বাংলা নাট্য জগতের এক অতুলনীয় প্রতিভা শাঁওলী মিত্র (Saoli Mitra)। প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা শম্ভু মিত্র এবং অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রের কন্যা শাঁওলী বড় হয়ে উঠেছেন নাট্য পরিবেশেই। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে মঞ্চের উইংসের ধার থেকে নাটকের মহড়া দেখার অভিজ্ঞতা তাঁকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। সেই সঙ্গে নাটক ও অন্যান্য লেখার বিষয়ে তাঁর মা তৃপ্তি মিত্রের উৎসাহদান তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর পাঠাভিনয়ে ‘নাথবতী অনাথবৎ’ এবং ‘কথা অমৃত সমান’ এই দুই নাটক আপামর নাট্যমোদী মানুষকে বহু সময় ধরে মুগ্ধ রেখেছে। মহাভারতের ঘটনাকে কেবলমাত্র দ্রৌপদী ও অন্যান্য নারীর দৃষ্টিকোণে দেখার যে প্রয়াস এই নাটকে করেছেন শাঁওলি, তার জন্য তাঁর নাট্যকার সত্ত্বার প্রশংসা বহু সমালোচক ও নাট্যবিদ করেছেন। ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি-তক্কো-গপ্পো’ ছবিতে বঙ্গবালার ভূমিকায় তিনি অভিনয় করেছিলেন। এছাড়া বাংলার নাট্যমঞ্চে ‘বিতত বীতংস’, ‘ডাকঘর’, ‘পুতুলখেলা’, ‘একটি অরাজনৈতিক হত্যা’ ইত্যাদি বিখ্যাত নাটকে অভিনয় করেছেন শাঁওলী মিত্র। ২০০৩ সালে তিনি ‘সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি’ পুরস্কারে ভূষিত হন এবং ২০০৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে সম্মানিত করে। এছাড়া ২০১২ সালে ‘বঙ্গবিভূষণ’ পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।
১৯৪৮ সালে কলকাতায় নাসিরুদ্দিন শাহ রোডের একটি বাড়িতে শাঁওলী মিত্রের জন্ম হয়। তাঁর বাবা শম্ভু মিত্র বাংলা নাট্যজগতের কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর মা তৃপ্তি মিত্রও বাংলা নাট্যজগতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিনেত্রী ছিলেন। উভয়েই একত্রে কাজ করতেন ‘বহুরূপী’ নামে একটি গ্রুপ থিয়েটারে, বলা উচিত দুজনে মিলেই তৈরি করেছিলেন এই নাট্যদলটি। ছোটবেলা থেকেই নাটকের পরিবেশে বড় হয়েছেন তিনি। তাঁদের বাড়িতেই বহুরূপীর মহড়া চলত। ফলে মহড়ার নাটকের সংলাপ অনেকক্ষেত্রেই শুনে শুনে মুখস্থ করে ফেলতেন তিনি। তবে আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো সর্বদা মা-বাবার সান্নিধ্য ও সাহচর্য পাননি শাঁওলি। বেশিরভাগ সময়েই তাঁর বাবা শম্ভু মিত্র নাটকের শোয়ের দিন তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন এবং মঞ্চের উইংসের ধার থেকে বহু নাটক দেখেছেন তিনি ঐ ছোটবেলাতেই। মা-বাবার ব্যস্ততার মাঝে স্বাবলম্বী হতে হয়েছে তাঁকে শৈশব থেকেই। এমনও হয়েছে, দলের শো থাকার কারণে জ্বরে আক্রান্ত শাঁওলিকে বাড়িতে একা রেখেই বাধ্য হয়েই তাঁরা শো-তে গিয়েছেন।
কমলা গার্লস হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন শাঁওলী মিত্র। এই স্কুলেই তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন তাঁর নাট্যমঞ্চে পদার্পণ ঘটে।
বহুরূপী দলের ‘ছেঁড়া তার’ নাটকেই প্রথম শিশু বয়সে শাঁওলী মিত্র অভিনয় করেন। এই নাটক অভিনয়ের মহড়ার সময় থেকেই দুঃখের দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড কাঁদতেন তিনি। নাট্যমঞ্চে অভিনয়কালীন তাঁর কান্না নাটককে এক অন্য মাত্রা দিত এবং প্রেক্ষাগৃহের সকল দর্শকই কেঁদে উঠতেন তাঁর সাথে। তৃপ্তি মিত্রের নির্দেশনায় ‘ডাকঘর’ নাটকে অভিনয় করেন তিনি যেটি কলকাতা দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হয়। ১৯৬৯ সালে তাঁর মায়ের নির্দেশনাতেই ‘কিংবদন্তী’ বলে একটি নাটকে অভিনয় করেন তিনি। এর আগে হিমাংশু চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় বাদল সরকারের লেখা ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ নাটকে মিসেস ইথার্নির চরিত্রে অভিনয় করেন শাঁওলি। তখন তাঁর বয়স ২১ বছর। ইতিমধ্যে নাটকের প্রয়োজনে তবলা, হারমোনিয়াম, সেতার কিনে নিয়মিত গানের রেওয়াজ করতে শুরু করেন তিনি। ১৯৭১ সালে তাঁর বাবা শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় বাদল সরকারের লেখা ‘পাগলা ঘোড়া’ নাটকে অভিনয় করেন তিনি। বাবার নির্দেশনায় খুব বেশি কাজ করার সুযোগ পাননি তিনি, কারণ তিনি বড় হওয়ার পরে শম্ভু মিত্র বহুরূপী দল ত্যাগ করেন এবং অভিনয় বা নির্দেশনার কাজও কমে আসে তাঁর। পরে ‘রাজা’ নাটকে তৃপ্তি মিত্রের বদলে সুরঙ্গমার চরিত্রে অভিনয় করেন শাঁওলী মিত্র । এই সময় নাটকের সংলাপের বাচনিক দিকটি উন্নত করার জন্য শম্ভু মিত্র তাঁকে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই নাটকে সুরঙ্গমার গানের জন্য খুবই প্রশংসিত হয়েছিলেন শাঁওলী। মায়ের কাছেই কণ্ঠস্বরের চর্চা এবং মেক-আপের খুঁটিনাটি শিখেছেন তিনি। তৃপ্তি মিত্রের নির্দেশনাতেই ‘টেরোড্যাকটিল’, ‘ঘরে-বাইরে’ ইত্যাদি নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। ‘ঘরে-বাইরে’ নাটকে বিমলার চরিত্রে অভিনয় করতেন শাঁওলী মিত্র। ১৯৭৭ সালে মনোজ মিত্রের নির্দেশনায় ‘পাখি’ নাটকে তাঁর অভিনয় বেশ প্রশংসিত হয়। সত্তরের দশকের শুরু দিক থেকেই অভিনয়ের পাশাপাশি আবৃত্তি শিখতে শুরু করেন তিনি এবং একক আবৃত্তির অনুষ্ঠানও করতে থাকেন। এই সময়পর্বেই ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি-তক্কো-গপ্পো’ ছবিতে বঙ্গবালার চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৮০ সাল নাগাদ ‘বহুরূপী’ দল ছেড়ে দেন তিনি। নতুন কোন দল তৈরি বা অন্য কোন দলে যোগ দেওয়ার বিশেষ ইচ্ছে সেই সময় ছিলনা তাঁর। কিন্তু সেই সময় নিয়মিত বেতারে নাট্যাভিনয় করতেন তিনি। মহাভারতের উপর ইরাবতী কৌরের লেখা একটি নাটক তাঁর বাবা শম্ভু মিত্র পড়তে দিয়েছিলেন তাঁকে। সেই নাটক পড়ে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি যে মহাভারতের দ্রৌপদীর চরিত্রকে অবলম্বন করে তিনি একটি নাটক লিখবেন মনস্থির করেন। তার আগে বেতারে নাট্যরূপ দেওয়া ছাড়া কোন মৌলিক নাটক লেখার অভিজ্ঞতা ছিল না তাঁর। নাটকটির আঙ্গিক নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন শাঁওলি। ইতিমধ্যে শম্ভু মিত্রের লেখা ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকটির পাঠাভিনয়ে অংশ নেওয়ার জন্য যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি। এই অনুপ্রেরণা থেকেই ১৯৮৩ সালের এপ্রিল মাসে তিনি লিখে ফেলেন ‘নাথবতী অনাথবৎ’ নামে এক কালজয়ী নাটক এবং ঐ বছরই ১১ আগস্ট তা মঞ্চস্থ হয় একটি আবৃত্তির দলের নামে। প্রথম অভিনয় থেকেই এত বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এই নাটক যে বাধ্য হয়েই তাঁকে ‘পঞ্চম বৈদিক’ নামে একটি নতুন সংগঠন তৈরি করতে হয়। এই নাটকে মূলত মহাভারতের সময়কে দেখা হয়েছে দ্রৌপদীর দৃষ্টিকোণে আর তার সঙ্গে কথকের বয়ানে বর্তমান সময় তুলে ধরা হয়েছে। কথকতার ঢঙে সমস্ত নাটকটি লেখা হয়েছিল। যদিও নাটক লেখার আগে কথকতা সম্পর্কে শাঁওলির বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল না, ১৯৮৫ সালে দিল্লিতে প্রথম কথকতার অভিনয় দেখেন তিনি। বাঙালির যে সুপ্রাচীন শিকড় তা যেন ফুটে উঠেছে এই নাটকে। এরপরে একই আঙ্গিকে শাঁওলী লেখেন ‘কথা অমৃত সমান’ নামে আরেকটি বিখ্যাত নাটক। এই নাটকে মহাকাব্যের যুগের সঙ্গে সাম্প্রতিক কালের এক মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছেন শাঁওলি। ১৯৮৪ সালে ‘পঞ্চম বৈদিক’ সংগঠনের পক্ষ থেকে ‘পঞ্চমবেদ চর্য্যাশ্রম’ নামে একটি থিয়েটার প্রতিষ্ঠান চালু করেন তিনি। এছাড়া তাঁর লেখা ‘বিতত বীতংস’ নাটকটিও যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে পথে নেমেছেন তিনি। শিল্পী হিসেবে নিজের সামাজিক দায়িত্বের কথা কখনও ভোলেননি তিনি। বহুবার তিনি নন্দীগ্রামে গিয়ে সেখানকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁদের দুর্দশায় পাশে দাঁড়িয়েছেন।
শুধু নাটক নয়, বহু গল্প এবং প্রবন্ধও লিখেছেন শাঁওলী মিত্র। ১৯৮৯ সালের পর থেকেই তাঁর গল্প লেখার শুরু বলা যায়। তাঁর লেখা প্রথম গল্প ‘অনৃত’। এছাড়াও তাঁর লেখা অন্যান্য গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অপারগতা, দায়গ্রহণ, একাকিত্ব ইত্যাদি। তাঁর লেখা ‘প্রজ্ঞা ওরফে রীনা ওরফে ১১৭ নম্বর’ গল্পটি প্রথম ‘সানন্দা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেটাই তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প। এরপরে তাঁর ‘একাকিত্ব’ গল্পটি প্রকাশ পায় ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’ পত্রিকায়। ১৯৯৯ সালে মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স থেকে শাঁওলী মিত্রের লেখা গল্পগুলির একটি সংকলন প্রকাশিত হয় ‘ভ্রান্তিকাল’ নামে। তার আগে ঐ একই প্রকাশনী থেকে তাঁর একটি প্রবন্ধের বইও প্রকাশ পেয়েছিল ‘মুকুরে মুখ না মুখোশ’ নামে। এছাড়া তাঁর লেখা আরেকটি বিখ্যাত প্রবন্ধের বই হল ‘নবনাট্য গণনাট্য সৎনাট্য ও শম্ভু মিত্র’। তাঁর বাবা শম্ভু মিত্রের একটি জীবনীও লিখেছিলেন তিনি।
১৯৯১ সালে প্রথম ‘নাথবতী অনাথবৎ’ নাটকটি লেখার জন্য আনন্দ পুরস্কার পান শাঁওলী মিত্র। এরপরে ২০০৩ সালে ‘সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি’ পুরস্কার, ২০০৯ সালে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কার এবং ২০১২ সালে ‘বঙ্গবিভূষণ’ পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। এছাড়া ‘নাথবতী অনাথবৎ’ এবং ‘কথা অমৃত সমান’ নাটকটির প্রযোজনার জন্য নরওয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ‘ইবসেন শতবার্ষিকী স্মৃতি পুরস্কার’ পান শাঁওলী।
২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারি ৭৩ বছর বয়সে শাঁওলী মিত্রের মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র
- শাঁওলী মিত্র, 'ভ্রান্তিকাল', মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, ১৯৯৯, কলকাতা, ভূমিকা
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.anandabazar.com/
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.telegraphindia.com/
- https://www.youtube.com/
- https://www.youtube.com/
One comment