ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক

ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক

ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক (Max Planck) একজন স্বনামধন্য তাত্ত্বিক পদার্থবিদ এবং কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের জনক। বিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের জন্য তিনি ১৯১৮ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর সম্মানে জার্মানির বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান কাইজার উইলহেলম সোসাইটির নাম পাল্টে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সোসাইটি রাখা হয়।

তাঁর পুরো নাম ম্যাক্স কার্ল আর্নেস্ট লুডউইগ প্ল্যাঙ্ক। ১৮৫৮ সালের ২৩ এপ্রিল জার্মানির কিয়েল শহরের এক ঐতিহ্যশালী পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পিতা জন জুলিয়াস প্ল্যাঙ্ক কিয়েল মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর মা এম্মা পেটজিগ ছিলেন জুলিয়াস প্ল্যাঙ্কের দ্বিতীয় স্ত্রী।

ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক পরিবারের ষষ্ঠ সন্তান ছিলেন। তাঁর ছোটবেলায় যুদ্ধ খুবই সাধারণ ঘটনা ছিল এবং প্রুশিয়ান এবং অস্ট্রিয়ান সৈন্যদলের পদযাত্রা ও যুদ্ধের মধ্যেই তিনি বেড়ে ওঠেন। তাঁর যখন নয় বছর বয়স  তখন তাঁর পিতা মিউনিখের বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তখনই ম্যাক্সিমিলিয়ন জিমনেসিয়ামে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি হন। সেখানে তাঁর পরিচয় হয় হার্মান মুলারের (Hermann Müller) সাথে, যিনি তাঁকে গণিত শাস্ত্রের সাথে সাথে বলবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানও পড়াতেন। তাঁর কাছেই প্ল্যাঙ্ক প্রথম শেখেন যে, শক্তি কখনোই ধ্বংস করা যায় না এবং এই তথ্য তাঁর পরবর্তী কাজকর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। ম্যাক্স ছোটবেলা থেকেই অংকে বাকিদের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষ ছিলেন। তাই তাঁর শিক্ষক তাঁকে গণিতবিদ্যা ছাড়াও জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বলবিদ্যা পড়ানোর  সিদ্ধান্ত নেন। পড়াশোনার বাইরে সংগীতচর্চায় তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। খুব অল্প বয়সেই তিনি কণ্ঠসঙ্গীত, পিয়ানো, অরগ্যান এবং সেলোয় দক্ষতা অর্জন করেন। মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি স্নাতক হন এবং সপরিবারে মিউনিখে চলে যান পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার জন্য। ১৮৭৭ সালে তিনি বার্লিনের ফ্রেড্রিচ উইলহেলম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছরের জন্য পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষা লাভ করতে আসেন। সেখানেই তিনি কারচফ্ ও হেলমটজ্-এর সাহচর্যে আসেন। এরপর ক্লসিয়াসের গবেষণাপত্রের ওপর তিনি তাপগতিবিদ্যা নিয়ে গবেষণা আরম্ভ করেন। ১৮৭৮ সালে তিনি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৮৭৯ সালে তাপগতিবিদ্যার ওপর গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ১৮৭৯ সালে মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি এবং ১৮৮০ সালে ‘হ্যবিলিটেশন’ (habilitation) ডিগ্রি লাভ করেন। তারপরই তিনি মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৮৮৫ সালে কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং পরবর্তীকালে ১৮৮৯ সালে বার্লিনের ফ্রেড্রিচ উইলহেলম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। সেখানেই তিনি গণিত বিদ্যা এবং পদার্থবিদ্যার সংমিশ্রণে তৈরি এক অন্য জগতে প্রবেশ করেন। সেই সময় তাঁর ন-জন ছাত্রকে দেওয়া বক্তৃতামালা পরবর্তীকালে বিশ্ব বিখ্যাত হয় এবং বিভিন্ন ভাষায় বইয়ের আকারে মুদ্রিত হয়। সেই নয় ছাত্রের মধ্যে দুজন পরে ‘নোবেল’ পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯০০ সালে মুদ্রিত ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের গবেষণাপত্র পদার্থবিজ্ঞানের দুনিয়ায় এক নতুন পথের সূচনা করে।

১৮৯৪ সাল থেকে প্ল্যাঙ্ক কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের (black body radiation) উপর গবেষণা শুরু করেন। সমস্যাটি অবশ্য ১৮৫৯ সালে কিরচফ্ দিয়েছিলেন – কোনও কৃষ্ণবস্তুর তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ কিভাবে বিকিরণের কম্পাঙ্ক ও বস্তুটির তাপমাত্রার উপর নির্ভরশীল। এর উত্তরের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা করা হলেও তাত্ত্বিকভাবে এমন কিছু বলা যায়নি যাতে বিকিরণের চরিত্র নির্ণয় করা যায়। এই সময় ওয়েইন (Wein) নামক একজন বিজ্ঞানী একটি সূত্র দেন কিন্তু তা শুধুমাত্র উচ্চ কম্পাঙ্কের বিকিরণের ক্ষেত্রে কাজ করত কিন্তু নিম্ন কম্পাঙ্কের ক্ষেত্রে কাজ করত না। অন্যদিকে রেইলি-জিন্স (Rayleigh- Jeans) -এর সূত্র শুধুমাত্র নিম্ন কম্পাঙ্কের জন্য উপযুক্ত ছিল। ১৮৯৯ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক প্রথম এই সমস্যার সমাধান করতে পারেন। উনি ওয়েইনের সূত্রেই কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে সৃষ্টি করেন আরেকটি সূত্র যা ওয়েইন-প্ল্যাঙ্ক সূত্র নামে পরিচিত হয় তবে সেটি ঠিক করে কাজ করেনি। পরে ১৯০০ সালে অন্য পদ্ধতিতে নতুন একটি সূত্র আবিষ্কার করেন যার নাম হয় ‘প্ল্যাঙ্ক ব্ল্যাক বডি রেডিয়েশন ল’। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ পরীক্ষার তথ্য অনুসারে তিনি বলেন যে শক্তি অবিচ্ছিন্নভাবে যে কোন পরিমাণে নির্গত হয় না এবং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের গুণিতক হিসেবে নির্গত হয়, আর এই নির্দিষ্ট পরিমাণের সর্বনিম্ন একককে কোয়ান্টাম (বহুবচনে কোয়ান্টা) বলে বর্ণনা করেন। প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টা সম্পর্কিত এই ধারণা প্ল্যাঙ্ক পোস্টুলেট (Planck postulate) নামে পরিচিত। এই গবেষণাপত্রেই জন্ম হয় প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক বা ‘planck’s constant (h)’- এর। এই সূত্র অনুসারে শক্তিকে যদি কম্পন দিয়ে ভাগ করা যায় সেই মান সবক্ষেত্রেই সমান এবং ধ্রুবকের এর মান হল ৬.৬২ * ১০^-৩৪ Js। এর মানে এই দাঁড়ায় যে প্রতিটি ‘কোয়ান্টা’ বা পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় ‘কোয়ান্টা ফোটন’ -এর একটি নির্দিষ্ট শক্তি আছে। এই তথ্য সেই মুহূর্তে এতটাই অভিনব যে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক নিজেও পরে বলেছেন যে এই আবিষ্কার এক “লাকি ইনটুইশন”।

এই আবিষ্কার পদার্থবিদ্যার ধারায় এক নতুন বিভাগের জন্ম দেয় – কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা। কোয়ান্টাম তত্ব ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের সঙ্গে খাপ খায়নি। এই গবেষণা পত্রটি বিখ্যাত ‘এনাল এন্দর ফিজিক’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়‌। পরবর্তীকালে আইনস্টাইনের ফটোইলেকট্রিক এফেক্ট-এর গবেষণাতেও উল্লেখ পাওয়া যায়। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের সংগীতচর্চার এক সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন এবং ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি এইসময় আইনস্টাইনের গবেষণাপত্রের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। বার্লিনে ‘প্রুশিয়ান একাডেমি’র ‘ডিন’ হওয়ার দরুন তিনি আইনস্টাইনকে অধ্যাপক পদে নিযুক্ত করেন।

এই গবেষণাপত্রের সুবাদে পদার্থবিদ্যায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হওয়ায় তিনি ১৯১৮ সালে ‘নোবেল’ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯২৬ সালে ‘রয়্যাল সোসাইটি’র বিদেশি সদস্যপদে মনোনীত হন এবং ১৯২৮ সালে ‘কোপলি মেডেল’ লাভ করেন। ১৯২৬ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

১৮৮৭ সালে তিনি মেরি মেরেককে বিয়ে করেন এবং চার সন্তানের জন্ম দেন। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের ব্যক্তিগত জীবন অত্যন্ত দুঃখের ছিল। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রী এবং সন্তানদের মৃত্যু দেখে গেছিলেন। তাঁর প্রথম স্ত্রী যক্ষা রোগে মারা যান, পরবর্তীকালে বড় ছেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে‌ মারা যান। দুই মেয়েই সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান এবং ছোট ছেলে হিটলারের বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র করার কারণে ফাঁসি হয়। ১৯১১ সালে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন এবং এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বহু ইহুদি অন্যত্র চলে যান। ১৯৪৪ সালে মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় তাঁর বার্লিনের বাড়ি এবং একাধিক মূল্যবান গবেষণা প্রবন্ধ ধ্বংস হয়ে যায়। তবে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ছিলেন খুব শক্ত মনের মানুষ, এত কিছুর পরেও তিনি ভেঙে পড়েননি। পঁচাশি বছর বয়সে উনি আল্পসে চলে যান। ১৯৪৭ সালে তাঁর ছোট ছেলের মৃত্যুর পর তাঁর বাঁচার ইচ্ছে ক্রমাগত কমে যেতে থাকে। যুদ্ধ শেষ হলে, গটিনজেনে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে সপরিবারে ফিরে আসেন। ৪ অক্টোবর, ১৯৪৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়, মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর।

তাঁর মৃত্যুর  পর ‘কাইজার  উইলহেলম সোসাইটি’-র নাম পরিবর্তন করে ‘দ্য ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সোসাইটি’ রাখা হয় এবং তা বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে। বর্তমানে এর অধীনে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে ৮৩ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘planck’s constant’ আজ কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান থেকে শুরু করে মহাকাশ বিজ্ঞান ও বর্তমানে জনপ্রিয় স্ট্রিং থিওরি সর্বত্র ব্যবহৃত হয়।

2 comments

আপনার মতামত জানান