ফরিদপুর জেলা

ফরিদপুর জেলা

বাংলাদেশ ৬৪টি জেলাতে বিভক্ত। বেশিরভাগ জেলাই স্বাধীনতার আগে থেকে ছিল, কিছু জেলা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে গঠিত, আবার কিছু জেলা একটি মূল জেলাকে দুভাগে ভাগ করে তৈরি হয়েছে মূলত প্রশাসনিক সুবিধের কারণে। প্রতিটি জেলাই একে অন্যের থেকে যেমন ভূমিরূপে আলাদা, তেমনি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও স্বতন্ত্র। প্রতিটি জেলার এই নিজস্বতাই আজ বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছে। সেরকমই একটি জেলা হল ফরিদপুর জেলা (Faridpur) ।

বাংলাদেশের প্রায় মধ্যাঞ্চলে থাকা ঢাকা বিভাগের একটি জেলা ফরিদপুর গড়ে উঠেছিল ১৭৮৬ সালে। বিখ্যাত পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের বাড়ি এই ফরিদপুর সমগ্র বাংলাদেশে খেজুরের গুড়ের জন্য বিখ্যাত।

বাংলাদেশের একটি অন্যতম জেলা হল ফরিদপুর৷ উত্তরে রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে গোপালগঞ্জ জেলা, পূর্বে মাদারীপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে মাগুরা ও নড়াইল জেলা ঘিরে রেখেছে সমগ্র জেলাটিকে৷


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

পদ্মা এবং মেঘনা ফরিদপুর জেলার উল্লেখযোগ্য দুই নদী৷ এছাড়া এই জেলায় কুমার নদী, মধুমতী নদী, বারাশিয়া নদী ও চন্দনা নদী প্রবাহিত হয়েছে৷ গঙ্গা নদীর প্রধান শাখা হওয়ার পাশাপাশি পদ্মা বাংলাদেশেরও প্রধান নদী। নদীটি মুন্সীগঞ্জ জেলার কাছাকাছি অবস্থিত ভেলবারিয়া ফ্যাকটরিয়ার উত্তর-পশ্চিম দিকে গোয়ালন্দের পাশেই যমুনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে চাঁদপুর জেলায় প্রবেশ করেছে। এই নদী ফরিদপুর থেকে বেশ কিছু মাইল দূরে ‘চর মুকুন্দিয়া’ নামে দ্বীপ গঠন করেছে৷ পদ্মা নদী থেকে কুমার নদের উৎপত্তি যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জ জেলার একটি উল্লেখযোগ্য নদ। পদ্মার আরেকটি শাখা নদ হল আড়িয়াল খাঁ যার পূর্ব নাম ছিল ভুবনেশ্বর। বাংলাদেশ নদীকেন্দ্রিক দেশ। এখানকার মানুষেরা অনেকাংশেই নদীর উপর নির্ভরশীল৷ ফরিদপুর জেলাও তার ব্যতিক্রম নয় কারণ নদীকে কেন্দ্র করে এখানকার এক অংশের মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন৷

আয়তনের বিচারে ফরিদপুর জেলা সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে দশম বৃহত্তম জেলা। এর আয়তন ২,০৭৩ বর্গকিমি। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জনসংখ্যার বিচারে ফরিদপুর জেলা সমগ্র বাংলাদেশে তেত্রিশতম জনবহুল জেলা। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে ফরিদপুরের মোট জনসংখ্যা ১৯,১২,৯৬৯ জন এবং এখানে পুরুষ অ স্ত্রী লোকের সংখ্যার অনুপাত প্রায় সমান।

অনেক কীর্তিময় গৌরব-গাঁথা ফরিদপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে৷ আগে আমরা জেনে নেবো এই জেলার নামকরণের ইতিহাস। ফরিদপুর ব্রিটিশ শাসন আমলে সৃষ্ট বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন জেলা। ১৭৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই জেলা সেই সময়ে জালালপুর নামে পরিচিত ছিল। জালালপুরের প্রধান কার্যালয় ছিল ঢাকা শহরে। ১৮০৭ সালে ঢাকা এবং জালালপুর বিভক্ত হয়ে যায় আর তখন থেকেই এটি ফরিদপুর জেলা নামে পরিচিতি পায়৷ মনে করা হয় ফরিদপুর জেলার নাম এসেছে ‘ফতেহাবাদ’ থেকে যা আসলে প্রখ্যাত সাধক এবং দরবেশ খাজা মইনউদ্দিন চিশতী (রহঃ)-র শিষ্য শাহ ফরিদের (রহঃ) নাম থেকে। এই জেলার হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হয়েছিল ফরিদপুর শহরে। ফরিদপুর সদর, গোয়ালন্দ, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ এই চারটি মহকুমা মিলে তৈরি হয়েছিল ফরিদপুর জেলা।

উনিশ শতকে বাংলায় সংঘটিত কৃষক-বিদ্রোহগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ফরাজি আন্দোলন আর এই আন্দোলনে ফরিদপুর জেলার মুখ্য ভূমিকা ইতিহাসে লক্ষণীয়। ফরাজি আন্দোলনের মূল প্রবর্তক ছিলেন হাজি শরিয়ৎউল্লাহ৷ তাঁর অনুগামী অজস্র মুসলিম চাষি, কারিগর ও বেকার তাঁতিরা ক্রমে ক্রমে পূর্ববঙ্গের ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, যশোহর, নোয়াখালি, বাখরগঞ্জ ইত্যাদি জেলায় বিদ্রোহ শুরু করেন৷ এই আন্দোলন বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় শুরু হলেও ধীরে ধীরে ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোহর, চব্বিশ পরগনা প্রভৃতি জেলায় বিস্তার লাভ করে। ১৮৩৭ সালে হাজি শরিয়ৎউল্লাহ মারা গেলে তাঁর পুত্র দুদু মিঞা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন৷ বাংলার কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে ফরিদপুরের ফরাজি আন্দোলন স্মরণীয়।

ফরিদপুর জেলায় মোট চারটি পৌরসভা, ছত্রিশটি ওয়ার্ড, বিরানব্বইটি মহল্লা, উনআশিটি ইউনিয়ন এবং একহাজার আটশ উনষাটটি গ্রাম রয়েছে। এই জেলার উপজেলার সংখ্যা মোট নয়টি যথা – ফরিদপুর সদর, মধুখালী, বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা, সালথা, নগরকান্দা, ভাঙ্গা, সদরপুর এবং চরভদ্রাসন।

ফরিদপুর জেলা চাষবাসে যথেষ্ট উন্নত। এখানকার প্রধান শস্য ধান, পাট, আখ, গম, পিঁয়াজ, সরিষা, ডাল এবং মরিচ। এখানকার শস্য বাইরেও রপ্তানি করা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পাট, পিঁয়াজ, ডাল, খেজুরের গুড় ইত্যাদি। মধুমতি নদী ফরিদপুরের উল্লেখযোগ্য নদী যাতে ইলিশ, বাচা, বাঘাইড়, চিতল, চিংড়ি, বেলে, আড়, রুই ও কাতলাসহ অনেক ধরণের সুস্বাদু মাছের সন্ধান মেলে আর নদীর তীরবর্তী অঞ্চল খুব উর্বর হওয়ার ধান, পাট এবং বিভিন্ন অর্থকরী ফসল উৎপাদন করা হয় এখানে।

ফরিদপুর জেলার উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ স্থানের তালিকা অপূর্ণই থেকে যাবে যদি তালিকার শুরুতেই পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের বাড়ি এবং কবরস্থানের নাম না থাকে। এটি ছাড়াও বিখ্যাত ভ্রমণ স্থানের মধ্যে পড়ে নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট, জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রম, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি যাদুঘর এবং প্রাচীন নিদর্শন ও প্রত্ন সম্পদের মধ্যে গেরদা মসজিদ, পাতরাইল মসজিদ, সাতৈর মসজিদ, বাসুদেব মন্দির, জগদ্বন্ধুর আঙ্গিনা, ফতেহাবাদ টাঁকশাল, মথুরাপুর দেউল, বাইশরশি জমিদারবাড়ি, জেলা জজ কোর্ট ভবন, ভাঙ্গা মুন্সেফ কোর্ট ভবন উল্লেখযোগ্য। ফরিদপুর জেলার সদর উপজেলায় গোবিন্দপুর গ্রামে পল্লী কবি জসীমউদ্দিনের বাড়ি অবস্থিত। বাড়ির উত্তরে রাস্তার পাশে কবির কবরস্থানটি রয়েছে৷ এটি এই জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান৷ এরপর মধুখালী উপজেলার মথুরাপুর গ্রামে অবস্থিত মথুরাপুর দেউলের কথায় আসা যেতে পারে৷ এটি একটি ঐতিহ্যবাহী প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। এই মঠটি ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মধুখালী বাজার থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে চন্দনা নদীর তীরে অবস্থিত। টেরাকোটার শৈল্পিক কারুকার্যমন্ডিত বারো কোণ বিশিষ্ঠ এই মথুরাপুর দেউল বা মঠের উচ্চতা প্রায় ৮০ ফুট। দেউলটিতে প্রবেশের মধুখালী উপজেলার মথুরাপুর গ্রামে অবস্থিত মথুরাপুর দেউল একটি ঐতিহ্যবাহী প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। মঠটি ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মধুখালী বাজার থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে চন্দনা নদীর তীরে অবস্থিত। টেরাকোটার দৃষ্টিনন্দন ও শৈল্পিক কারুকার্যমণ্ডিত বারো কোণ বিশিষ্ট মথুরাপুর দেউল বা মঠের উচ্চতা প্রায় আশি ফুট। এর স্থাপত্য শিল্প বলে দেয় এটি মোগল আমলের কীর্তি। এই দেউলটিতে প্রবেশ করার দুইটি দরজা রয়েছে। সমগ্র মঠ জুড়ে রয়েছে শিলা খন্ডের ছাপচিত্র এর পাশাপাশি মাটির ফলকের তৈরি অসংখ্য ছোট ছোট মুর্তিও দেখা যায়৷ গেরদা গ্রামে অবস্থিত গেরদা মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে আরবি ভাষায় লেখা পাথরের এক বিশেষ ফলক রয়েছে, এই ফলকটিই গেরদা ফলক হিসেবে পরিচিত। এখানেও ইতিহাসপিপাসু মানুষের ভিড় দেখা যায়। প্রায় ১০১৩ হিজরি বা ১৬০৪ সালে লেখা এই ফলককে কেন্দ্র করেই গেরদা মসজিদটি তৈরি করা হয়েছে যা দেখতে পর্যটকেরা আসেন৷ ফরিদপুরের ভ্রমণ বৃত্তান্তে অবশ্য দ্রষ্টব্য জায়গা হিসেবে জাদুঘরের কথা আসবেই। জেলা পরিষদ চত্বরেই অবস্থিত ছোট্ট জাদুঘর ভবনটি তার স্থাপত্যশিল্পের জন্য বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। এক কোঠা বিশিষ্ট এই জাদুঘরটি আট ধার বিশিষ্ট ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত। এখানে রাখা আছে একটি হাত কামান, পুঁথি, তিনটি কাঠের নারীমূর্তি, দুটি পাথরের শিবলিঙ্গ, মুদ্রা, নোট, ডাকটিকিট, মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মারকসূত্র প্রভৃতি সরঞ্জাম৷

ফরিদপুর জেলা বেশ কিছু কৃতী মানুষের জন্মস্থান। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ অম্বিকাচরণ মজুমদার, হাজী শরিয়তউল্লাহ, শিক্ষাবিদ হুমায়ুন কবির, বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম প্রমুখ। আর পল্লীকবি হিসেবে বিখ্যাত কবি জসীমউদ্দিনের নামও এই জেলার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

প্রতিটা অঞ্চলে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বিদ্যমান থাকে। তেমনই ফরিদপুরের নিজস্ব সংস্কৃতি সমগ্র বাংলাদেশে জায়গা করে নিয়েছে৷ এখানকার লোকগীতি, লোকসংগীতি, পল্লীগীতি, বাউলগান যথেষ্ট সমৃদ্ধ। পল্লীকবি জসীমউদ্দিন, তাইজদ্দিন ফকির, আজিম শাহ, হাজেরা বিবি, বয়াতি আসাদুজ্জামান, দেওয়ান মোহন, দরবেশ কেতারদি শাহ, ফকির তীনু শাহ,আবদুর রহমানচিশতী, আঃ জালাল বয়াতি, ফকির আব্দুল মজিদ প্রমুখ ব্যক্তির হাত ধরে এখানকার লোকসংস্কৃতির এক ঐতিহ্যাবাহী পটভূমি তৈরি হয়েছে৷

9 comments

আপনার মতামত জানান