সেই প্রাচীনকাল থেকেই ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। আধুনিক ফুটবলে তার এত চাকচিক্য কিন্তু একদিনে আসেনি। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ব্যক্তিবিশেষের কিংবা কোনও বিশেষ খেলোয়াড়ের নিজস্ব চিন্তাভাবনা প্রথম কোনও ম্যাচে হয়তো খেলার পট পরিবর্তন করে দিয়েছে। পরবর্তীতে উক্ত ভাবনা বিবর্তিত হয়ে স্বীকৃত আইন রূপে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা ফিফার আইন বইতে স্থান পেয়েছে। এরকমই একটি আশ্চর্য ইতিহাস রয়েছে ফুটবলে লাল কার্ড এবং হলুদ কার্ড দেখানোর সূত্রপাত নিয়ে।
বর্তমান দিনে লাল এবং হলুদ কার্ড ছাড়া ফুটবলের কথা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু ফুটবলে লাল কার্ড এবং হলুদ কার্ডের সূত্রপাত খুব একটা প্রাচীনকালে হয়নি। ফুটবল খেলার সূচনাপর্ব থেকে এই কার্ড প্রথা চালু ছিল না। মূলত বিশ্বকাপ ফুটবলের কারণেই লাল এবং হলুদ কার্ডের ভাবনার সূত্রপাত ঘটে বলে জানা যায়। বিশ্বকাপ ফুটবলে সমগ্ৰ বিশ্বের সমস্ত ফুটবল-পারদর্শী দেশ অংশগ্রহণ করে। বিভিন্ন মহাদেশ থেকে বিভিন্ন ভাষা-ভাষী খেলোয়াড়রা একে অপরের বিরুদ্ধে ফুটবলে মেতে ওঠে। এক্ষেত্রে খেলা পরিচালক তথা ম্যাচ রেফারির ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের খেলোয়াড়দের তাদের মাতৃভাষায় কোনও কিছু বোঝানো মুশকিল ছিল। অর্থাৎ যোগাযোগের বিষয়ে একটি অসামঞ্জস্য ছিল। এই যোগাযোগের সমস্যা প্রকটভাবে দেখা দেয় ১৯৬৬ সালের ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের সময়। কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। এই ম্যাচে স্বাগতিক (Host) ইংল্যান্ড মুখোমুখি হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনার। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছিল। এই খেলাটি ক্ষণে ক্ষণে নাটকীয়তা, বিতর্ক এবং সমস্যায় জর্জরিত হয়ে উঠছিল। দুই দলের খেলোয়াড়রা ঘন ঘন ফাউল করছিলেন। খেলায় ঠিক ৩৬ মিনিটের মাথায় আর্জেন্টিনার অধিনায়ক আন্তোনিও রাত্তিন ইংল্যান্ডের একজন খেলোয়াড়ের উপর আঘাত করে বসেন অর্থাৎ ফাউল হয়। এই ম্যাচের জার্মান রেফারি রুডলফ ক্রেইটলেইন তাঁকে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এখানেই সৃষ্টি হয় যত সমস্যা। আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা জার্মান ভাষা জানতেন না। স্বাভাবিকভাবেই তারা রেফারির কথা এবং ইঙ্গিত বুঝতে পারেননি। সুতরাং, আন্তোনিও রাত্তিন তো মাঠ ছেড়ে যাননি, বরং রেফারির সঙ্গে ঝামেলা শুরু করে দেন। ঝামেলা এতটাই ভয়ঙ্কর হয়েছিল যে খেলা ১০ মিনিট বন্ধ ছিল। পরে পুলিশ এবং দোভাষী এসে এই সমস্যার সমাধান করেন এবং আন্তোনিও রাত্তিনকে মাঠ থেকে বাইরে নিয়ে যান। এই বিশ্বকাপে কেনেথ জর্জ অ্যাস্টনকে ফিফা রেফারি কমিটিতে নিয়োগ করা হয়েছিল এবং ১৯৬৬ ফিফা বিশ্বকাপের সকল রেফারির জন্য তিনি দায়বদ্ধ ছিলেন। সুতরাং, উক্ত ঘটনার পর জর্জ অ্যাস্টন এই ভাষাগত সমস্যা সামলে সুষ্ঠুভাবে খেলা পরিচালনা কীভাবে করা সম্ভব সে বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা শুরু করেন।
কেনেথ জর্জ অ্যাস্টন ছিলেন ইংল্যান্ডের একজন স্কুল শিক্ষক। তখন ইংল্যান্ডের পাঠ্যক্রমে খেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল। ইংল্যান্ডের স্কুলগুলোতে নিয়মিত ফুটবল খেলা হতো আর শিক্ষকদের রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হতো। ১৯৩৫ সালে অ্যাস্টন তাঁর স্কুলে রেফারির দায়িত্ব পালন করতেন। ১৯৩৬ সালে তিনি ইংল্যান্ড ফুটবলে রেফারি হিসেবে নিযুক্ত হন। যদিও কেনেথ জর্জ অ্যাস্টনের এই চিন্তাভাবনা শুরুর পিছনে শুধু যে ১৯৬৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের ঐ কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ দায়ী তা নয়। এর সঙ্গে ১৯৬২ বিশ্বকাপের চিলি বনাম ইতালির ম্যাচও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফুটবলের অঙ্গণে অনেক পিছিয়ে থাকা একটি দেশ চিলি যা কিনা সেবার বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ ছিল। আর এই ব্যাপারটাই ফুটবল দুনিয়ার গর্ব ইতালি মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে গ্রুপ পর্বে চিলি এবং ইতালির ম্যাচটিতে অনিবার্যভাবে এই রোষের প্রভাব চোখে পড়ে। এই ম্যাচে এত বেশি ফাউলের ঘটনা ঘটেছিল যে এখনও ফুটবল বিশ্বে এই ম্যাচটিকে ‘ব্যাটল অব সান্টিয়াগো’ (Battle of Santiago) নামে পরিচিত। ইংল্যান্ড-নিবাসী কেনেথ জর্জ অ্যাস্টনের কাঁধেই ম্যাচটি পরিচালনার দায়িত্ব ছিল। ম্যাচ শুরু হওয়ার মাত্র ১২ সেকেন্ডের মাথায় প্রথম ফাউল হয়। আবার ঠিক ১২ মিনিটের মাথায় ইতালির খেলোয়াড় জর্জ ফেরিনি দ্বিতীয়বার আরেকটি ফাউল করেন। রেফারি কেনেথ অ্যাস্টন ফেরিনিকে মাঠ থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও ইংরেজিতে বলার কারণে অ্যাস্টনের নির্দেশটি ইতালীয় ফেরিনি বুঝে উঠতে পারেনি। তাই তিনি মাঠ ছাড়তে চাইছিলেন না এবং সেই কারণে মাঠের মধ্যেই ভীষণ গোলযোগ বাধে। পরবর্তীতে পুলিশ এসে জোর করে মাঠ থেকে তাঁকে বের করে বাইরে নিয়ে যান।
১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপেও এই একইরকম ঘটনার অবতারণা হয় যা কেনেথ অ্যাস্টনকে ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপের সেই গোলযোগের ঘটনা স্মরণ করিয়েছিল। কেনেথ অ্যাস্টন ফুটবল খেলার মাঠে ভাষাগত এবং সংযোগস্থাপনের এই জটিল সমস্যা উপলব্ধি করেন এবং এই বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন। নানা ভাষা, নানা জাতি, নানা সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র এই বিশ্বকাপের আসর। এই খেলায় যদি ম্যাচ পরিচালকের ভাষা কিংবা ইঙ্গিত, নির্দেশ ইত্যাদি খেলোয়াড়রা বুঝতেই না পারেন, তাহলে ১৯৬২ এবং ১৯৬৬ সালের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবেই। এই সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যেই কোনও একটি অভিনব নিয়ম চালু করার কথা ভাবতে থাকেন কেনেথ। পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন যে, ম্যাচ শেষে তিনি ইংল্যান্ডের কেনসিংটন হাই স্ট্রিট দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন রাস্তায় ট্রাফিক সিগনালের আলো দেখে তাঁর মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে যায়। হলুদ আলোর মানে হল, ধীরে চলো বা সামলে নিয়ে চলো। আর লাল আলো মানে হল, থেমে যাও। অর্থাৎ খেলার মাঠে কোনও খেলোয়াড় যদি অল্প-স্বল্প খেলার নিয়ম ভঙ্গ করে, ফাউল করে তাকে প্রথমে হলুদ কার্ড দেখানো হয় যা একপ্রকার সতর্কবার্তার মত। আর কাউকে পরপর দুবার হলুদ কার্ড দেখানো হলে, রেফারি তাকে লাল কার্ড দেখান যার অর্থ মাঠ ছেড়ে চলে যাওয়া। কোনও খেলোয়াড় যদি বাজেভাবে ট্যাকেল করে কিংবা মারামারি করে অর্থাৎ অ-খেলোয়াড়সুলভ আচরণ বা প্রতিক্রিয়া করে তাহলে তাকে সরাসরি লাল কার্ড দেখানো হয় যার অর্থ সরাসরি মাঠের বাইরে বের করে দেওয়া। এছাড়াও আর একটি অলিখিত নিয়ম আছে। একজন খেলোয়াড় গোল করার জন্য অগ্রসর হওয়ার সময় সামনে যদি শুধুমাত্র প্রতিপক্ষের গোলকিপার থাকেন, তাকে ফুটবলের ভাষায় বলে ওয়ান টু ওয়ান সিচুয়েশন (One to One Situatiuon)। এই অবস্থায় ফাউল করলে সাধারণত সরাসরি লাল কার্ড দেখানো হয়। কোনও খেলোয়াড়কে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরে পাঠালে তার কোনও বিকল্প খেলোয়াড় পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে মাঠে থাকা দশজনকেই বিপক্ষের এগারজনের বিরুদ্ধে খেলতে হয়।
এই ভাবনাটি তিনি বিশ্বকাপ ফুটবলের মাঠে কার্যকরী করতে চেয়েছিলেন। তাই পরের দিনই তিনি ফিফাকে (FIFA) এই ভাবনার কথা জানান। ফিফা খুব সহজেই এতে শীলমোহর দেয় অর্থাৎ কেনেথের নতুন ভাবনা স্বীকৃতি পায়। ফলস্বরূপ, ১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপের আসরে প্রথম ম্যাচে লাল কার্ড ও হলুদ কার্ড ব্যবহার শুরু হয় যার দীর্ঘমেয়াদী ফলাফলে আজও উপকৃত হচ্ছে বিশ্ব ফুটবল।