সঙ্কটা মঙ্গলচন্ডী ব্রত প্রতি মাসের শুক্লপক্ষের শুক্রবারে পালন করা হয়ে থাকে। বলা হয় এই ব্রত পালন করলে তার হারানো ধন ফিরে পাওয়া যায়। জেনে নেওয়া যাক এই ব্রতের পিছনের প্রচলিত কাহিনী।
এক রাজার সাত রানী ছিল, তাঁদের কারোর কোনো সন্তান হয়নি। রাজার মনে খুব দুঃখ। সে কত হোম- যজ্ঞ- দান ধ্যান করে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। একদিন এক কাপালিক এসে রাজার কাছে ভিক্ষে চাইলেন। রাজা তাড়াতাড়ি তাকে ভিক্ষা দিলেন। তখন সেই কাপালিক রাজার কপালের দিকে তাকিয়ে তাঁকে একটা শেকড় দিয়ে বললেন এটা সাত রানীকে বেটে খাওয়ালে তাঁদের ছেলে হবে। আর সেই ছেলেদের মধ্যে যে সব থেকে সুন্দর এবং স্বাস্থ্যবান হবে তাঁকে সেই কাপালিক নিয়ে যাবেন। এই বলে সেই কাপালিক চলে গেলেন। রাজা মনে মনে ভাবলেন, সাতটা ছেলে হলে একটা একে দিলে কিই বা ক্ষতি হবে। তিনি সেই শিকড় নিয়ে রানীদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। এরপর ছয়জন রানী স্নান করে শেকড় শিল নোড়ায় বেটে সমান ভাগে ভাগ করে খেলেন। কিন্তু ছোট রানী দেরী করে আসায় ভাগ পেলেন না। তিনি তাঁর ভাগ নিতে এলে অন্য রানীরা বললেন তাঁর কথা বাকিরা ভুলে গেছিলেন। বড়রানী তাঁকে শিলনোড়ায় যা লেগে আছে তা ধুয়ে খেয়ে নিতে বললেন। ছোট রানীও তাই করলেন। এরপর সাত রানী একসাথে গর্ভবতী হলেন। কিন্তু ছয় রানী যে ছয়টি ছেলের জন্ম দিলেন, তারা কেউ কানা, কেউ খোঁড়া হয়ে জন্মাল। রাজা খুবই দুঃখ পেলেন। এদিকে ছোট রানী একটি শাঁখ প্রসব করলেন। তাই দেখে রাজা রেগে গিয়ে ছোট রানীকেই ত্যাগ করলেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে রাজমহল ছেড়ে একটি কুঁড়ে ঘরে আশ্রয় নিলেন।
এই ধরণের তথ্য লিখে আয় করতে চাইলে…
আপনার নিজের একটি তথ্যমূলক লেখা আপনার নাম ও যোগাযোগ নম্বরসহ আমাদের ইমেল করুন contact@sobbanglay.com এ
এই ভাবে কুঁড়েঘরেই তাঁর দিন কাটাতে লাগল। কিন্তু কিছুদিন যেতেই ছোট রানীর সাথে অদ্ভুত ঘটনা হতে থাকল। রানীর মনে হত কে যেন রাত্রে তাঁর বুকের দুুুধ খায়, কিন্তু জেগে উঠলে কাউকে দেখতে পেতেন না। একদিন রাত্রে তিনি ঘুমোনোর ভান করে পড়ে রইলেন। একটুই পরেই তিনি দেখলেন তাঁর প্রসব করা শাঁখ থেকে সুন্দর ফুটফুটে একটা বাচ্ছা ছেলে বেরিয়ে তাঁর বুকে উঠে এসে তাঁর দুধ খেতে লাগল। রানী বুঝলেন তিনি একজন ছেলের জন্ম দিয়েছেন। তখন সেই শাঁখটা ভেঙে দিয়ে ছেলেটাকে ধরে কোলে তুলে খুব আদর করলেন। ছেলেটি ভয় পেয়ে তার মাকে বলল এটা রানীমা কি করলেন! সেই কাপালিক এসে এবার তো তাকে নিয়ে যাবে! তা শুনে রানীরও খুব চিন্তা হল। তিনি রাজাকে খবর দিলেন। খবর পেয়ে রাজা এসে দেখলেন কুঁড়েঘর আলো করে রানীর কোলে রয়েছে একটি ছেলে। ছোটরানী রাজাকে সব খুলে বললেন। রাজা ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করে তারপর রানীকে সঙ্গে করে রাজপ্রাসাদে এলেন।
এই ভাবে চোদ্দ বছর কেটে গেল। চোদ্দবছর পর সেই কাপালিক এসে রাজাকে জিজ্ঞেস করলেন তার সব ছেলেরা কোথায়! রাজা ছোটরানীর ছেলেকে বাদ দিয়ে বাকি সব ছেলেদের এনে দেখালেন। কাপালিক খুব রেগে গিয়ে বললেন এদের সে চান না। তারপর একটি শাঁখ বার করে বাজিয়ে “শঙ্খনাথ! শঙ্খনাথ!” বলে ডাকতে লাগলেন। ছোটরানীর ছেলেটি দৌড়ে এসে কাপালিককে প্রণাম করলেন। এরপর কাপালিক শঙ্খনাথকে নিয়ে চলে গেলেন। ছেলে চলে যেতে রাজা রানী সমেত সকলেই কাঁদতে লাগলেন। রানীর তো কান্না থামেই না। তাই দেখে প্রাসাদের এক বুড়িমা তাঁকে সঙ্কটা মঙ্গলচন্ডী ব্রত করবার কথা বললেন। তিনি বললেন যে এই ব্রত করলে মা মঙ্গলচন্ডীর দয়ায় তাঁর ছেলে আবার তাঁর কাছে ফিরে আসবে। সেই কথা শুনে ছোটরানী সঙ্কটা মঙ্গলচন্ডী ব্রত করা শুরু করলেন।
ওই দিকে কাপালিক শঙ্খনাথকে নিয়ে যেতে যেতে তিনটি পথ সোজা যে পথ ছিল, তা দেখিয়ে বললেন এই পথে গেলে গন্তব্যে পৌঁছতে বহুদিন লেগে যাবে। বামদিকের পথে গেলে সাতদিন লাগবে এবং ডান দিকের পথে গেলে দুইঘণ্টা সময় লাগবে, কিন্তু ওই পথে বিপদ আছে। শঙ্খনাথ জানালেন তিনি রাজার ছেলে, বিপদকে তিনি ভয় পান না। কাপালিক খুব খুশি হয়ে দুইঘণ্টার পথ দিয়ে তাঁকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে গেলেন। এরপর কাপালিক শঙ্খনাথকে বললেন তিনি যেন স্নান করে আসেন, ততক্ষণে কাপালিক মায়ের পুজো করে আসছেন। সঙ্গে এও বললেন শঙ্খনাথ যেন বাঁ দিকের দরজা না খোলে। দরজা খুললে কিন্তু তিনি মারা যাবেন। এই বলে কাপালিক মায়ের পুজো করতে গেলেন। কিন্তু তাঁর এই কথা শুনে শঙ্খনাথের মনে কৌতূহল এবং সন্দেহ হল। ওই দিকে কি আছে তা দেখার জন্য তিনি দরজা খুলে দেখলেন। দরজা খুলতেই তিনি দেখলেন সামনে একটা পুকুর আর সেই পুকুরে কতগুলো মানুষের মাথা ভাসছে। তাঁকে দেখে মাথাগুলো হা হা করে হেসে উঠল। শঙ্খনাথ মনে সাহস এনে তাঁকে দেখে এরকম হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তার উত্তরে একটা মাথা বলল তারা সবাই শঙ্খনাথের মতই রাজপুত্র ছিল। ওই কাপালিক তাদের মায়ের কাছে বলি দিয়েছে। এখন তারও একই অবস্থা হবে। শঙ্খনাথ জিজ্ঞেস করল এর থেকে বাঁচার কি উপায় আছে। একটা মাথা বলল, “যদি তুমি আমাদের বাঁচাবে কথা দাও তাহলে উপায় বলতে পারি।” শঙ্খনাথ বলল, “যদি আমি বাঁচি তাহলে তোমাদেরও বাঁচাব এই তিন সত্যি করলাম।”
তখন মাথাটি বলল, “কাপালিক যখন তোমায় মাকে সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করতে বলবে তুমি বলবে আমি রাজার ছেলে সাষ্টাঙ্গে প্রনাম কি ভাবে করতে হয় আমি জানি না। তারপর বলবে আপনি যদি দেখিয়ে দেন তবেই মাকে সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করতে পারব। কাপালিক তোমায় শুয়ে প্রনাম করা দেখালে তুমি মায়ের খাঁড়াটা নিয়ে তার মাথাটা ধড় থেকে আলাদা করে দেবে। তারপরে কাপালিকের রক্ত আর মায়ের ফুল এনে আমাদের এই পুকুরে ছিটিয়ে দেবে।”
শঙ্খনাথ “ঠিক আছে” বলে চলে গেলেন।
এরপরে কাপালিক এসে তাঁকে যখন মায়ের কাছে নিয়ে গেল, শঙ্খনাথ মাথাদের কথামতো কাপালিককে মেরে তাদের উদ্ধার করলেন। কাপালিক এবং শঙ্খনাথের কথা সেই দেশের রাজার কানে গেল। রাজা রাজপুত্রদের আনতে লোক পাঠালেন। সব রাজপুত্রদের নিয়ে শঙ্খনাথ সেই দেশের রাজার রাজপ্রাসাদে এসে হাজির হলেন। রাজা তাদের সবাইকে খুব যত্ন করলেন আর শঙ্খনাথের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দিলেন। এরপর শঙ্খনাথ রাজকন্যেকে সঙ্গে নিয়ে নিজের রাজ্যের দিকে এগোলেন।
এই দিকে ছোটরানী সঙ্কটা মঙ্গলচন্ডী ব্রত করে উঠছিলেন, অমনি এক দাসী এসে খবর দিল রাজপুত্র রাজকন্যেকে সঙ্গে করে আসছেন। রাজা রানী তাড়াতাড়ি তাদের ছেলে বউকে বরণ করতে গেলেন। রানী বউকে বরণ করে ঘরে তুললেন। রাজা তাঁর ছেলের কাছে কাপালিকের সব কথা শুনে অন্য রাজপুত্রদের ধন্যবাদ জানালেন। সেই বুড়ি তখন রাজপুত্রদের মা সঙ্কটার ব্রত মাহাত্য শোনাতে লাগলেন। তা শুনে তাঁরা বললেন তাঁরাও এই ব্রত যে যার নিজের দেশে ফিরে গিয়ে প্রচার করবেন। এই ভাবে সঙ্কটা মঙ্গলচন্ডী ব্রত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
ব্রতটি আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে দেখুন এখানে
তথ্যসূত্র
- মেয়েদের ব্রতকথা- লেখকঃ আশুতোষ মজুমদার, প্রকাশকঃ অরুণ মজুমদার, দেব সাহিত্য কুটির, পৃষ্ঠা ৬৯
- মেয়েদের ব্রতকথা- লেখকঃ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য সম্পাদিত ও রমা দেবী কর্তৃক সংশোধিত, প্রকাশকঃ নির্মল কুমার সাহা, দেব সাহিত্য কুটির, পৃষ্ঠা ২০০
- মেয়েদের ব্রতকথা- লেখকঃ শ্রীকালীকিশোর বিদ্যাবিনোদ সংকলিত ও শ্রীসুরেশ চৌধুরী কর্তৃক সংশোধিত প্রকাশকঃ অক্ষয় লাইব্রেরী, পৃষ্ঠা ১৪৭
