সালভাদর দালি (Salvador Dalí) ছিলেন বিশ শতকের একজন বিখ্যাত স্পেনীয় পরাবাস্তববাদী চিত্রশিল্পী। তাঁর প্রতিভা কেবলমাত্র চিত্রশিল্পের আঙিনাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি তিনি ভাস্কর, ফ্যাশন ডিজাইনার, লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
১৯০৪ সালে ১১ মে স্পেনের কাতালোনিয়ার ফিগুরেস শহরে জন্ম হয় সালভাদর দালির। তাঁর পুরো নাম ছিল সালভাদর ডমিঙ্গো ফিলিপ জাসিনটো দালি ই ডোমেনেচ। তাঁর বাবার নাম ছিল সালভাদর দালি কুজি পেশায় একজন আইনজীবী ছিলেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলাপরায়ন একজন মানুষ। তাঁর মায়ের নাম ছিল ডমিনেখ ফেরিস। সালভাদর দালির বাবা এবং মা দুজনেই তাঁকে আঁকার বিষয়ে উৎসাহিত করতেন। এজন্য খুব অল্প বয়সেই তাঁর বাবা-মা তাঁকে একটি নিজস্ব স্টুডিও তৈরি করে দেন।তবে প্রতিভাধর হলেও শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অদ্ভুত প্রকৃতির এবং অস্থিরচিত্ত। তাঁর নানান উদ্ভট খেয়াল ও আচরণের জন্য তিনি যথেষ্ট সমালোচিত হতেন। প্রথম জীবনে তিনি ফিগুরেসের মিউনিসিপ্যালিটি ড্রয়িং স্কুলে পড়েন। ১৯১৭ সালে তাঁর বাবা পরিবারের মধ্যে তাঁর আঁকা চিত্র নিয়ে একটি চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়াও ১৯১৮ সালে ফিগুরেসের মিউনিসিপাল থিয়েটারে জনসমক্ষে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয়েছিল।
১৯২২ সালে মাদ্রিদের ‘আকাদেমিয়া ডি সান ফার্নাডো’ নামের ফাইন আর্টস স্কুল থেকে তিনি প্রথাগত শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন। সেই সময় তিনি রেনেসাঁ এবং ইম্প্রেশনিজম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। এখান থেকেই তিনি মেটাফিজিক্যাল এবং কিউবিজম চিত্রকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু এক বছর বাদে তাঁকে আচরণ জনিত কারণে অ্যাকাডেমি থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। ১৯২৬ সালে আবার তিনি অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন, কিন্তু এবারও তাঁর উদ্ধত আচরণের কারণে তাঁকে অ্যাকাডেমি থেকে চিরস্থায়ীভাবে বহিস্কৃত করা হয়।এই সময় তিনি ‘দাদা আন্দোলনে’র সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ‘দাদা আন্দোলন’ ছিল শিল্প-সাহিত্যিকদের এক আন্দোলন, যেটি সুইজারল্যান্ডের জুরিখ থেকে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই আন্দোলনের প্রভাব তাঁর বিভিন্ন সৃষ্টিকর্মে ধরা পড়ে। কিশোর বয়স থেকেই তিনি রাফায়েল, ব্রঞ্জিনো, ডিয়েগো ভাস্কেজের মতো বিশ্ববিখ্যাত শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ১৯২৬-২৯ সালের মধ্যে তিনি বেশ কয়েকবার প্যারিস ভ্রমণে যান। এই ভ্রমণকালে তিনি শিল্পজগতের বিখ্যাত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন পাবলো পিকাসো, জোয়ান মিরো, রেনে ম্যাগ্রিতির মতো বিখ্যাত চিত্রশিল্পীরা। তাঁর পরবর্তী সৃষ্টিকর্মগুলোতে পাবলো পিকাসোর প্রভাব দেখা যায়। এছাড়াও মনস্তত্ত্ববিদ ফ্রয়েডের প্রভাবও তাঁর ছবিতে লক্ষণীয়। ১৯২৯ সাল থেকে তিনি সুরিয়ালিস্টিক বা পরাবাস্তব (অর্থাৎ যেখানে কল্পনা ও বাস্তব মিলে মিশে যায়) চিত্রকর্ম নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। এ ব্যাপারে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান হলো ‘প্যারানয়িক ক্রিটিক্যাল মেথড’ অর্থাৎ চিত্রকর্মের মাধ্যমে অবচেতন মনের ভাবনাকে প্রকাশ করা। ১৯৩০ সালে তিনি তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি ‘দ্য পারসিসট্যান্স অফ মেমারি’ নামক ছবিটির প্রদর্শনী করেন।
১৯২৯ সালে তিনি লুইস বুনুয়েল এর সাথে দুটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছিলেন ।পরবর্তীকালে বিখ্যাত ব্রিটিশ পরিচালক হিচককের সাথে ‘স্পেলবাউন্ড’ ছবিতে কাজ করেন। এই ছবির একটি সেটে তাঁর চিত্রকর্ম ব্যবহৃত হয়েছিল। এছাড়াও ১৯৪৬ সালে ওয়াল্ট ডিজনির সাথে একটি কার্টুন ফিল্ম করেছিলেন। ১৯৪৪ সালে ‘হিডেন ফেসেস’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এছাড়াও কিছুদিন তিনি পোশাক এবং গয়নার ডিজাইনের কাজও করেছিলেন।
১৯৩৪ সালে তিনি গালা(দিমিত্রি এভানা ডায়াকোনোভার)কে বিয়ে করেন ।গালা ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণাদাত্রী। এছাড়াও তাঁর চিত্রকর্মের ব্যাবসায়িক দিকটি গালাই সামলাতেন।
দালি তাঁর অদ্ভুত আচরণ ও দর্শনের জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর অদ্ভুত সরু -লম্বা গোঁফ, টুপি ,লাঠি তাঁকে সবার থেকে আলাদা করেছিল। ১৯৩৬ সালে লন্ডনের ‘লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল সুরিয়ালিস্ট এক্সিবিশন’ -এ তিনি ডুবুরীর পোশাক পরে উপস্থিত হয়েছিলেন।
১৯৪০ সালে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দালি আমেরিকায় চলে যান। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনী ‘সিক্রেট লাইফ অফ সালভাদর দালি’। পরবর্তী সময়ে তাঁর সৃষ্টিকর্মে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৯৪১ সালে নিউইয়র্কের একটি প্রদর্শনীতে তাঁর ১৯ টি বিখ্যাত চিত্রকর্ম অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এই সিরিজটিতে তিনি ইতিহাস , বিজ্ঞান, ধর্ম প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়কে তুলে ধরেছিলেন ।চিত্রগুলি স্বকীয়তার গুণে সমগ্র বিশ্বেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তাঁর অজস্র চিত্রকর্মের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম হলো-‘ল্যান্ডস্কেপ নিয়ার ফিগুরেস’, ‘ভিলাবার্ট্রান্’ ,’দ্য গ্রেট মাস্টার বেটর’ , ‘পারসিসটেন্স অফ মেমোরি’ , ‘দ্য বার্নিং জিরাফ’, ‘দ্য বাস্কেট অফ ব্রেড’ ,’দ্য ফেম অফ ওয়ার’ প্রভৃতি।১৯৪৭-৪৮ সালে নিউ ইয়র্কে প্রদর্শিত ১৪টি তৈলচিত্রে ‘এটমিক ফিজিক্স’ এর প্রতি তার আগ্রহ প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯৪৮ সালে আবার কাতালোনিয়ায় ফিরে আসেন। ১৯৪৮ সালে দালির লেখা ‘ফিফটি সিক্রেটস অফ ম্যাজিক ক্রাফটম্যানশিপ’ প্রকাশিত হয়। বইটিতে চিত্রকলা সম্পর্কিত আলোচনার পাশাপাশি রয়েছে মজার কিছু ঘটনা ও কাহিনী এবং দালির তর্কযুদ্ধ।
দালির জীবনের প্রথম প্রদর্শনীক্ষেত্রটি স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে যায়। পুনর্নির্মাণের পর ১৯৭৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সেটির উদ্বোধন হয়। এই নতুন ভবনের নকশাটি দালি নিজেই করেছিলেন। এই মিউজিয়ামটি পৃথিবীর সবথেকে বড় পরাবাস্তব বস্তু। এখানে দালির অসংখ্য চিত্রকর্ম সংরক্ষিত রয়েছে। দালির বন্ধু রেনল্ড ও তাঁর স্ত্রীর উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল ‘ফ্রেন্ডস অফ দালি’ নামক একটি সংস্থা। এই সংস্থার উদ্যোগে অপর একটি মিউজিয়াম তৈরি হয়েছিল ফ্লোরিডার পিটার্সবার্গে। এই মিউজিয়ামটি ‘সালভাদর দালি মিউজিয়াম’ নামে পরিচিত। জীবনকালেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি।
তবে তাঁর শেষ জীবন ছিল যন্ত্রণাময়। ১৯৮০ সালে তিনি পারকিনসনস রোগে আক্রান্ত হন।১৯৮২ সালে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এর ফলে তিনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন।১৯৮৪ সালে বাড়ির শোবার ঘরে আগুন লেগে মারাত্মকভাবে পুড়ে যান। শেষ বছরগুলি জনসমক্ষের আড়ালে গৃহবন্দী অবস্থাতেই কাটে। অবশেষে ১৯৮৯ সালে ২৩ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় সালভাদর দালির। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
এই ধরণের তথ্য লিখে আয় করতে চাইলে…
আপনার নিজের একটি তথ্যমূলক লেখা আপনার নাম ও যোগাযোগ নম্বরসহ আমাদের ইমেল করুন contact@sobbanglay.com এ
তথ্যসূত্র
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.britannica.com/
- https://www.theartstory.org/
- https://roar.media/
