ভারতবর্ষের একজন কিংবদন্তি ব্যায়ামবীর মনোহর আইচ (Manohar Aich)। তাঁকে ভারতীয় বডিবিল্ডিংয়ের জনক বলা হয়ে থাকে। উচ্চতায় খাটো ছিলেন বলে একসময় অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু নিজের অদম্য জেদ, কঠোর অনুশীলন এবং অধ্যাবসায়ের ফলে সুঠাম এবং পেশিবহুল শরীর বানিয়ে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সমগ্র ভারতবর্ষকে। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় ভারতীয় বডিবিল্ডার যিনি মিস্টার ইউনিভার্স খেতাবের অধিকারী হন। তাঁর উচ্চতার জন্য অনেকেই তাঁকে ‘পকেট হারকিউলিস’ বলে সম্বোধন করতেন। ঔপনিবেশিক অত্যাচারের পক্ষে কথা বলায় এক ব্রিটিশ অফিসারকে চড় মেরে কারাবাসও করেছিলেন তিনি। তাঁর সুস্বাস্থ্যের পিছনে যে কেবল বাঙালি চিরাচরিত খাদ্যেরই অবদান রয়েছে তাও স্বীকার করতে কখনও কুন্ঠিত হননি আইচ। জনপ্রিয় হয়ে যাওয়ার পর রাজনীতিতে যোগদান করে ভারতীয় জনতা পার্টির হয়ে নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি।
১৯১২ সালের ১৭ মার্চ বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার ধামতী গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে মনোহর আইচের জন্ম হয়। তাঁর বাবা মহেশচন্দ্র আইচ এবং তাঁর মা চপলা সুন্দরী দেবী দুজনেই ছিলেন অত্যন্ত সহজ সরল এবং সাদাসিধে প্রকৃতির মানুষ, কিন্তু তাঁদের সেরকম পুঁথিগত বিদ্যা ছিল না। ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন দৈহিক শক্তি-সম্পর্কিত খেলা যেমন কুস্তি, ভারোত্তোলন ইত্যাদির প্রতি ভীষণই আগ্রহী ছিলেন মনোহর আইচ। এছাড়া ফুটবল খেলাও খুব পছন্দ করতেন তিনি। বারো বছর বয়সে হঠাৎ কালাজ্বরের আক্রমণে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিল। ফলে শারীরিক সক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য তিনি বিভিন্ন রকম ব্যায়ামের কঠোর অনুশীলন চালাতে থাকেন। পুশ-আপ, স্কোয়াট, পুল-আপ, লেগ রেইজ ইত্যাদি নানা প্রকার শরীরচর্চা করা শুরু করেছিলেন তিনি তখন থেকেই। সেই বয়সেই তিনি এইসব ক্যাসথেনিক্স বা ভারোত্তলন ব্যায়ামের প্রতিটি সেটে প্রায় ১০০টি করে রিপ সম্পূর্ণ করতে পারতেন। মনোহর আইচের স্ত্রী ছিলেন যূথিকা আইচ। তাঁদের দুই পুত্র এবং দুই কন্যা ।
বিদ্যালয় স্তরের শিক্ষালাভের জন্য তিনি বাংলাদেশের ঢাকা শহরে অবস্থিত জমিদার কিশোরীলাল রায়চৌধুরী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কে এল জুবিলি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে স্কুলে পড়ার পাশাপাশি শরীরচর্চা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। একদিকে যেমন তিনি পড়াশোনা করতেন, একইসঙ্গে রূপলাল ব্যায়াম সমিতিতেও যেতেন নিয়মিত শরীরচর্চা করবার জন্য। খুব অল্পবয়স থেকেই তিনি কঠিন অনুশাসনের মধ্যে নিজেকে বেঁধেছিলেন। আসলে একদল কুস্তিগীরকে পেশি সঞ্চালন করতে দেখে তাঁর প্রবল ইচ্ছে হয়েছিল ব্যায়ামবীর হওয়ার। সেই জন্যেই তিনি শরীরচর্চা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় মনোহরের বাবা অসুস্থ হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেললে পরিবারের আর্থিক সহায়তার দায়িত্ব কিছুটা তাঁর কাঁধে এসে পড়েছিল। ফলে তিনি তাঁর জন্মস্থান এবং কুমিল্লা জেলার অন্যান্য স্থানে বিভিন্ন মেলা বা ইভেন্টে শক্তিপ্রদর্শনের খেলা দেখিয়ে অর্থ রোজগার করা শুরু করেন। ঢাকার জুবিলি স্কুলে প্রখ্যাত জাদুকর পি সি সরকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল আইচের। একঝলক দেখেই জাদুকর সরকার আইচের প্রতিভাকে চিনে নিয়েছিলেন এবং সেই বেঁটে-খাটো ছেলেটিকে প্রস্তাব করেছিলেন তাঁর সঙ্গে যোগদান করতে। এরপর সরকার এবং আইচের যুগলবন্দীতে যে শো-এর সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তা অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ধানবাদে তাঁদের দুজনের অনুষ্ঠান ‘ফিজিক অ্যান্ড ম্যাজিক’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত হয়। পি সি সরকারের হাতের কৌশল এবং আইচের অবিশ্বাস্য শক্তিপ্রদর্শন মুগ্ধ করে রাখত দর্শককে। দাঁত দিয়ে ইস্পাত বাঁকানো, ঘাড় দিয়ে বর্শা বাঁকানো, ১৫০০ পাতার বই ছিঁড়ে অর্ধেক করে ফেলা, ৩৫০ কেজি ওজন নিয়ে স্কোয়াট করা ইত্যাদি নানারকম শক্তিপ্রদর্শনের নমুনা তিনি পেশ করতেন জনগণের সামনে। নিয়মিত ঘাড় দিয়ে বর্শা বাঁকানোর খেলা দেখানোর ফলে তাঁর ঘাড়ে একটি স্থায়ী দাগ পড়ে গিয়েছিল।
এরপর ১৯৪২ সালে মনোহর আইচ একজন এয়ারম্যান হিসেবে রয়্যাল এয়ার ফোর্সে (RAF) যোগদান করেন। সেখানে পেশি নির্মাণের সাধনা শুরু করেন তিনি। আরএএফ-এর একজন ব্রিটিশ অফিসার রিউব মার্টিন তাঁকে ভারোত্তলনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কঠোর ব্যায়াম এবং জোরালো প্রশিক্ষণের ফলে এমনই একটি শরীর গঠন করেছিলেন তিনি যে সমপদস্থ এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রশংসা অর্জনের পাশাপাশি, তাঁদের ঈর্ষার কারণও হয়েছিলেন। প্রাথমিক পর্বে তাঁর ২৩ কোমররেখা-সহ বুকের পরিমাপ ছিল ৫৪ ইঞ্চি। যা তাঁর শরীরকে ইংরেজি V-এর মত আকৃতি প্রদান করেছিল। একটি ছোটোখাটো বালকের পালোয়ানে রূপান্তরিত হওয়ার এই ঘটনা সত্যই অভূতপূর্ব ছিল।
মনোহর আইচ আরএএফ-এ থাকাকালীন ১৯৪২ সালে ভারতবর্ষের চারদিকে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়। সেসময় আরএএফ-এর একজন ব্রিটিশ অফিসারকে চড় মেরে বসেন মনোহর আইচ৷ এই কাজের জন্য তাঁকে কারাবাসও করতে হয়েছিল। অবশ্য জেলার খুব সদয় ব্যক্তি হওয়ায় কারাগারের মধ্যেও তিনি ভারত্তোলনের প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখতে পেরেছিলেন। ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি শারীরিক কসরত করতেন। কখনও কখনও কোন সরঞ্জাম ছাড়াই দিনে বারো ঘন্টা শরীরচর্চা করতেন তিনি। জেল কর্তৃপক্ষ তাঁর নিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে আইচের জন্য বিশেষ খাদ্যের বন্দোবস্ত করেছিল৷ এরপর তাঁকে আলিপুর কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। মুক্তি পাওয়ার পরে আইচ সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি কলকাতা শহরেই স্থায়ীভাবে থাকবেন। সেই সময়টা তাঁর কাছে ছিল সংগ্রামের সময়। বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি নিজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি একবারও। সেই সময়ে শিয়ালদহ স্টেশনে নারকেল বিক্রিও করেছিলেন তিনি। কাজে বেরোনোর আগে প্রত্যহ যোগেশ্বর পালের আখড়া থেকে ঘুরে যেতেন মনোহর আইচ।
১৯৫০ সালে ৩৮ বছর বয়সে মনোহর আইচ মিস্টার হারকিউলিস প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করেন। ফলত, তাঁকে ‘পকেট হারকিউলিস’ নামে সম্বোধন করতে থাকেন সাধারণ মানুষ। সেবছরই ইংল্যান্ডে ন্যাশনাল অ্যামেচার বডি-বিল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন (NABBA) গঠিত হয়। ১৯৫১ সালে লন্ডনে আয়োজিত মিস্টার ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় মনোহর আইচ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন, সেবারে প্রথম হয়েছিলেন আরেক বিখ্যাত বাঙালি ব্যায়ামবীর মনতোষ রায়। প্রথম প্রচেষ্টায় সফল না হলেও তৎক্ষণাৎ হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসতে চাননি আইচ। বরং লন্ডনে থেকে পরবর্তী মিস্টার ইউনিভার্সের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন তিনি। অবশ্য সৌভাগ্যবশত তখন ব্রিটিশ রেলওয়েতে চাকরি পেয়ে গিয়েছিলেন মনোহর আইচ। চাকরির পাশাপাশি প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি এবং মাঝেমাঝে বডিবিল্ডিং-এর শো-তেও অংশগ্রহণ করতে থাকেন। অবশেষে অনেক কঠোর পরিশ্রম এবং দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের ফল তিনি পেয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ১৭ মার্চ মিস্টার ইউনিভার্সের মুকুট উঠেছিল তাঁর মাথায়। কাকতালীয়ভাবে সেদিন ছিল তাঁর জন্মদিন। সেসময় তাঁর বুকের পরিমাপ ছিল ৫৪ ইঞ্চি এবং কোমরের মাপ ছিল ২৩ ইঞ্চি। ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী উভয়েই তাঁকে বীরের মতো স্বাগত জানিয়েছিলেন। এরপরেও মনোহর আইচ মিস্টার ইউনিভার্স হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু ১৯৫২-এর গৌরব আর পুনরুদ্ধার করতে পারেননি তিনি। ১৯৫৫ সালে মিস্টার ইউনিভার্সে তৃতীয় এবং ১৯৬০ সালে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি। এছাড়াও ১৯৫১ সালে নয়াদিল্লিতে, ১৯৫৪ সালে ম্যানিলায় এবং ১৯৫৮ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে পেশি প্রদর্শনে স্বর্ণপদক অর্জন করেছিলেন আইচ। এশিয়ান বডিবিল্ডিং চ্যাম্পিয়নশিপে শীর্ষস্থান অধিকার করেছিলেন তিনি। এসব ছাড়াও বিভিন্ন বডিবিল্ডিং ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেন তিনি৷ একবার ২৭৫ পাউন্ড টেনশনের স্প্রিং ছিঁড়ে স্প্রিং পুলিং ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন মনোহর আইচ।
১৯৬০-এর দশকে আইচ একটি ভ্রাম্যমাণ সার্কাসের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সপরিবারে ঘুরে ঘুরে পারফর্ম করতেন। তাঁর নমনীয় শরীরকে তিনি সঙ্গীতের সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আশ্চর্যজনক পেশি নৃত্যের মাধ্যমে দর্শকদের বিনোদন দিতেন তিনি। ২০০৩ সালে ৮৯ বছর বয়সে শেষ শো করেছিলেন মনোহর আইচ।
বডিবিল্ডিং ছাড়াও জীবনের অনেকটা পেরিয়ে এসে জনপ্রিয় একটি মুখ হয়ে ওঠার পর তিনি রাজনীতিতেও পদার্পণ করেছিলেন। ১৯৯১ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি দলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মনোহর আইচ এবং এক লক্ষ তেষট্টি হাজার ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান লাভ করেন। একটা সময় পর থেকে অন্যান্য বডিবিল্ডারদের ট্রেনিং দেওয়া শুরু করেছিলেন তিনি। তাঁর কৃতী ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আটবারের জাতীয় বডিবিল্ডিং চ্যাম্পিয়ন সত্য পাল এবং প্রাক্তন মিস্টার ইউনিভার্স প্রেমচাঁদ ডোগরা। তাঁর দুই ছেলে বিষ্ণু আইচ এবং মনোজ আইচ বাড়িতে যে জিমখানা তৈরি করেছিলেন, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সেখানে প্রশিক্ষণ দিতেন মনোহর আইচ। তরুণ বডিবিল্ডারদের প্রতি সর্বদা নজর রাখতেন তিনি। জিমের আধুনিক যন্ত্রপাতির তুলনায় তিনি প্রাচীন ভারতীয় শরীরচর্চার পদ্ধতিগুলিকেই বেশি পছন্দ করতেন।
মনোহর আইচ তাঁর সুস্বাস্থ্যের জন্য বিশুদ্ধ বাঙালি সাধারণ খাবারকে কৃতিত্ব দিয়েছেন অকুণ্ঠিত চিত্তে। তাঁর খাদ্যের তালিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দুধ, ফলমূল, শাক-সব্জি, ভাত, ডাল ও মাছ। খেতেনও খুব মেপে। ১০৪ বছর বয়সেও মনোহর আইচ শরীরচর্চা করে গিয়েছেন। ২০১১ সালে একটি স্ট্রোকের কারণে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেও তাঁর শারীরিক সক্ষমতা তখনও অটুট ছিল।
অবশেষে ২০১৬ সালের ৫ জুন ১০৪ বছর বয়সে বাগুইআটির বাসভবনে মনোহর আইচের মৃত্যু হয়।