পরিতোষ সেন

পরিতোষ সেন

ভারতীয় চিত্রকলার জগতে এক অবিস্মরণীয় নাম পরিতোষ সেন (Paritosh Sen)। ভারতীয় চিত্রকলায় আধুনিকতাবাদের অন্যতম উদ্‌গাতা তিনিই। ১৯৪২ সালে এই লক্ষ্যেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্দোরের দালি বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। ১৯৭০ সালে তিনি ‘রকফেলার ফেলোশিপ’ অর্জন করেন। ভারত এবং ভারতের বাইরে বহু প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছে তাঁর আঁকা ছবির। ১৯৪৪ সালে দ্য ক্যালকাটা গ্রুপ এক্সিবিশন, এরপরে ১৯৬২ সালে লণ্ডনে, ১৯৬৫ সালে সাও পাওলো বিয়েনাল, ১৯৮৪ সালে সুইডেনে, ১৯৮৬তে হাভানা বিয়েনালে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়। নিউ দিল্লিতে পরপর তিনবার ১৯৬৮, ১৯৭১ এবং ১৯৭৫ সালে তাঁর ছবির প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। ভারতের শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেলেও তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরনো ঢাকায়। আর সেই ঢাকায় কাটানো বাল্য ও কৈশোরের স্মৃতি নিয়ে পরবর্তীকালে চিত্রকর পরিচয় থেকে বেরিয়ে এসে পরিতোষ সেন লেখেন ‘জিন্দাবাহার’ নামে একটি সুরম্য গদ্যগ্রন্থ। তাঁর আঁকা কিছু বিখ্যাত ছবি হল – তালবিথী, পাইন বন, তুলসী মঞ্চ, বড়ে গোলাম আলী ইত্যাদি।

১৯১৮ সালের ১৮ অক্টোবর অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা জেলায় পরিতোষ সেনের জন্ম হয়। তাঁর বাবা প্রসন্নকুমার সেন সেকালের বিখ্যাত কবিরাজ ছিলেন এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল হেমাঙ্গিনী দেবী। প্রসন্নকুমার এবং হেমাঙ্গিনী দেবীর মোট কুড়িটি সন্তানের মধ্যে সপ্তদশ সন্তান ছিলেন পরিতোষ সেন। পুরনো ঢাকা শহরের জিন্দাবাহার লেনে তাঁর বাল্য-কৈশোর কেটেছে। যদিও তাঁদের অপর একটি বাড়ি ছিল ঢাকার অনতিদূরে বেলতলী গ্রামে। পুজোর ছুটিতে তিনি সপরিবারে এই বেলতলীর বাড়িতে ছুটি কাটাতে যেতেন। একটা একান্নবর্তী পরিবারেই তিনি বড়ো হয়ে উঠেছেন। শৈশব থেকে বড়ো বয়স পর্যন্ত ঢাকার জিন্দাবাহার থেকে ইন্দোর, প্যারিস, কলকাতা, নেতারহাট, ফ্রান্স, সোভিয়েত রাশিয়া, আমেরিকা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হয়েছে তাঁকে কাজের সূত্রে। তাঁর বাড়িতে সেভাবে চিত্রশিল্পের চর্চা ছিল না ঠিকই, কিন্তু তাঁর কাকা খুব ভালো বিয়ের পিঁড়ি আঁকতে পারতেন। সম্ভবত চিত্রশিল্পের বীজটি তার মাধ্যমেই পরিতোষ সেনের মনে প্রোথিত হয়েছিল।

ঢাকার স্থানীয় স্কুলে প্রথাগত শিক্ষা শেষ করে মাদ্রাজের গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি হন পরিতোষ সেন। বিখ্যাত চিত্রকর দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী তখন ঐ স্কুলের অধ্যক্ষ। তাঁকেই আদর্শ ভেবে ছবি আঁকা শেখা শুরু করেন পরিতোষ সেন। সে সময় তাঁর ছবি আঁকার ইচ্ছাকে বাড়িতে একমাত্র মা ছাড়া আর কেউই মেনে নেয়নি। সকলের আপত্তি সত্ত্বেও ঢাকা থেকে একাই মাদ্রাজের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি। দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীকে আগে থেকে ছবি, চিঠি পাঠিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন তিনি এবং তাঁর ছবি আঁকার দক্ষতা উপলব্ধি করে মাদ্রাজ আর্ট স্কুলে প্রথমেই তৃতীয় বর্ষে ভর্তি নেওয়া হয়। আর্ট স্কুলের পড়া শেষ হলে ১৯৪০ সাল নাগাদ কলকাতায় ফিরে আসেন পরিতোষ সেন। মাদ্রাজ স্কুলে এতদিন পর্যন্ত আধুনিকতার পাঠ নেওয়ার পাশাপাশি স্বাভাবিকতাবাদের দীক্ষাও গ্রহণ করেছিলেন তিনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৪০ সালেই মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় ফিরে কিছুদিন কাটানোর পরেই আবার ঐ বছরেই ইন্দোরের দালি কলেজে শিল্প-শিক্ষকতার কাজ নিয়ে ইন্দোর চলে যান পরিতোষ সেন। এভাবেই কর্মজীবনের সূচনা ঘটে তাঁর। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত এই কলেজে চাকরি করার পরে তিনি ইউরোপে যাত্রা করেন চিত্রকলার আর নানা দিক বিষয়ে গভীরভাবে অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে। বিদেশযাত্রার খরচ কোনোমতে সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু ইউরোপে থাকাকালীন তাঁর বেশ কিছু ছবি প্রদর্শনীতে বিক্রি হওয়ায় অর্থসংস্থানে খুব একটা অসুবিধে হয় না। ১৯৫০ সাল নাগাদ প্যারিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি এবং প্যারিসের অ্যাকাডেমি আন্দ্রে লোতে, অ্যাকাডেমি লা গ্রান্দে শ্যমিয়ের, ইকোলে দে ল্যুভে ইত্যাদি শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলিতে একাদিক্রমে অধ্যয়ন করেন। ১৯৫৪ সালে বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকর পাবলো পিকাসোর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে পরিতোষ সেনের। পিকাসোর সঙ্গে তাঁর স্টুডিওতে অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন তিনি, পিকাসো তাঁর ছবি দেখে প্রশংসা করেছিলেন এবং প্যারিসের একটি গ্যালারিতে যাতে এই ছবির প্রদর্শনী হয় তার ব্যবস্থা করে দেবেন বলেওছিলেন। কিন্তু সেই প্রদর্শনী করা সম্ভব হয়নি আর। তাছাড়া শিল্পী ব্রাকুঁসির সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ ঘটেছিল। ইকোলে দে ল্যুভে-তে পড়াকালীন পিকাসো, ব্রাক মাতিস, শাগাল, রুঁয়ো, ব্রাকুসি প্রমুখ বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের ছবি পরপর দেখেছিলেন তিনি। প্যারিসে ন্তখন আধুনিকতাবাদী ভাবধারা শুরু হয়েছে গেছে চিত্রশিল্পে। ফলে চিত্রের মধ্যে আখ্যানের বদলে শিল্পীর নিজস্ব ঘরানা বা স্টাইলই প্রাধান হয়ে উঠছে। এই ঘটনা পরিতোষ সেনকে প্রভাবিত করলো। ইতিমধ্যে ১৯৪২ সালে কলকাতায় তাঁর তত্ত্বাবধানে ও নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’। সমস্ত অধ্যয়ন প্রক্রিয়া শেষ হলে পরিতোষ সেন ভারতে ফিরে আসেন। রাঁচির অনতিদূরে নেতারহাটের এক অঙ্কন স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হন তিনি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত ‘দ্য রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ প্রিন্টিং টেকনোলজি’ নামক মুদ্রণ কারিগরি প্রতিষ্ঠানে বহু বছর ডিজাইন এবং লে-আউটের শিক্ষক হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি।

তাঁর ছবির প্রদর্শনী প্রথম আয়োজিত হয় ১৯৪১ সালে আলমোড়ার উদয়শঙ্কর সেন্টারে। এরপর একে একে পাঁচটি প্রদর্শনী করেন পরিতোষ সেন। ১৯৪২ সালে লাহোরের লিটারেসি লীগে, ইন্দোরের টাউন হলে ১৯৪৩ সালে, দিল্লির ওয়াইএমসিএ হলে প্রদর্শনী হয় ১৯৪৪ সালে এবং পঞ্চম প্রদর্শনীটি আয়োজিত হয় ১৯৪৫ সালে কলকাতার মৌলানা আজাদ কলেজে। ক্যালকাটা গ্রুপের হয়ে বহু জায়গায় সম্মিলিত প্রদর্শনীতে অংশ নিতেন তিনি। তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময় ইন্দোরে থাকার সময় কলকাতার দুর্ভিক্ষের কথা জানতে পারেন তিনি এবং ফিরে এসে এই মর্মান্তিক পরিস্থিতিকে ছবিতে ধরে রাখার চেষ্টা করেন পরিতোষ সেন। ১৯৪০ সালের সময়পর্বে তাঁর আঁকায় পাশ্চাত্য রীতির পাশাপাশি নব্য ভারতীয় রীতির মিশেল ঘটছিল প্রবলভাবে। ১৯৪২ সালে তিনি আঁকেন ‘এ পার্টি ইন আ ম্যাঙ্গো গ্রেভ’, ‘গার্লস অন আ সি সাইড’ এবং ১৯৪৪ সালে তাঁর আঁকা ‘থার্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্ট’ ছবিটিতেও এই বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। ১৯৪৮ ও ১৯৪৯ সালে তাঁর আঁকা আত্ম-প্রতিকৃতিগুলি খুবই প্রশংসিত হয়। ১৯৫১ সালে আঁকা ‘বয় ইটিং ওয়াটারমেলন’ বা ১৯৫৬ সালে আঁকা ‘দ্য বার্ড সেলার’ অথবা ‘দ্য বাউল সিঙ্গার’ ইত্যাদি ছবিগুলিতে কিউবিজম এবং ইম্প্রেশনিজমের প্রভাব লক্ষণীয়। ১৯৭৯ সালে যাদবপুরের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত কলকাতাতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন তিনি। কলকাতার ইতস্তত ঘুরে ঘুরে তিনি ছবির বিষয় তুলে এনেছেন। এর মধ্যে পার্ক স্ট্রিটের ‘আর্টিস্ট্রি হাউস’-এ তিনি একটি প্রদর্শনীও করেন চল্লিশটি ছবি নিয়ে যার মধ্যে মাত্র তিন-চারটি ছবিই বিক্রি হয়। ১৯৬২ সালে আবার প্যারিসের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন পরিতোষ সেন। নিছক ঘুরতে গেলেও এখানে ভারতীয় চিত্রকর তৈয়ব মেহতার সঙ্গে যৌথভাবে একটি প্রদর্শনীতে সুযোগ পান তিনি। সেখানেও কিছু ছবি বিক্রি হয় তাঁর এবং বহু মানুষের প্রশংসা অর্জন করেন পরিতোষ সেন। ভারতীয় সঙ্গীতের রাগ-রাগিণী ছিল এইসব ছবির বিষয়বস্তু। ১৯৬০-এর দশকে ফরাসি সরকারের অনুমোদনে রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষর অনুকরণ করে বাংলা মুদ্রণ শিল্পের জন্য বিশেষ এক টাইপফেস তৈরির কাজ পান তিনি। এই পরিকল্পনা করলেও শেষ পর্যন্ত বাস্তুবায়িত করা যায়নি। ১৯৭০ এবং ১৯৭১ সাল এই দুই বছর রকফেলার ফেলোশিপ পেয়ে আবার ইউরোপ ভ্রমণে যান পরিতোষ সেন। শ্রীরামকৃষ্ণের কথামৃতকে কেন্দ্র করেও ছবি এঁকেছেন তিনি।

১৯৪৪ সালে দ্য ক্যালকাটা গ্রুপ এক্সিবিশন, এরপরে ১৯৬২ সালে লণ্ডনে, ১৯৬৫ সালে সাও পাওলো বিয়েনাল, ১৯৮৪ সালে সুইডেনে, ১৯৮৬তে হাভানা বিয়েনালে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়। নিউ দিল্লিতে পরপর তিনবার ১৯৬৮, ১৯৭১ এবং ১৯৭৫ সালে তাঁর ছবির প্রদর্শনী আয়োজিত হয়।

তবে শুধুই চিত্রশিল্প নয়, লেখালিখির জগতেও তাঁর বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। ‘ললিতকলা কন্টেম্পোরারি’ পত্রিকায় ১৯৭৪ সালে ‘ফিগার ইন ইণ্ডিয়ান আর্ট’ শিরোনামে প্রথম একটি প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি। ‘কিছু শিল্পকথা’ , ‘আবু সিম্বাল, পিকাসো ও অন্যান্য তীর্থ’, ‘আমসুন্দরী ও আমরা’ (১৯৮১) এবং ‘জিন্দাবাহার’ (১৯৭৮) এই সমস্ত বইতে তাঁর সাহিত্যিক শৈলীর স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়। এছাড়া ‘আলেখ্য মঞ্জুরি’ বইতে ‘কিষাণগড়ের রাধা’, ‘ভ্যানগঘের চেয়ার’ ইত্যাদি লেখাগুলি পাঠকমহলে অত্যন্ত সমাদৃত হয়। ‘আবু সিম্বাল, পিকাসো ও অন্যান্য তীর্থ’ এই বইটি মূলত একটি ভ্রমণকাহিনি যেখানে পরিতোষ সেন প্যারিসে প্রথমবার পিকাসোর সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন আর ‘জিন্দাবাহার’ বইটি একটি আত্মজৈবনিক রচনা।

২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর পরিতোষ সেনের মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান