শিবকুমার শর্মা

শিবকুমার শর্মা

ভারতীয় সঙ্গীতের সমৃদ্ধশালী ভাণ্ডার যাঁদের মূল্যবান অবদানে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন সঙ্গীতজ্ঞ শিবকুমার শর্মা (Shivkumar Sharma)। ‘সন্তুর’ নামক যন্ত্রটি তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় সঙ্গীতের জগতে একটি স্বতন্ত্র আসন লাভ করেছিল বলা যায়। শিবকুমারের চেষ্টাতেই সন্তুর হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি আবশ্যক যন্ত্র হয়ে উঠতে পেরেছিল। অবশ্য তেমনটা সম্ভব হয়েছে তাঁরই একনিষ্ঠ অধ্যবসায়ের কারণেই। ধ্রুপদী সঙ্গীত ঘরানার জন্য উপযুক্ত করে তুলতে সন্তুর যন্ত্রটিতে প্রয়োজনীয় কিছু পরিবর্তনও করেছিলেন তিনি। যে বাদ্যযন্ত্রটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এলাকায় একেবারেই অপাংক্তেয় সম্ভাবনাহীন হিসেবে গণ্য হতো, তাকেই শিবকুমার জাতে তুলে দিলেন নিজ মেধার স্পর্শে। তিনি বিখ্যাত তবলাবাদক জাকির হুসেন এবং হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার মতো বংশীবাদকদের সঙ্গেও অ্যালবামের কাজ করেছিলেন। সেই অ্যালবাম অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। হিন্দি চলচ্চিত্র জগতকে শিবকুমারের সঙ্গীত সমৃদ্ধ করেছিল। একজন সুরকার হিসেবে ‘চাঁদনী’, ‘লমহে’, ‘সিলসিলা’র মতো বলিউডের অতি জনপ্রিয় সব ছবিতে কাজ করেছিলেন তিনি। আবার একসময় এস. ডি বর্মনের পীড়াপীড়িতে চলচ্চিত্রের গানের সঙ্গে তবলাও বাজিয়েছিলেন তিনি। তবে সিনেমার গানের চেয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তাঁর আকর্ষণ ছিল বেশি। আজীবন সঙ্গীত সাধনার জন্য ‘পদ্মশ্রী’ এবং ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল তাঁকে।

১৯৩৮ সালের ১৩ জানুয়ারি ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে তৎকালীন জম্মুতে শিবকুমার শর্মার জন্ম হয়। তাঁর বাবা উমাদত্ত শর্মা (Uma Dutt Sharma) নিজে ছিলেন বেনারস ঘরানার ঐতিহ্যের একজন সুপরিচিত কণ্ঠশিল্পী এবং প্রতিভাবান তবলা ও পাখোয়াজ বাদক। বেনারসের পণ্ডিত বড়ে রামদাসজীর শিষ্য এবং মহারাজা প্রতাপ সিংয়ের দরবারের ‘রাজপণ্ডিত’ ছিলেন উমাদত্ত। একটি সঙ্গীতময় পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার এবং এত গুণী বাবার সান্নিধ্য লাভের ফলে শিবকুমার সঙ্গীত জগতের সংস্পর্শে এসেছিলেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই উমাদত্ত তাঁর সন্তানকে কন্ঠসঙ্গীত এবং তবলার তালিম দিতে শুরু করেছিলেন। বাবা এবং গুরুর কাছে শিক্ষাগ্রহণ করে মাত্র বারো বছর বয়সেই জম্মু রেডিও স্টেশনে বাজানো শুরু করেছিলেন। সেই কিশোর বয়সেই শিবকুমারের বাবা তাঁকে সন্তুর যন্ত্রটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রায় একশোটি তারযুক্ত মূলত সুফিদের মধ্যে প্রচলিত একটি বাদ্যযন্ত্র ছিল সন্তুর। আগেকার দিনে একে ‘শততন্ত্রী বীণা’ বলা হত। এটি আসলে একপ্রকার লোকযন্ত্র এবং এর উৎসস্থল পারস্য হলেও কাশ্মীরে এই বাদ্যযন্ত্রটির খুবই প্রচলন ছিল। উমাদত্ত ছেলেকে কাশ্মীরী লোকসঙ্গীতের সঙ্গে এই সন্তুর বাজানোর তালিম দিতে থাকেন। তেরো বছর বয়স থেকেই সন্তুর শেখা শুরু করেছিলেন শিবকুমার৷ বাবার উৎসাহেই হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য সন্তুরের ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন তিনি। আসলে এই বাদ্যযন্ত্রটি ধ্রুপদী সঙ্গীত ঘরানায় ছিল অপাংক্তেয়। হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুরেলা সূক্ষ্মতার জন্য যা প্রয়োজন, সন্তুর সে অভাব মেটাতে পারত না। কিন্তু পণ্ডিত উমাদত্ত এই বাদ্যযন্ত্রটির সম্ভাবনা টের পেয়েছিলেন এবং সন্তুরকে বিশ্বের দরবারে একটি স্বতন্ত্র জায়গা দেওয়ার দায়িত্ব নিজের ছেলে শিবকুমারকে দিয়েছিলেন। বাবার স্বপ্নপূরণের জন্যই সন্তুর শিক্ষায় মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন তিনি। শিবকুমার বিবাহ করেছিলেন মনোরমাকে (Manorama)। তাঁদের পুত্রের নাম রাহুল শর্মা। রাহুলও একজন জনপ্রিয় সন্তুর বাদক। বাবার সঙ্গে প্রায় অধিকাংশ অনুষ্ঠানে তিনিও অংশগ্রহণ করতেন।

১৯৫৫ সালে বম্বেতে প্রথম জনসমক্ষে সন্তুর পরিবেশন করেছিলেন শিবকুমার। সেখানে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিলেন তিনি। তার পরবর্তী বছর তিনি ‘ঝনক ঝনক পায়েল বাজে’ নামক ছবির একটি দৃশ্যের জন্য আবহ সঙ্গীত নির্মাণ করে বেশ একটু পরিচিতি লাভ করেছিলেন শিবকুমার শর্মা। তবে ১৯৬০ সালে যখন প্রথম একক অ্যালবাম রেকর্ড করেন তিনি, তখন জনমানসে তাঁর সঙ্গীত প্রতিভা একটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। মানুষের কাছে শিবকুমার শর্মা নামটি ক্রমে পরিচিতি পেতে থাকে। ১৯৬৭ সালে প্রখ্যাত বংশীবাদক হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া এবং ব্রীজভূষণ কাবরার সঙ্গে জুটি বেঁধে একটি কনসেপ্ট অ্যালবাম ‘কল অফ দ্য ভ্যালি’ তৈরি করেছিলেন তিনি। এই সৃষ্টি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতের এক মহামূল্যবান সম্পদ হয়ে রয়েছে। এই অ্যালবাম সঙ্গীত জগতে শিবকুমারের একটি পাকা আসন তৈরি করে দিয়েছিল।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার সঙ্গে পরবর্তীকালে বহু স্মরণীয় কাজ করেছিলেন শিবকুমার। তাঁদের জুটিটি ‘শিব-হরি’ নামে পরিচিত ছিল। ‘জাদু তেরি নজর’, ‘মেরে হান্থো মে’, ‘মেঘা রে মেঘা রে’-র মতো বহু হিট গানের নেপথ্যে ছিল এই জুটি। ‘সিলসিলা’, ‘ফাসলে’, ‘চাঁদনী’, ‘লমহে’, ‘ডর’-এর মতো জনপ্রিয় সব বলিউডের ছবিতে শিব-হরি জুটির সাঙ্গীতিক অবদান আজও সঙ্গীতপ্রেমীদের সমাদর লাভ করে।

সন্তুর বাদ্যযন্ত্রটির প্রতি অধিক মনোনিবেশ করবার জন্য তবলা বাজানো একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছিলেন শিবকুমার। কিন্তু আর. ডি বর্মনের একান্ত অনুরোধে ‘মোসে ছল কিয়ে যায়ে হায় রে হায়’ গানটির জন্য শেষবারের মতো তবলা বাজাতে রাজি হয়েছিলেন তিনি। এরপর সম্পূর্ণরূপে সন্তুর নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মগ্ন থেকেছেন শিবকুমার। প্রায় অপাংক্তেয় সন্তুরকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ঘরানার বাদ্যযন্ত্রে রূপান্তরিত করে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন তিনি। তবে এই কাজ করবার জন্য অনেক চিন্তা করেই বেশ কিছু পরিবর্তন করেন শিবকুমার এই যন্ত্রটিতে। তিনি সাঙ্গীতিক তান বা নোটের নতুন ক্রোম্যাটিক বিন্যাস প্রবর্তন করেন এবং এর পরিসরকে পূর্ণ তিনটি অক্টেভ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন। এছাড়াও মানবকন্ঠের মানের অনুকরণের জন্য সাঙ্গীতিক নোটগুলির মধ্যে স্বচ্ছন্দ এবং সুষম নমনীয়তা আনয়নের উদ্দেশ্যে একটি কৌশলও তৈরি করেছিলেন। সন্তুর বাজানোর একটি নতুন উপায়ও বের করেছিলেন শিবকুমার শর্মা যাতে নোট অর্থাৎ তান এবং শব্দের ধারাবাহিকতা দীর্ঘ সময়ের জন্য বজায় রাখা যায়। এমনই সব পরিবর্তনের মাধ্যমে যন্ত্রটিকে হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি বাদ্যযন্ত্রে পরিণত করেছিলেন শিবকুমার। এই পরিবর্তনের ফলস্বরূপ বর্তমানে যে সন্তুর বাজানো হয়, তাতে লক্ষ্য করা যায় মোট ৯১টি স্ট্রিং এবং ৩১টি সেতু রয়েছে। জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় জুড়েই সন্তুরের ওপর অসংখ্যা উদ্ভাবনী অ্যালবাম প্রকাশ করেছিলেন তিনি। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘দ্য গ্লোরি অফ স্ট্রিংস- সন্তুর’, ‘বর্ষা- আ হোমেজ টু দ্য রেইন গডস’, ‘হান্ড্রেড স্ট্রিংস অফ সন্তুর’, ‘দ্য পাইওনিয়ার অফ সন্তুর’, ‘সম্প্রদায়’, ‘ভাইব্রেন্ট মিউজিক ফর রেইকি’, ‘এসেনশিয়াল ইভনিং চ্যান্টস’, ‘দ্য লাস্ট ওয়ার্ড ইন সন্তুর’ ‘দ্য এলিমেন্টস : ওয়াটার’, ইত্যাদি।

শিবকুমারের কাছে জাপান, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ইত্যাদি বিভিন্ন দেশ এবং ভারতের নানা প্রান্ত থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা সন্তুর শিখতে আসতেন। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, তিনি কারও থেকেই কোনও সাম্মানিক গ্রহণ করতেন না। ২০০২ সালে তাঁর আত্মজীবনী ‘জার্নি উইথ আ হান্ড্রেড স্টিংস : মাই লাইফ ইন মিউজিক’ প্রকাশিত হয়।

সঙ্গীতের ক্ষেত্রে অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য শিবকুমারকে নানা সময়ে বিভিন্ন সম্মানীয় খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অ্যালবাম ‘কল অফ দ্য ভ্যালি’, ১৯৮১ সালের সিনেমা ‘সিলসিলা’ এবং ১৯৮৯ সালের ছবি ‘চাঁদনী’র সঙ্গীত, প্রত্যেকটির জন্য শিবকুমার শর্মা ‘প্ল্যাটিনাম ডিস্ক’ পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৮৫ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর শহরের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব লাভ করেন। শিল্পীদের অনুশীলনের জন্য প্রদান করা সর্বোচ্চ ভারতীয় স্বীকৃতি ‘সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার’ পান তিনি ১৯৮৬ সালে। ১৯৯০ সালে তাঁকে ‘মহারাষ্ট্র গৌরব পুরস্কারে’ সম্মানিত করা হয়। পরবর্তী বছর জম্মু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধি প্রদান করেছিল। ১৯৯১ সালে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় শিবকুমারকে। ১৯৯১-এর ছবি ‘লমহে’ এবং ১৯৯৩-এর ‘ডর’ চলচ্চিত্রের জন্য ‘স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড ফর আউটস্ট্যান্ডিং মিউজিক অ্যান্ড সেল অফ ফিল্ম’ সম্মান লাভ করেন তিনি৷ ১৯৯৮ সালে শিবকুমার শর্মা পান ‘উস্তাদ হাফিজ আলি খান পুরস্কার’। ২০০১ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘পদ্মবিভূষণ’-এর প্রাপক হন শিবকুমার শর্মা।

২০২২ সালের ১০ মে মুম্বাইতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়ে পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার মৃত্যু হয়।

2 comments

আপনার মতামত জানান