শোন্দেশ মন্দিরটি মধ্যপ্রদেশের অমরকন্টকে অবস্থিত। এটি একান্ন সতীপীঠের একটি পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর ডান নিতম্ব পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী নর্মদা এবং ভৈরব হলেন ভদ্রসেন। এই সতীপীঠ নর্মদা দেবীর মন্দির নামেও পরিচিত।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের বাপের বাড়িতেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছাতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব এই দেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন। মহাদেবের তান্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখণ্ডগুলিই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। সেই রকম একটি পীঠ হলো সতীপীঠ শোন্দেশ। বলা হয় সতীর ডান নিতম্ব মাটিতে পড়েই জন্ম হয়েছে এই সতীপীঠ শোন্দেশের।
সংস্কৃত ‘অমরকণ্টক’ শব্দের অর্থ হল অমরত্বের পথে বাধা। অনেকে মনে করেন এই অমরকণ্টকে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান, কিন্তু তাতে রুদ্রগণেরা বাধা দেওয়ার কারণে ঈশ্বর সন্তুষ্ট নন। পুরাণে বলা হয়েছে, মহাদেব যখন ত্রিপুরকে অর্থাৎ তিনটি শহরকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করেছিলেন, সেই সময় কিছু ভস্ম পড়েছিল কৈলাসে, কিছু পড়েছিল অমরকণ্টকে আর কিছু ভস্ম মহাদেব নিজে স্বর্গে সঞ্চিত রেখেছিলেন। মনে করা হয় যে ভস্ম অমরকণ্টকে পড়েছিল, তা থেকে পড়ে কোটি কোটি শিবলিঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে। যদিও বর্তমানে তাদের মধ্যে কেবলমাত্র জলেশ্বরেই একটি শিবলিঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়। এই পবিত্র ভস্মের কারণেই মানুষ বিশ্বাস করেন যে যারাই এই নর্মদা মন্দিরে প্রবেশ করবে, তাদের চিত্তশুদ্ধি ঘটবে। তাছাড়া মানুষ এও বিশ্বাস করেন যে, অমরকণ্টক যেহেতু দেবতাদের বাসস্থান, তাই এখানে যার মৃত্যু হবে সে স্বর্গলোকে স্থান পাবে।
মনে করা হয় সতীপীঠ শোন্দেশ তথা নর্মদা মন্দিরটি আজ থেকে প্রায় ৬ হাজার বছর আগে নির্মিত হয়েছিল। এর প্রাচীনত্ব আজও বিস্ময় জাগ্রত করে।
সতীপীঠ শোন্দেশ তথা নর্মদা মন্দিরের ভিতরের বেদীটি খুবই সুদৃশ্য। দেবী নর্মদার বেদীটি রূপা-নির্মিত। এই মন্দিরের কারুকার্য এবং ভাস্কর্য-স্থাপত্য অত্যন্ত সুনিপুণ। সাদা শুভ্র পাথর দিয়ে নির্মিত এই নর্মদা মন্দিরের চারপাশে ছোট ছোট অনেকগুলি পুষ্করিণী আছে যার ফলে এই মন্দিরকে একেবারে ছবির মত দেখায়। তার পাশাপাশি শ্যোন নদী ও কুণ্ডের উপস্থিতি এর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তোলে। তাছাড়া মধ্যপ্রদেশের এই অংশেই বিন্ধ্য পর্বত আর সাতপুরা পর্বত একত্রে মিশেছে, যা পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয়। এছাড়াও এই মন্দিরের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে নর্মদা নদী যার কারণে সতীপীঠ শোন্দেশ আরও মাহাত্ম্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মন্দিরের পাশাপাশি এই অঞ্চলেই রয়েছে শ্যোনমুড়া নদী যার জলে আগে নাকি সোনার দানা পাওয়া যেত। আর আছে নর্মদা উদ্গম যা আসলে নর্মদা নদীর উৎসস্থল। মন্দিরের পাশেই রয়েছে মাই কি বাগিয়াঁ। লোকের বিশ্বাস এখানে নাকি দেবী নর্মদা ফুল তুলতে আসেন নিয়মিত।
এই সতীপীঠে দেবী নর্মদার মূর্তিটি সোনার মুকুট দিয়ে আবৃত থাকতে দেখা যায়। মন্দিরের একেবারে মাঝামাঝি থাকা বেদীটির একেবারে মাঝখানে রয়েছে দেবী নর্মদার একটি মূর্তি, তার চারপাশে দুই মিটারের ব্যবধানে অন্যান্য সকল দেব-দেবীর মূর্তিও সজ্জিত আছে।
প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকেন। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। সতীপীঠ শোন্দেশে দেবী হলেন নর্মদা এবং ভৈরব হলেন ভদ্রসেন।
সতীপীঠ শোন্দেশ মহাশিবরাত্রি পালনের জন্য খুবই বিখ্যাত। এখানে মকর সংক্রান্তি, নবরাত্রি, শারদ পূর্ণিমা, দীপাবলি কিংবা সোমবতী অমাবস্যা, রামনবমী ইত্যাদি উৎসবও মহা ধুমধাম সহকারে পালন করা হয়ে থাকে। মহাশিবরাত্রিকে কেন্দ্র করে এই সতীপীঠে বহু পুণ্যার্থীর সমাগম হয়ে থাকে। ভক্তেরা এই দিন রাত্রিকালীন উপবাস করেন, গভীর মনযোগে শৈব মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে শিবের উপাসনা করা হয় এই দিনে।