ভারতের বিখ্যাত বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা এবং একজন খ্যাতনামা তাত্ত্বিক রাজনীতিবিদ মানবেন্দ্রনাথ রায় (Manabendra Nath Roy)। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠার পিছনে তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তাসখন্দে তাঁরই উদ্যোগে প্রথম ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে প্রাণিত এক অন্যতম দার্শনিকও ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায় । আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সম্মেলনের অন্যতম সভ্য ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ যিনি স্তালিনের উত্থানের সময় মূলধারার কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথ ছেড়ে স্বাধীন বৈপ্লবিক রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৪০-এর দশকে বিনয় রায়ের প্রতিষ্ঠিত ‘র্যাডিকাল ডেমোক্রেটিক পার্টি’র একেবারে সামনের সারির নেতৃবৃন্দের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি।
১৮৮৭ সালের ২১ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণার আড়বেলিয়া গ্রামে এক শাক্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তাঁর বাবা দীনবন্ধু ভট্টাচার্য পেশায় আড়বেলিয়া গ্রামের ইংরেজি বিদ্যালয়ের হেডপণ্ডিত ছিলেন এবং তাঁর মা বসন্তকুমারী দেবী ছিলেন সম্পর্কে দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের ভাইঝি। ইতিহাস থেকে জানা যায় তাঁদের পারিবারিক পেশা ছিল পৌরোহিত্য। তাঁদের পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলার সোনাটিকারি গ্রামে। অনেকে বলে থাকেন দেবী ক্ষেপুতেশ্বরীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে বংশের প্রথম পুরুষ রমাকান্ত প্রথম খেপুতে চলে আসেন। মানবেন্দ্রনাথের বাবা দীনবন্ধুর জন্মও হয়েছিল খেপুত-এর উত্তরবাড় গ্রামে। কিছুদিন পৌরোহিত্য করার পরে এই বৃত্তি ছেড়ে তিনি উত্তর ২৪ পরগণায় চলে এসেছিলেন। দীনবন্ধু এবং বসন্তকুমারীর আট সন্তানের মধ্যে চতুর্থ সন্তান ছিলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ওরফে মানবেন্দ্রনাথ রায়।
আড়বেলিয়া গ্রামের স্থানীয় পাঠশালাতেই মানবেন্দ্রনাথের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়। ১৮৯৮ সালে তাঁদের পরিবার কোদালিয়ায় চলে আসেন এবং এখানকার হরিনাভি অ্যাংলো-সংস্কৃত বিদ্যালয়ে ভর্তি হন মানবেন্দ্রনাথ রায় । এই বিদ্যালয়েই ১৯০৫ সাল পর্যন্ত তাঁর বাবা দীনবন্ধু শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর বয়সের তুলনায় একটু বেশিই লম্বা ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ। ফলে কৈশোরকাল থেকেই খেলাধূলা এবং শরীরচর্চার প্রতি নিবিষ্ট হয়ে পড়েন তিনি। এরপরে ঋষি অরবিন্দর অধীনে তিনি ন্যাশনাল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিন এখানে পড়াশোনা করার পরে মানবেন্দ্রনাথ চলে যান বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে প্রকৌশলীবিদ্যা এবং রসায়ন পড়তে। বেশিরভাগ সময়েই নিজের উদ্যোগেই জ্ঞানার্জন করেছেন তিনি।
উনিশ শতকের শেষ দিকে বঙ্কিমচন্দ্র এবং বিবেকানন্দের লেখাপত্র পড়ে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ বৈপ্লবিক আন্দোলন এবং জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত হচ্ছিল। এই দুজনের লেখা পড়ে মানবেন্দ্রনাথও গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন। তাছাড়া বিনায়ক দামোদর সাভারকরের চিন্তা ও দর্শনও তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল। বঙ্কিমের লেখা থেকেই তিনি জানতে পেরেছিলেন যে ধর্ম আসলে মানুষকে জগৎ ও জীবন থেকে বিবিক্ত করে না, বরং প্রকৃত ধর্ম মানুষকে অপর মানুষের কল্যাণার্থে কাজের জন্য প্রণোদিত করে। স্বামী বিবেকানন্দের লেখায় তিনি পড়েছিলেন এই একই সামাজিক হিতার্থ চিন্তার কথা এবং স্বামীজির মাধ্যমেই পাশ্চাত্য যে কোনো সংস্কৃতির তুলনায় হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতিকে মান্যতা দিতে শিখেছিলেন মানবেন্দ্রনাথ। তাঁর এক খুড়তুতো ভাই এবং বাল্যবন্ধু হরিকুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে স্বাধীন চিন্তকদের একটি সভা গড়ে তোলেন তিনি যেখানে উপস্থিত ছিলেন সাতকড়ি ব্যানার্জি এবং তাঁর ভাইয়েরা, শৈলেশ্বর এবং শ্যামসুন্দর বসু প্রমুখ বিখ্যাত সব ব্যক্তিবর্গ। পরে দেওঘর থেকে এসে যোগ দেন মানবেন্দ্রনাথের আরেক খুড়োতুতো ভাই ফণি এবং হরিকুমার চক্রবর্তীর খুড়তুতো ভাই নরেন্দ্র চক্রবর্তী। ফণি এবং নরেন্দ্র দেওঘরে বারীন ঘোষের স্কুলে পড়াশোনা করতেন। তাঁদের এই দলে তথা সমিতিতে প্রায়ই এসে উপস্থিত হতেন বেদজ্ঞ মোক্ষদাচরণ সামাধ্যায়ী যিনি গোপনে চুঁচুড়ায় অনুশীলন সমিতির একটি শাখা স্থাপন করেছিলেন। ১৯০৫ সালের জুলাই মাসে বঙ্গভঙ্গ ঘোষিত হলে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় বিরাট গণ আন্দোলন সংঘটিত হয়। সেই সময় থেকেই জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা গড়ে উঠতে থাকে মানবেন্দ্রনাথের মধ্যে। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সভা-সমিতি এবং পদযাত্রা আয়োজন করার জন্য স্কুল থেকে বিতাড়িত হন মানবেন্দ্রনাথ এবং হরিকুমার চক্রবর্তী। এরপরেই সক্রিয়ভাবে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে যোগ দেবার জন্য কলকাতায় চলে আসেন দুজনে এবং অনুশীলন সমিতির সদস্য হন। মোক্ষদাচরণের নেতৃত্বে ১৯০৭ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রথম সমিতির জন্য অর্থসংগ্রহ করেন মানবেন্দ্রনাথ। এই কাজ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি এবং সেই সময় তাঁর কাছে বারীন ঘোষের লেখা দুটি নিষিদ্ধ বই পাওয়া যায়। তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা উঠলে ব্যারিস্টার জে. এন. রায় এবং উকিল প্রমথনাথ মুখার্জীর সহায়তায় জামিনে মুক্তি পান তিনি। আদালতে একজন নিরপরাধ ছাত্র এবং সমাজসেবী হিসেবে প্রমাণিত হন তিনি। বারীন ঘোষের কর্তৃত্বপূর্ণ মনোভাবে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সংগ্রামের নতুন পথ খুঁজছিলেন মানবেন্দ্রনাথ। এই সময়েই লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে মারার জন্য বারীন যতীন্দ্রনাথ দাস ওরফে বাঘা যতীনকে দার্জিলিং-এ পাঠিয়েছিলেন এবং যতীনকে সহায়তা করা ও তাঁর উপর নজরদারি করার জন্য আলাদা করে প্রফুল্ল চাকী ও চারুচন্দ্র চক্রবর্তীকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু উভয়েই ফিরে এসে বাঘা যতীনের প্রশংসা করেন। এতে বারীন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলে মানবেন্দ্রনাথ তাঁকে যোগ্য নেতৃত্বের আসন থেকে সরিয়ে দেন। হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলার সময়েই মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে বাঘা যতীনের আলাপ হয়। অন্যান্য অনেক বিপ্লবীর মতো মানবেন্দ্রনাথও মনে করতেন যে সক্রিয় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই দেশ স্বাধীন করা সম্ভব। তাই এই লক্ষ্যপূরণের জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকের প্রতিপক্ষ হিসেবে কাইজার উইলিয়াম শাসিত জার্মানিকে কাজে লাগানোর কথা ভেবেছিলেন তাঁরা। অর্থ এবং অস্ত্র সংগ্রহের জন্য জার্মানির সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন বেশ কিছু বিপ্লবী। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন এবং জার্মানি দুই শক্তিশালী বিবদমান পক্ষে পরিণত হয়। বার্লিনের ইণ্ডিয়ান রিভলিউশনারি কমিটি জার্মানির সরকারের কাছে আবেদন জানায় যাতে ভারতে যে ব্রিটিশ-বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম সংঘটিত হচ্ছে তাতে জার্মানি যেন সাহায্য করে। ঐ বছরের শেষ দিকেই খবর আসে যে ভারতীয় বিপ্লবীদের ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের জন্য অর্থ এবং অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতে জার্মানি রাজি হয়েছে। এই অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই নরেন ভট্টাচার্য ওরফে মানবেন্দ্রনাথ প্রথমে জাভায় পাড়ি দেন, কিন্তু দুই মাস সেখানে থাকার পরেও খুব বেশি অর্থ বা অস্ত্র জোগাড় করতে পারেননি তিনি। ১৯১৫ সালে স্থায়ীভাবে জার্মানির উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়ার জন্য ভারত ছাড়েন তিনি। মাত্র ২৬ বছর বয়সে এই দুঃসাহসিক কাজ তাঁকে ভারতের বিপ্লবীমহলে সুপরিচিত করে তোলে। তাঁদের পরিকল্পনা ছিল ইন্দোনেশিয়াতে প্রথমে একটি অস্ত্রশস্ত্র পূর্ণ জার্মান জাহাজ এসে ভিড়বে এবং এই অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই বিপ্লবীরা ঠিক করেছিলেন উড়িষ্যা আর আন্দামানে সশস্ত্র আক্রমণ করবেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়, জাহাজ আসে না। শেষ মুহূর্তে জার্মান কনসাল জেনারেল রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান আর এই পরিকল্পনার কথা ভারতে ব্রিটিশরা জানতে পারায় প্রবল ধরপাকড় শুরু হয়। কিন্তু এই কাজে অসফল হলেও আশা ছিল মানবেন্দ্রনাথের । তাই তিনি ইন্দোনেশিয়া ছেড়ে জাপানের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। জাপানে চিনা জাতীয়তাবাদী নেতা সান ইয়াৎ সেনের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। কিন্তু সান ইয়াৎ সেন ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামে সহায়তা করতে অসম্মত হন। এর পরের বছরই নকল কাগজপত্র সংগ্রহ করে আমেরিকার সদানফ্রান্সিসকো হয়ে নিউ ইয়র্কে পৌঁছান মানবেন্দ্রনাথ রায়। নিউ ইয়র্কেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় বিখ্যাত ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা লালা লাজপত রাইয়ের। জার্মানি থেকে অস্ত্র পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় ১৯১৭ সালে মেক্সিকো চলে যান তিনি এবং সেখানে সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। মেক্সিকান সোশ্যালিস্ট পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন মানবেন্দ্রনাথ এবং এই পার্টিই রাশিয়ার বাইরে প্রথম ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি। ক্যালিফোর্ণিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে থাকার সময় তিনি রেভারেণ্ড সি. এ. মার্টিন ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন এবং কিছুদিন পরে বিপ্লবী ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়ের পরামর্শে তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায় এই ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। সেই থেকেই নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য থেকে তিনি পরিচিত হন মানবেন্দ্রনাথ রায় ওরফে এম. এন. রায় নামে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সম্মেলনের সভ্য হয়েছিলেন তিনি, এছাড়া কমিন্টার্নের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। লেনিন তাঁর লেখার সমাদর করতেন।
লেনিনের নির্দেশেই উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে ১৯২০ সালে তিনি গড়ে তোলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি। লেনিনের মৃত্যুর পরে আন্তর্জাতিক স্তরে স্তালিনের উত্থান ঘটে, স্তালিনের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে ১৯২৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে মানবেন্দ্রনাথ রায় জার্মানিতে চলে যান। দীর্ঘ ১৬ বছর পরে দেশে ফিরে আসা মাত্রই ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি এবং বিচারে ছয় মাসের কারাবাস করতে হয় তাঁকে। ভারতে কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট নেতাদের আদর্শগত বিরোধ চরমে উঠলে মানবেন্দ্রনাথ রায় ‘নিও হিউম্যানিজম’ নামে নতুন একটি তত্ত্ব তৈরি করেন এবং এই তত্ত্ব প্রচারের জন্য গড়ে তোলেন র্যাডিকাল ডেমোক্রেটিক পার্টি।
মানবেন্দ্রনাথ রায়ের একটি বিখ্যাত বইয়ের নাম ‘রিজন, রোমান্টিসিজম অ্যাণ্ড রেভলিউশন’।
১৯৫৪ সালে ২৫ জানুয়ারি ৬৬ বছর বয়সে দেরাদুনে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মৃত্যু হয়।
One comment