতে পারলেন না। অর্জুনের অনুকরণে তিনিও একে একে কৌরব সৈন্যদলের তিনটি স্তর পেরিয়ে চতুর্থ স্তরের দিকে যেতেই অর্জুন ও কৃষ্ণের শঙ্খের আওয়াজ এবং অর্জুনের ধনুকের টঙ্কার শুনতে পেলেন।
সাত্যকিকে আসতে দেখে মহাবীর ভূরিশ্রবা তাঁকে আক্রমণ করলেন। একটি স্ত্রী হাতিকে পাওয়ার জন্য দুটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ হাতি যেমন রাগে পাগল হয়ে গিয়ে যুদ্ধ করে, সাত্যকি ও ভূরিশ্রবা ঠিক তেমনভাবেই একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। সাত্যকিকে বধ করার জন্য ভূরিশ্রবা অসংখ্য তীক্ষ্ণমুখ বাণ দিয়ে তাঁকে প্রায় ঢেকে ফেললেন। সাত্যকি সেই সব বাণ কেটে আরো নানান বাণ প্রয়োগ করে ভূরিশ্রবাকে উচিত জবাব দিলেন। যুদ্ধ করতে করতে দুজনেরই রথ, সারথি ও রথের ঘোড়া কাটা গেল। তখন তাঁরা ষাঁড়ের চামড়ার ঢাল ও খড়্গ নিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। কিন্তু অনেকক্ষণ যুদ্ধ করে ক্লান্ত থাকায় সাত্যকি আস্তে আস্তে ভূরিশ্রবার কাছে হেরে যেতে থাকলেন। ভূরিশ্রবা সাত্যকিকে মাটিতে ফেলে তাঁর বুকে লাথি মারলেন এবং তাঁর চুলের মুঠি ধরে খড়্গ দিয়ে মাথা কাটতে উদ্যত হলেন।
এই ঘটনা দেখতে পেয়ে উদ্বিগ্ন কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, “অর্জুন! তোমাকে সাহায্য করতে এসে তোমার শিষ্য সাত্যকি এমন অবস্থায় পড়েছে। তাই তার প্রাণরক্ষা করা তোমার কর্তব্য। তাড়াতাড়ি সাত্যকিকে সাহায্য করো।” কৃষ্ণের কথা শুনে অর্জুন দূর থেকেই উল্কার মত ভয়ানক একটি বাণ দিয়ে ভূরিশ্রবার ডানহাত কেটে ফেললেন। এতে ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়ে ভূরিশ্রবা অর্জুনকে প্রশ্ন করলেন, “আমি অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম, তুমি অন্যায়ভাবে কৃষ্ণের কথা শুনে আমার হাত কাটলে কেন? এরকম অন্যায় ভাবে অস্ত্রপ্রয়োগ কে তোমাকে শিখিয়েছেন, ইন্দ্র, রুদ্র, দ্রোণ না কৃপ?” এই কথা শুনে অর্জুন উত্তর দিলেন, “আমার বন্ধু ও শিষ্যকে কেউ আমারই সামনে বধ করার চেষ্টা করছে দেখেও যদি আমি চুপ করে থাকতাম, তবে তা অধর্ম হত। আর তুমি আমাকে অন্যায়ের কথা বলছ? তোমরা সবাই মিলে যেভাবে নিরস্ত্র অবস্থায় অভিমন্যুকে বধ করেছিলে তা কি ন্যায় হয়েছিল? সাত্যকিও তো নিরস্ত্র হয়েছিলেন, তবুও তুমি তাঁকে বধ করার চেষ্টা করছিলে। এতে যদি তোমার অন্যায় না হয়ে থাকে, সাত্যকিকে রক্ষা করায় আমারও কোনো অন্যায় হয়নি।”
ভূরিশ্রবা একথার কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। তিনি বাম হাতে নিজের কাটা ডান হাতটিকে ধরে অর্জুনের দিকে ছুঁড়ে দিলেন। তারপর নিজের হাতে শরশয্যা তৈরি করে অনাহারে প্রাণত্যাগ করবেন বলে তিনি মন্ত্র উচ্চারণ করতে শুরু করলেন। তখন কৃষ্ণ তাঁকে বললেন, “হে মহাবীর! দেবতারাও যে জায়গায় বাস করতে ইচ্ছা করেন, মৃত্যুর পর তুমি সেই বিষ্ণুলোকে গিয়ে বাস করো। তোমার অক্ষয় স্বর্গলাভ হোক, এই আমার ইচ্ছা।” এদিকে সাত্যকি ততক্ষণে জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন। ভূরিশ্রবাকে যুদ্ধ ছেড়ে দিতে দেখে তিনি খড়্গ তুলে নিলেন এবং ভূরিশ্রবাকে বধ করার জন্য তাঁর দিকে ছুটে যেতে লাগলেন। এই নৃশংস কাণ্ড দেখে কৌরব ও পান্ডব যোদ্ধারা চিৎকার করে সাত্যকিকে বারণ করতে লাগলেন। কিন্তু সাত্যকি কারোর কোনো কথা না শুনেই খড়্গ দিয়ে ভূরিশ্রবার মাথা কেটে ফেললেন। এই ঘটনায় সবাই সাত্যকির নিন্দা করতে লাগল। তখন নিজেকে সমর্থন করার জন্য সাত্যকি বললেন, “আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যে আমাকে যুদ্ধে পরাজিত করে মাটিতে ফেলে আমার বুকে লাথি মারবে, সে যতই সাধুলোক হোক না কেন তাকে আমি বধ করব। আর কিছুক্ষণ আগেই ভূরিশ্রবা আমাকে নিরস্ত্র অবস্থায় পেয়ে বধ করতে যাচ্ছিল। তখন তো আপনারা তাকে বারণ করেননি! আমি ভূরিশ্রবাকে বধ করে ঠিক কাজই করেছি। অর্জুনই তার হাত কেটে দিয়ে আমাকে বঞ্চিত করেছেন।”একথা বলে সাত্যকি আবার যুদ্ধ শুরু করলেন। কৃষ্ণ ও অর্জুনও রথে উঠে গিয়ে আবার জয়দ্রথের খোঁজে সামনের দিকে যেতে লাগলেন।
তথ্যসূত্র
- শ্রী কালীপ্রসন্ন সিংহ বিরচিত ‘মহাভারত’, দ্রোণপর্ব, অধ্যায় ২৪২-২৪৩, পৃষ্ঠা ২৩২-২৩৮
- ‘মহাভারতের একশোটি দুর্লভ মুহূর্ত', ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, ভূরিশ্রবা বধ, পৃষ্ঠা ৪৬৭-৪৭২
One comment