ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট

ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট

ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট (Daniel Gabriel Fahrenheit) একজন ডাচ পদার্থবিদ এবং যন্ত্র নির্মাতা। ইতিহাসে তিনি মূলতঃ ফারেনহাইট থার্মোমিটারের আবিষ্কারক হিসেবেই বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনিই প্রথম থার্মোমিটারের সূচক হিসেবে পারদের ব্যবহার করেছিলেন এবং বানিয়েছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর সবচেয়ে নিখুঁত থার্মোমিটারটি । বর্তমানে এই ডিজিট্যাল যুগেও পারদ থার্মোমিটারের ব্যবহার বন্ধ হয়নি। এখনও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্য আমেরিকার ক্যারিবিয়ান দেশগুলিতে ফারেনহাইট থার্মোমিটারের ব্যবহার করা হয়।

ড্যানিয়েল গাব্রিয়েল ফারেনহাইটের জন্ম হয় ১৬৮৬ সালের ২৪ মে, পোল্যান্ডের ড্যানশিস (Danzig) শহরে যা সেই সময় পলিশ লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথের অংশ ছিল। তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন একজন বণিক। তাঁর মা কনকর্দিয়া শ্যুমান (Concordia Schumann) ছিলেন ড্যানশিসের একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা। তাঁর প্র-পিতামহ জার্মানির রস্টকের (Rostock) বাসিন্দা ছিলেন যিনি ১৬৫০ সালে ড্যানশিস চলে আসেন এবং সেখানেই পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেন। ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট ছিলেন তাঁর পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে বড়। ১৭০১ সালের ১৪ আগস্ট  মাশরুম পয়জনিং এর ফলে তাঁর বাবা মায়ের মৃত্যু হয়।

 পারিবারিক চাপের কারণে আঠেরো বছর বয়সে তাঁকে চলে যেতে হয় আমস্টারডামে হিসাব রক্ষকের কাজের প্রশিক্ষণ নিতে। কিন্ত কাজে মন না বসায় তিনি আমস্টারডাম শহর ছেড়েই পালিয়ে যান। অবস্থা এতটাই প্রতিকূল ছিল যে ১৭০৭ সালে তাঁর নামে রীতিমত সমন জারি করা হয়। এই সময় তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। জার্মানির বার্লিন, সালে (Halle), লেইপশিস (Leipzig), এবং ড্রেসদেন (Dresden) হয়ে অবশেষে ডেনমার্কের শহর কোপেনহেগেন পৌঁছান। এর আগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে তাঁর বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার সমন্ধে সম্যক ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

বিজ্ঞানের প্রতি কৌতূহলের ফলে তাঁর পরিচয় হয় ক্রিস্টিয়ান উলফ এবং গটফ্রে লেইবনিজের মতো জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের সঙ্গে। ১৭০৮ সালে কোপেনহেগেন এসে তাঁর পরিচয় হয় বিখ্যাত ড্যানিশ পদার্থবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওলে রোমার (Ole Rømer) এর সঙ্গে। রোমার প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে আলোর সসীম গতিবেগের ধারণা দেন। ফারেনহাইটের তাঁর কাছে আসার কারণ ছিল অন্য। ফারেনহাইট এর আগে থার্মোমিটারের ব্যাপারে শুনেছিলেন। কিন্ত রোমারের সান্নিধ্যে এসে তাঁর সুযোগ হয় থার্মোমিটারের ওপর হাতে কলমে কাজ করার। রোমারের থেকেই তিনি জানতে পারেন তাপ প্রয়োগে পদার্থের প্রসারণের ব্যাপারে। ১৭০১ সালে রোমার তাঁর থার্মোমিটারের ধারণা দেন। তিনি অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড , জল এবং বরফের মিশ্রণকে 0° ধরে হিসেব করেছিলেন। সেই সময় এটাই ছিল পরিমাপযোগ্য সবচেয়ে কম তাপমাত্রা (প্রায় -১৮° সেলসিয়াস)। তাঁর থার্মোমিটার অনুযায়ী বিশুদ্ধ জলের গলনাঙ্ক দাড়ায় ৭.৫° রোমার এবং মানুষের শরীরের তাপমাত্রা ২২.৫° রোমার। রোমার তাঁর থার্মোমিটারের রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে এই তিনটে আলাদা আলাদা তাপমাত্রার ব্যবহার করেছিলেন। ফারেনহাইট যদিও এই ব্যাপারগুলির সমন্ধে আগে থেকেই কিছুটা অবগত ছিলেন। কিন্ত রোমারের সান্নিধ্য তাঁকে উৎসাহিত করে নিজের তৈরি থার্মোমিটার বানানোর জন্য। শুরু করেন গবেষণা। এই সময় বেশ কিছু জিনিস তাঁর নজরে আসে। প্রথমত ফারেনহাইট লক্ষ করেন বেশি তাপমাত্রা মাপার জন্যে সূচক হিসাবে ইথানল মোটেই উপযোগী নয়। এছাড়াও বহু ক্ষেত্রে ইথানল কাঁচের গায়ে লেগে থাকার ফলে থার্মোমিটারের পাঠ ভুল হওয়ার সম্ভবনা থেকে যায়। দ্বিতীয়ত, রোমার স্কেলে দশমিক সংখ্যার ব্যবহার করেন এবং দুটি তাপমাত্রার পার্থক্য কেও দশমিক সংখ্যায় প্রকাশ করেন যেটি পাঠ গ্রহণের পদ্ধতিকে অপেক্ষাকৃত জটিল বানায় বলেই ধারণা হয় ফারেনহাইটের। তৃতীয়ত, তিনি লক্ষ করেন থার্মোমিটারকে বেশি তাপমাত্রায় রাখলে কাঁচের প্রসারণ ঘটে। ফলে থার্মোমিটারের পাঠ কম আসে। অতএব এই সমস্ত ত্রুটি গুলিকে সংশোধন করতে ফারেনহাইট তাঁর তৈরি থার্মোমিটারে বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন। ১৭০৯ সালে তাঁর তৈরি প্রথম থার্মোমিটারে তিনি সূচক হিসেবে জলের ব্যবহার করেন। কিন্ত সেক্ষেত্রেও অসুবিধাগুলি অব্যাহত থাকায় তিনি এবার সূচক হিসেবে ব্যবহার করেন পারদ বা মার্কারি। ইথানলের চাইতে পারদের স্ফুটনাঙ্ক অনেক বেশি হওয়ায় পারদ ব্যবহার করে সহজেই অপেক্ষাকৃত বেশি তাপমাত্রা মাপা যেতে পারে। এছাড়াও অন্যান্য তরলের মতো পারদ কাঁচের গায়ে লেগে থাকে না যা থার্মোমিটারের পাঠকে আরো বেশি নিখুঁত করে।  নিজের তৈরি থার্মোমিটারে দশমিক সংখ্যার পাঠ এড়াতে তিনি রোমারের স্কেলের প্রতিটা পয়েন্টকে চার দিয়ে গুন করেন এবং একটি নতুন স্কেলের আবিষ্কার করেন। এই স্কেলেও অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড , জল এবং বরফের মিশ্রণকে 0 ° ধরেই হিসাব করা হয়। কিন্ত এখানে জলের গলনাঙ্ক বেড়ে হয় ৩২° ফারেনহাইট এবং মানুষের স্বাভাবিক উষ্ণতা হয় ৯৬° ফারেনহাইট। এইভাবেই সম্পূর্ণ নিজের পদ্ধতিতে আগের থার্মোমিটারগুলির সংশোধন করে ১৭১৪ সালে ফারেনহাইট তৈরি করেন প্রথম মার্কারি থার্মোমিটার এবং ফারেনহাইট স্কেল।

প্রথম দিকে রোমারের মতোই ফারেনহাইট থার্মোমিটারের সর্বাধিক উষ্ণতার মাপ রাখা হয়েছিল মানুষের স্বাভাবিক উষ্ণতার সমান করে অর্থাৎ ৯৬° ফারেনহাইট । পরে এই স্কেলে জলের স্ফুটনাঙ্ক অর্থাৎ ২১২° ফারেনহাইটকে ফারেনহাইট স্কেলের সর্বোচ্চ বিন্দু হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। বিজ্ঞানের যুগে এটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইল ফলক। ১৭১৭ সালে ফারেনহাইট নেদারল্যান্ডের শহর হেগ এ ফিরে আসেন এবং গ্লাস ব্লোয়ার হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন। এই সময় থার্মোমিটার, ব্যারোমিটার ইত্যাদি তৈরির পাশাপাশি গবেষণার কাজও তিনি চালিয়ে যান। সেই বছরই তিনি আবিষ্কার করেন মার্কারি ক্লক। একই বছরে “Acta Editorem” নামের একটি জার্নাল প্রকাশ করে তিনি তাতে তাঁর থার্মোমিটারের ব্যাপারে লেখেন। ১৭২৪ সালে  “Philosophical Transactions” নামে আরেকটি জার্নাল প্রকাশ করেন যাতে তিনি পদার্থ বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। এগুলির মধ্যে ছিল বিভিন্ন তরলের বিভিন্ন স্ফুটনাঙ্কের ব্যাপারে পুঙ্খানপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ, শূন্যস্থানে জলের কঠিনীভবন বা solidification, গলনাঙ্কের নিচের কোনো তাপমাত্রায় জলের তরল অবস্থায় থাকার সম্ভাবনা বিষয়ক আলোচনা ইত্যাদি । সেই বছরই অর্থাৎ ১৭২৪ সালেই তিনি ইংল্যান্ডের রয়েল সোসাইটির সদস্যপদ পান।

মার্কারি থার্মোমিটারের আবিষ্কার ফারেনহাইটের জীবনে প্রচুর সাফল্য এনে দিলেও তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলি কাটে প্রবল অর্থকষ্টে। ১৭৩৬ সালের আগস্ট মাসে তিনি একটি পেটেন্ট সম্পর্কিত কাজের জন্যে জোহানেস ফ্রিসলেবেন (Johannes Frisleven )নামের একজন পরিচিতের বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিন্ত সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৭ সেপ্টেম্বর এর মধ্যে তাঁর অবস্থা এতটাই করুণ হয়ে পরে যে একজন নোটারিকে ডাকা হয় তাঁর উইল বানানোর জন্যে।

১৭৩৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পঞ্চাশ বছর বয়সে নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইটের মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান