লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী (Lakshminarayan Ray Chowdhury) ভারতের প্রথম পেশাদার ভ্রাম্যমাণ আলোকচিত্রীদের মধ্যে অন্যতম এবং একাধারে একজন দক্ষ চিত্রশিল্পী ছিলেন।
১৮৬৬ সালে ১১ জানুয়ারি কলকাতায় প্রখ্যাত সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের উত্তরপাড়া কোতরং শাখার রত্নেশ্বর রায়চৌধুরীর পরিবারে লক্ষীনারায়ণ রায়চৌধুরীর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম যদুনাথ রায়চৌধুরী এবং মায়ের নাম মাতঙ্গিনী রায়চৌধুরী। তাঁর দুই ভাইয়ের নাম হরিনারায়ণ রায়চৌধুরী এবং বৈকুণ্ঠনারায়ণ রায়চৌধুরী। তাঁদের পরিবারের আদি পুরুষ রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী উত্তরপাড়া শহরটির পত্তন করেন। লক্ষীনারায়ণ রায়চৌধুরী বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি পার্শি এবং আরবি ভাষাও জানতেন।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে লক্ষ্মীনারায়ণের সাথে পটলডাঙ্গার মুখোপাধ্যায় পরিবারের কন্যা অপূর্বময়ীর বিয়ে হয়। এই সময়ে লক্ষ্মীনারায়ণের সাথে কলকাতার ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যদের পরিচয় হয় এবং এর সাথে সাথেই তাঁর ছবি আঁকায় হাতেখড়ি ঘটে। এরপর তিনি কলকাতায় ব্রিটিশদের সঙ্গে দেখা করতে আসা বাহওয়ালপুরের আমিরের এক প্রতিনিধির মাধ্যমে বাহওয়ালপুরে রাজ্যের রাজ পরিবারের সদস্যদের ছবি আঁকার আমন্ত্রণ পান। সেখানে তাঁর কাজের প্রশংসা করে তাঁকে প্রশংসাপত্র প্রদান করা হয় যার মাধ্যমে তিনি ভারতের আরো নানান রাজপরিবারের সদস্যদের ছবি এঁকে রোজগার করার সুযোগ পান। এই সূত্রেই তিনি আফগানিস্তানের রাজপরিবারের সদস্যদের ছবি আঁকার আমন্ত্রণ পান। লক্ষ্মীনারায়ণের নাতি হাংরি আন্দোলনের পুরোধাপুরুষ মলয় রায়চৌধুরীর আত্মজীবনী অনুযায়ী বাহওয়ালপুরের সেই সময়ের দুটি ডাকটিকিটের প্রচ্ছদ লক্ষ্মীনারায়ণ এঁকেছিলেন।
আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে এবং তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ায় লাহোর শহরে লক্ষ্মীনারায়ণকে কিছুদিন বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়। তাঁদের সাতটি সন্তান ছিল যার মধ্যে ছেলেদের নাম ছিল প্রমোদ, সুশীল, রঞ্জিত, অনিল, সুনীল এবং বিশ্বনাথ এবং একমাত্র মেয়ের নাম ছিল কমলা। লক্ষীনারায়ণ তাঁর ছেলে রঞ্জিতের সাথে খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও স্যার রোনাল্ড রস-এর সহ-গবেষক কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মেয়ে অমৃতার বিয়ে দেন।
লাহোরে লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী মেয়ো কলেজ অফ আর্টসের অধ্যক্ষ এবং সাহিত্যিক রুডইয়ার্ড কিপলিং এর বাবা জন উড কিপলিংয়ের স্টুডিওর (studio) কর্মচারীর চাকরি পান। কিপলিং এর কাছে কাজ করার সময় তাঁর ফটোগ্রাফির প্রতি ঝোঁক বাড়ে। তিনি ফটোগ্রাফি শিখতে শুরু করেন। এরপর ১৮৮৬ সালে একটি বেলোলেন্স ক্যামেরা এবং ছবি তোলার সব সরঞ্জাম কিনে তিনি লাহোর শহরে স্থায়ী ব্যবসা শুরু করেন এবং সেই সংস্থার নাম রাখেন রায়চৌধুরী এন্ড কোম্পানি – ফটোগ্রাফার এন্ড আর্টিস্টস (Ray Chowdhury and Company – Photographer and Artists)। এই সংস্থার সদস্য ছিলেন তিনি এবং তাঁর ছেলেরা। প্রথমে তিনি কোন নির্দিষ্ট দোকান করতে পারেননি। যেসব রাজপরিবারের সদস্য এবং ধনী ব্যক্তিরা তাঁদের ছবি তোলাতে চাইতেন তিনি তাঁদের বাড়ি গিয়ে ছবি তুলে আসতেন। অনেক সময় সেই ফটো থেকে ছবি এঁকে দেওয়া হত। তাই তাঁকে শহরে ও গ্রামে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে বেড়াতে হত। আগে ছবি আঁকার জন্য লোকেদের ঘন্টার পর ঘন্টা শিল্পীর সামনে বসে থাকতে হত। কিন্তু ক্যামেরা আসার পর থেকে লক্ষ্মীনারায়ণ তাঁদের ছবি তুলে এনে তার থেকে ছবি এঁকে দিতেন। তাঁর ঘুরে ঘুরে কাজ করার জন্য তাঁর ছেলে মেয়েররা প্রথাগত শিক্ষা লাভ করতে পারেনি। তাঁকে কাজের সূত্রে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে যেমন আফগানিস্তানের কাবুল, কান্দাহার, পাকিস্তানের লাহোর, চিত্রাল, হুনজা, ফুলরা, মাকরান ইত্যাদি জায়গায়। তবে তিনি প্রতিবছর দুর্গাপূজা সময় উত্তরপাড়ায় ফিরে আসতেন।
এরপর লক্ষ্মীনারায়ণ দ্বারভাঙ্গার মহারাজের আমন্ত্রণে সপরিবারে পাবনায় যান। সেখানেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরীর ১৯৩৩ সালে ৮ নভেম্বর ৬৮ বছর বয়সে মৃত্যু হয়। লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরীর মৃত্যুতে তাঁর পরিবারকে খুবই সমস্যায় পড়তে হয় কারণ তাঁরা তাঁর রোজগারের উপরই নির্ভরশীল ছিলেন। তাঁদের অনেক আর্থিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে গিয়েও তাঁরা লক্ষ্মীনারায়ণের তৈরি ফটো স্টুডিও বর্তমানেও চালিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হন।
2 comments