ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু

শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কৌরবসভায় শ্রীকৃষ্ণের আগমন

মহাভারতের উদ্যোগপর্বে ৯৪তম অধ্যায় থেকে ১২৯তম অধ্যায় জুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কৌরবসভায় শ্রীকৃষ্ণের আগমন সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। পান্ডবদের তেরো বছরের বনবাস শেষ হওয়ার পর তাঁরা নিজেদের রাজ্য ফিরে পাওয়ার উপায় খুঁজতে লাগলেন। তখন পান্ডব ও কৌরবদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করার শেষ চেষ্টা হিসাবে শ্রীকৃষ্ণ ঠিক করলেন যে তিনিই পান্ডবদের দূত হয়ে হস্তিনাপুরে যাবেন এবং পান্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দুর্যোধনকে অনুরোধ করবেন এবং এই উপলক্ষেই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কৌরবসভায় শ্রীকৃষ্ণের আগমন ।

সেইমত কৃষ্ণ উপপ্লব্য নগর থেকে হস্তিনাপুরের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। যেতে যেতে তিনি রাস্তায় দেখতে পেলেন অনেক মুনি, ঋষি, ও ব্রাহ্মণেরা হস্তিনাপুরের দিকে চলেছেন।। তাঁদের প্রশ্ন করে কৃষ্ণ জানতে পারলেন যে, তাঁকে দেখার জন্যই সকলে হস্তিনাপুরে চলেছে। হস্তিনাপুরে পৌঁছানোর পর ধৃতরাষ্ট্রদুর্যোধন তাঁকে সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা করলেন। দুর্যোধন কৃষ্ণের জন্য ভালো ভালো খাবার এবং সুন্দর থাকার জায়গার ব্যবস্থা করেছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণ রাজপুরীতে থাকলেন না। সেই রাতে তিনি বিদূর বাড়িতে খেলেন এবং সেখানেই থাকলেন। পরদিন সকালে স্নান ইত্যাদি প্রাতঃকর্ম সেরে তিনি রাজসভায় এলেন। কৃষ্ণ রাজসভায় আসা মাত্রই সবাই চুপচাপ হয়ে তাঁর দিকেই তাকিয়ে রইলেন।

কৃষ্ণ তখন দুন্দুভির মত মধুর ও গম্ভীর স্বরে বলতে লাগলেন, “মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র! যাতে কোনো ক্ষতি ছাড়াই কৌরব ও পান্ডবদের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়, সেই চেষ্টা করার জন্যই আমি আজ হস্তিনাপুরে এসেছি। আপনি তো সবই জানেন! আমি আপনার মঙ্গলের জন্যই শান্তি চাই। সমস্ত পৃথিবীর সব রাজকুলের মধ্যে এই কুরুবংশই শ্রেষ্ঠ। দুঃস্থের প্রতি কৃপা, শোকার্তের প্রতি করুণা, সরলতা, সহৃদয়তা, ক্ষমা, সত্য ইত্যাদি গুণের জন্যই এই বংশ শ্রেষ্ঠ। তাই মহারাজ! এই বংশের ধ্বংসের কারণ আপনি হবেন না। সবাই আশা করে কোনো অন্যায় হলে আপনি তার প্রতিবাদ করবেন। দয়া করে দুর্যোধন এবং বাকি কৌরবদের সংযত হতে বলুন। আমি বিশ্বাস করি, আপনি এবং আমি চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারব। পান্ডবদের সাথে সন্ধি করলে আপনারই লাভ হবে। পান্ডব ও কৌরব পক্ষের সব বীররা একসঙ্গে থাকলে দুনিয়ার কোনো শক্তি হস্তিনাপুরকে হারাতে পারবে না। আর মহারাজ! ভেবে দেখুন, যুদ্ধে যে পক্ষই জয়লাভ করুক না কেন, আপনি কিন্তু কষ্টই পাবেন। আপনি পান্ডবদের গুরুজন, এই বিপদের সময় তাদের রক্ষা করুন। আপনি আপনার কর্তব্য করুন।
“মহারাজ! পান্ডবরা আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘আমরা আপনার আদেশমতই অনুচরদের সঙ্গে দুঃখ ভোগ করেছি। আমরা বারো বছর বনবাসে এবং এক বছর অজ্ঞাতবাসে কাটিয়েছি। আমরা আমাদের শপথ পালন করেছি, এবার আপনি আপনার শপথ পালন করুন। আপনি আমাদের গুরুর মত। আমরা শিষ্যের কর্তব্য করেছি, এখন আপনি গুরুর কর্তব্য করুন। আমাদের ধর্মে ও সৎপথে রাখুন, নিজেও ধর্মের পথে থাকুন।’ “এই সভাকে উদ্দেশ্য করে পান্ডবরা বলেছেন, ‘ধর্মজ্ঞানী সভাসদদের অধর্মের কাজ করা উচিত নয়। যে সভায় অন্যায় হয়, কিন্তু সভাসদরা তার প্রতিবাদ করেন না, সেখানে সভাসদরাও অধর্মাচারী হন এবং ধর্মই তাঁদের নষ্ট করে।’ “মহারাজ! আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি ধর্মপথ থেকে বিচ্যুত হবেন না। পান্ডবদের প্রাপ্য সম্পদ তাদের ফিরিয়ে দিন। আপনি তাঁদের বনবাসে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা আপনার আশ্রয়েই বাস করতে চান। তাঁরা কখনো আপনাকে অতিক্রম করতে চাননি। আপনি নিজের লোভী ছেলেদের শান্ত করুন। পান্ডবরা আপনার সেবা করতে রাজি আছেন, আবার যুদ্ধ করতেও রাজি আছেন। এবার আপনার যেটা ঠিক মনে হয় সেটাই করুন।”

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

এই পর্যন্ত বলে কৃষ্ণ চুপ করলেন। সভ্যেরা সবাই মাথা নামিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। মনে মনে সবাই কৃষ্ণের প্রশংসা করছিলেন এবং তাঁর কথায় সমর্থন জানাচ্ছিলেন, কিন্তু কেউই প্রথমে কথা বলার সাহস পেলেন না। সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে মহর্ষি পরশুরাম উঠে দাঁড়িয়ে সার্বভৌম রাজা দম্ভোদরের কাহিনী শুনিয়ে বললেন, “প্রাচীনকালে নর ও নারায়ণ নামে সর্বলোকের অপরাজেয় দুই ঋষি ছিলেন। তাঁরাই বর্তমানে কৃষ্ণ ও অর্জুন রূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাই তাঁদের হারাবার ক্ষমতা কারোর নেই। আপনি পান্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করুন। এতে সবারই মঙ্গল হবে।” পরশুরামের পর মহর্ষি কণ্বও একই কথা বললেন এবং দুর্যোধনকে শান্ত হওয়ার এবং পান্ডবদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার উপদেশ দিলেন। কিন্তু দুর্যোধন হাসতে হাসতে নিজের ঊরুতে চাপড় মারতে লাগলেন এবং বললেন, “মহর্ষি! বিধাতা আমাকে যেমনভাবে গড়েছেন, যেমনভাবে চালাচ্ছেন, আমি সেভাবেই চলছি। আপনার এই উপদেশ শুনে আমার কী লাভ হবে?”

দেবর্ষি নারদও দুর্যোধনকে বিশ্বামিত্র, গরুড়, গালব প্রভৃতির কাহিনী শুনিয়ে উপদেশ দিলেন শান্ত হওয়ার। তখন ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “দেবর্ষি! আপনারা সবাই যা বললেন, আমিও তাই চাই। কিন্তু দুর্যোধন আমার এবং অন্যান্য গুরুজনদের কোনো কথা শোনে না। হে কৃষ্ণ! আপনিই দুর্যোধনকে অনুরোধ করে যুদ্ধ থেকে বিরত করবার চেষ্টা করুন। তাহলে আমার বন্ধুর কাজ হবে।”

তখন শ্রীকৃষ্ণ দুর্বিনীত দুর্যোধনকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে তিনি অন্যায় করছেন। অনেকবার অনুরোধ করলেন পান্ডবদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দিয়ে তাঁদের সাথে মিটমাট করে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তবুও দুর্যোধন মানলেন না। তিনি বললেন, “আমরা তো পান্ডবদের কোনো ক্ষতি করিনি। ন্যায্যভাবে পাশাখেলায় হারিয়ে তবেই আমরা রাজ্য পেয়েছি। এখন আমরা কেন পান্ডবদের সামনে নিচু হব? ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ এঁরা সবাই থাকতে আমার কোনো ভয় নেই। দেবতারাও এঁদের হারাতে পারেন না, তো পান্ডবরা কী করবে? আপনি শুনে রাখুন মাধব! খুব সরু সূঁচের আগায় যেটুকু মাটি ওঠে, তার অর্ধেকও আমি বিনা যুদ্ধে পান্ডবদের দেব না।”

তখন কৃষ্ণ রেগে গিয়ে দুর্যোধনকে বললেন, “খুব তাড়াতাড়ি তুমি নিজের কাজের সাজা পাবে। তুমিই এই সকল ঘটনার জন্য দায়ী। প্রথম থেকেই তুমি পান্ডবদের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছ। বিষ দিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে নানাভাবে তুমি পান্ডবদের মারতে চেয়েছ। তোমার পরামর্শেই ধূর্ত শকুনি পাশাখেলার ছল করে পান্ডবদের রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তুমি রাজসভায় সবার সামনে দেবী দ্রৌপদীকে অপমান করেছিলে। তাঁকে যে সমস্ত নোংরা কথা তুমি বলেছিলে তা কি তুমি অস্বীকার করতে পারবে? তুমি নিজে অন্যায় করেছ, এখন আমাদের সবাইকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছ। একে তোমার বুদ্ধির দোষ ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? তোমার সব কাজই অধর্মের হচ্ছে।”
এই কথা শুনে খুব রেগে গিয়ে সাপের মত নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে দুর্যোধন সভা ছেড়ে চলে গেলেন। দুঃশাসন, কর্ণ প্রভৃতিরাও তাঁর পিছুপিছু সভা থেকে বেরিয়ে গেলেন।

তখন কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি প্রভৃতিকে বন্দি করে পান্ডবদের সাথে সন্ধি করতে উপদেশ দিলেন। কারণ জ্ঞানীদের মতে, কুলকে বাঁচাবার জন্য একটি লোককে, গ্রামকে বাঁচাবার জন্য কুলকে এবং নিজেকে বাঁচাবার জন্য প্রয়োজনে পৃথিবীকেও ত্যাগ করা উচিত। তাই ধৃতরাষ্ট্র যেন নিজের একটি ছেলেকে ত্যাগ করে এই বংশকে রক্ষা করেন। ধৃতরাষ্ট্র তখন বিদুরকে আদেশ করলেন গান্ধারীকে সভায় ডেকে আনার জন্য। বাবা এবং মা দুজনের অনুরোধই যদি দুর্যোধন না শোনে, তবে কৃষ্ণের কথামত কাজ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। গান্ধারী সভায় এসে সকল কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্রকেই দোষ দিতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধ স্নেহই যে এই সব কিছুর জন্য দায়ী, একথা তিনি বারবার বললেন। তারপর বিদুর গিয়ে আবার দুর্যোধনকে সভায় ডেকে আনলেন।

দুর্যোধন সভায় এলে গান্ধারী মিষ্টি কথায় তাঁকে কৃষ্ণ এবং গুরুজনদের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করলেন। কিন্তু মায়ের উপদেশ বা অনুরোধ কোনোটাই দুর্যোধন গ্রাহ্য করলেন না। তিনি আবার সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন এবং দুঃশাসন, কর্ণ প্রভৃতির সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণকে বন্দি করার ফন্দি আঁটতে লাগলেন। কারণ কৃষ্ণ যদি বন্দি হন, তবে পান্ডবদের উদ্যম নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু দরজার বাইরে থেকে সাত্যকি এইসব কথা শুনে ফেললেন। তিনি তাড়াতাড়ি সভায় এসে সকলকে একথা জানালেন। ধৃতরাষ্ট্র, বিদূর প্রভৃতিরা এই ভয়ানক কথা শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। বিদুর আবার গিয়ে ভাইদের সঙ্গে দুর্যোধনকে সভায় ডেকে আনলেন। ধৃতরাষ্ট্র এবং সকল সভ্যেরা দুর্যোধনকে বারবার বারণ করতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণকে বন্দি করার চেষ্টা জ্বলন্ত আগুন নিয়ে খেলা করার মত। দুর্যোধন যেন কোনোভাবেই এই ভয়ঙ্কর কাজ না করেন।

তখন শ্রীকৃষ্ণ জলভরা মেঘের ডাকের মত গম্ভীর কণ্ঠে দুর্যোধনকে বললেন, “দুর্মতি দুর্যোধন! তুমি ভেবেছ আমি এখানে একা আছি। তাই তুমি এই সুযোগে আমাকে বন্দি করতে চাও? কিন্তু তুমি ভুল করছ, আমি একা নই। পান্ডবদের সঙ্গে সকল দেবতা, যক্ষ, রাক্ষস সকলেই এখানে আছে।” এই বলে শ্রীকৃষ্ণ সারা সভা কাঁপিয়ে বিকট শব্দ করে হেসে উঠলেন। তারপর কৃষ্ণ নিজের বিশ্বরূপে সকলের সামনে আবির্ভূত হলেন। তাঁর বিশাল শরীর আগুনের মতো জ্বলতে লাগল এবং সকল দেবতা এবং দানবকে তাঁর শরীরের মধ্যে দেখা যেতে লাগল। মহাত্মা কৃষ্ণের এই ভীষণ ভয়ঙ্কর রূপ দেখে দুর্যোধন এবং সকল কৌরবরা ভয়ে কেঁপে উঠলেন। মুনি-ঋষিরা ভয় না পেয়ে চিৎকার করে কৃষ্ণের স্তব করতে লাগলেন। এই সময় ধৃতরাষ্ট্র তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছিলেন এবং শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দেখেছিলেন।

তখন সবাই মিলে কৃষ্ণকে তাঁর নিজের রূপে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন, কারণ তাঁর বিশ্বরূপের তেজে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। সবার অনুরোধে কৃষ্ণ মানুষের রূপে ফিরে এলেন এবং সবার অনুমতি নিয়ে সাত্যকি ও বিদূরের হাত ধরে সভা ছেড়ে চলে গেলেন। এই হল শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কৌরবসভায় শ্রীকৃষ্ণের আগমন এর আসল কারণ।

তথ্যসূত্র


  1. মহাভারত’, উদ্যোগপর্ব, কালীপ্রসন্ন সিংহ, ‘অধ্যায় ৯৪-১২৯, পৃষ্ঠা ২০৩-২৩৯
  2. ‘মহাভারতের একশোটি দুর্লভ মুহূর্ত', ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, দ্বিতীয় মুদ্রণ, কৌরব সভায় শ্রীকৃষ্ণ, পৃষ্ঠা ৩৬১-৩৭৪

আপনার মতামত জানান