বাঙালিদের পাহাড় ভ্রমণ মানেই তো সবার আগে দার্জিলিং। কিন্তু যুগ বদলাচ্ছে, নতুন প্রজন্ম খুঁজে নিচ্ছে আরও নতুন ভ্রমণের স্থান। দার্জিলিং-এর মধ্যে এমনই এক মনভোলানো পার্বত্য-প্রকৃতির শোভা নিয়ে ভ্রমণবিলাসীদের অপেক্ষায় থাকে সিটং। কার্শিয়াং পরগণার অন্তর্গত এই সিটং আসলে একটি খাসমহল। শীতের সঙ্গে সঙ্গেই আসে কমলালেবুর পসরা আর এই কমলালেবু মানেই দার্জিলিংয়ের সিটং। সিটংকে অনেকে কমলালেবুর দেশও বলে থাকেন। কমলা-কোয়ার মতো নরম কোমল রোদে সিটং-এর সব বাড়িঘর, সবুজ পাহাড় কেমন যেন এক মায়াবী রূপ নেয়। গতে বাঁধা গন্তব্যের বাইরে বেরিয়ে নতুনের স্বাদ নিতে সিটং ভ্রমণের এক আদর্শ জায়গা।
দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত শহর মংপু থেকে মাত্র আট কিলোমিটার এবং মহানন্দা অভয়ারণ্য থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত সিটং। দার্জিলিংয়ের পার্বত্য নদী রিয়াং-এর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে এই ছোট্ট গ্রাম। মূলত দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলের পূর্ব দিকে সমুদ্রতল থেকে চার হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত সিটং-এর মধ্যে তরাইয়েরও কিছু অংশ পড়েছে। কার্শিয়াং, কালিম্পং, সিকিম ও ভুটান ঘিরে রয়েছে সিটং গ্রামটিকে।
সিটং গ্রামের নিজস্ব ইতিহাস বলতে সেভাবে কোন ঐতিহ্য না থাকলেও কাছেই মংপু শহরটির ইতিহাসে জড়িয়ে আছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাহিত্যিক মৈত্রেয়ী দেবী এবং তাঁর স্বামী মনমোহন সেনের বাড়ি ছিল এখানে। বাড়ি নয়, বলা ভাল বাংলো। এই বাংলোতেই গ্রীষ্মকালে মাঝে মধ্যে আসতেন রবীন্দ্রনাথ। এই বাড়িটি এখন ‘রবীন্দ্র ভবন’ নামে হেরিটেজে পরিণত হয়েছে। ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ নামে মৈত্রেয়ী দেবী একটি বিখ্যাত বইও লিখেছিলেন। ২০১৮ সালে এখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে স্থাপিত হয় একটি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা। এছাড়া আপার সিটং-এ শতাব্দীপ্রাচীন এক গুম্ফা আর একটি প্রাচীন গির্জা কোন এক অজানা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। আগে নাকি এই গুম্ফা বাঁশ আর মাটি-কাদা দিয়ে তৈরি হয়েছিল, পরে তা সিমেন্ট দিয়ে পাকা করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দার্জিলিং কমলালেবু উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত, একথা আমাদের অনেকেরই জানা। কার্শিয়াং এবং আরও উত্তরের অঞ্চলগুলি থেকে অধিকাংশ কমলালেবু আসে। সিটং এই কার্শিয়াং-এর অন্তর্গত একটি খাসমহল অর্থাৎ অনেকগুলি গ্রামের সম্মিলিত রূপ। শীতকাল মানেই কমলালেবু আর সেই সময় সিটং ভরে ওঠে কমলালেবুর অপরূপ শোভায়। নির্জন শান্ত এই গ্রামে খানিকটা একা একা বিজনে কাটানোর মুহূর্ত উপভোগ করা যায়। সিটং যেন শিল্পীর হাতে আঁকা ছবি। ছবির মত অপরূপ সুন্দর এখানকার গ্রামগুলো, তার সঙ্গে মায়াবি প্রকৃতি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে পাহাড়ের কোলে। কমলালেবুর বাগান আর সবুজ স্বপ্নিল পাহাড়ের মাঝে বয়ে যাওয়া রিয়াং নদী যেন উচ্ছ্বল কিশোরী এক। এই নদীর উপর তৈরী হয়েছে যোগীঘাট সেতু। অনেকে বলেন যোগী বাবা রামদেব এই সেতুর উদ্বোধনে এসেছিলেন বলে তাঁর এই নাম। লেপচাদেরই বাস এখানে, তাদের প্রতিটি বাড়িতেই দেখা যাবে কমলালেবুর গাছ। মানুষের থেকেও এখানে হয়ত বা কমলালেবুর বাগানের সংখ্যাই বেশি। কমলালেবুর অদ্ভুত রঙের শোভায় শীতের সিটং পর্যটকদের চোখে টেনে দেয় মায়াকাজল। তাছাড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা তো রয়েছেই। চিরপ্রশান্তির বার্তা নিয়ে মহান সন্ন্যাসীর মতো সে দাঁড়িয়ে থাকে। পাহাড়ে সন্ধ্যা নামে দ্রুত। আসন্ন সন্ধ্যার আকাশে পাখিদের কূজন আর ঘরে ফেরার ব্যস্ততা দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের জন্য বাড়ির প্রিয়জনদের কথা মনে পড়বে হয়ত।
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে সড়কপথই সিটং পৌঁছানোর সবথেকে সহজ উপায়। তাছাড়া দার্জিলিং কিংবা কালিম্পং থেকেও এখানে আসা যায়। পশ্চিমবঙ্গের যে কোন জেলা থেকে ট্রেনে করে প্রথমে নিউ জলপাইগুড়িতে নেমে সেখান থেকে সড়কপথে গাড়ি করে সিটং-এ আসা যায়। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে মাত্র ৫৪ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সিটং যাওয়ার দু’রকম রাস্তা আছে। শিলিগুড়ি থেকে সেবক-কালিঝোরা পেরিয়ে একভাবে যাওয়া যায় সবথেকে কম সময়ে। নাহলে শিলিগুড়ি থেকে রামভি ও মংপু হয়েও যাওয়া যায়, তবে এই পথে সময় একটু বেশি লাগে। কার্শিয়াং থেকে আসতে চাইলে দিলারাম-বাগোরা হয়ে ঘারেতার ছেড়ে পেরিয়ে আসতে হবে ৭৫ কিলোমিটারের দূরত্ব। সড়কপথের অবস্থা অত্যন্ত সুন্দর, ফলে যাত্রাপথে সেভাবে কোন অসুবিধা হয় না। শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ভাড়া মোটামুটিভাবে ৩০০০ থেকে ৩৫০০ টাকা।
সিটং-এ হোম-স্টের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু এছাড়াও সিটং-এর কাছেই ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে কার্শিয়াং ট্যুরিস্ট লজ। যদিও এর নাম এখন রৌদ্র ছায়া ট্যুরিজম প্রপার্টি যা পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগমের অধীনে রয়েছে। কার্শিয়াং-এ থাকলে সেখানকার আশেপাশের জায়গা ঘুরে দেখে একদিন সিটং-এ চলে আসা যায়। সিটং চার্চের নিজস্ব গেস্ট হাউজও রয়েছে। এছাড়া বেশ কিছু কটেজও রয়েছে থাকার জন্য। শীতকালে আসতে হলে আগে থেকে বুকিং করে নেওয়াই উচিত। তবে বারান্দা থেকে পাহাড় দেখা যায় এমন জায়গায় থাকলে ঘোরার আনন্দের মাত্রাটাই পালটে যায়। চোখের সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে ভাবনায় ডুব দিতেই পারেন। হোম-স্টে গুলিতে থাকার ভাড়া মাথাপিছু প্রতি রাত ১০০০ টাকার মতো। তবে হোটেল অনুযায়ী এই ভাড়া পরিবর্তিত হয়, আগে থেকে খোঁজ নিয়ে ভাড়া স্থির করে তবেই বুকিং করা উচিত।
সিটং-এর গ্রাম, কমলালেবুর বাগানই মূলত এখানকার বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যে পড়ে। তাছাড়া ঐ প্রাচীন গুম্ফা, গির্জা, লেপচাদের গ্রাম, অর্কিডের বাগান, রিয়াং নদী অবশ্য দ্রষ্টব্য। হাতে সময় থাকলে রিয়াং নদীর ধারে ছোট্ট করে একটা পিকনিকও সেরে নেওয়া যায়। নদীর কুলুকুলু শব্দে মন যেন অন্য কোন অচিনপুরে পাড়ি দেয়। সাইটসিইং-এর মধ্যে পড়বে নিকটবর্তী লাটপাঞ্চার এবং মহানন্দা অভয়ারণ্য। পাখি দেখতে যারা ভালোবাসেন তাদের তো আসতেই হবে লাটপাঞ্চারে, পাখিদের স্বর্গ বলা চলে একে। যারা একটু রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটক তাদের জন্য পর্বতারোহণের ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ট্রেক করে অনায়াসে চলে যাওয়া যায় চটকপুর গ্রামে, বাগোরায় কিংবা কার্শিয়াং-এ। বাগোরা যেতে হলে মামরিং-এর পথ ধরতে হবে আর কার্শিয়াং পৌঁছাতে হলে পেরোতে হবে মাউজা আর মহলদিরামের পাহাড়। পাহাড়ে উঠলে অনায়াসে নজর কাড়বে কাঞ্চনজঙ্ঘা, নেপাল, ভুটানের উঁচু উঁচু সব পাহাড়। মনে রাখতে হবে এখানে শীতকালে যথেষ্ট বেশি ঠাণ্ডা পড়ে, তাই উপযুক্ত শীতবস্ত্র অবশ্যই সঙ্গে রাখা দরকার।
বছরের যে কোনো সময়েই সিটং আসা যায়। কিন্তু সবসময় তো আর কমলালেবুর বাগানের শোভা দেখা যাবে না। তাই কমলালেবুর বাগান দেখতে চাইলে আসতে হবে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে। ঐ সময়ই সিটং-এর সমস্ত গাছ গাছালি কমলালেবুতে ভরে ওঠে। তবে বর্ষাকাল সর্বাগ্রে এড়িয়ে চলা উচিত। গাছে গাছে কমলালেবু ধরে আছে দেখলে কার না লোভ হয়! সেক্ষেত্রে গ্রামবাসীদের অনুমতি নিয়ে যদি দু-চারটি লেবু খাওয়ার সুযোগ ছাড়া উচিত নয়।

ট্রিপ টিপস
- কীভাবে যাবেন – শিলিগুড়ি বা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গাড়ি করে সড়কপথে আসাই সবথেকে ভালো। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে কোনো ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছাতে হবে। তারপর সবথেকে কক সময়ে সেবক-কালিঝোরা পেরিয়ে সিটং পৌঁছানো যায়। তবে শিলিগুড়ি থেকে রামসিয়া ও মংপু হয়েও সিটং-এ আসা যায় আর কার্শিয়াং থেকে আসতে চাইলে দিলারাম-বাগোরা-ঘারেতার হয়ে আসতে হবে এখানে।
- কোথায় থাকবেন – থাকার জন্য প্রচুর হোম স্টে রয়েছে। তাছাড়া কার্শিয়াং-এর সরকারি ট্যুরিস্ট লজআছে এবং আপার সিটং-এ কিছু কটেজও রয়েছে। মোটামুটি ভাড়া জনপ্রতি ১০০০ টাকা এক রাতের জন্য। তবে হোটেল অনুযায়ী ভাড়া কমবেশি হতে পারে।
- কী দেখবেন – সিটং-এর লেপচাদের গ্রাম, কমলালেবুর বাগান তো অবশ্য দ্রষ্টব্য। তাছাড়া পুরনো গুম্ফা, গির্জাও দেখা যায়। নিকটবর্তী মহানন্দা অভয়ারণ্য এবং লাটপাঞ্চার দেখে আসা যায় সাইটসিইং হিসেবে। তাছাড়া রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটকেরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে ট্রেক করতে পারেন।
- কখন যাবেন – সিটং-এর কমলালেবুর বাগানের শোভা উপভোগ করার জন্য নভেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে এখানে আসাই সবথেকে ভালো। বর্ষাকালে না আসাই ভালো।
- সতর্কতা –
- শীতে আসতে গেলে আগে থেকে হোটেল বুকিং করে রাখা দরকার।
- হোটেলই হোক বা হোম-স্টে কিংবা কটেজ বুকিং-এর সময় সুবিধা-অসুবিধার দিকগুলি বিবেচনা করে ভাড়া স্থির করে নিতে হবে।
- বিশেষ পরামর্শ – কমলালেবুর বাগান দেখতে দেখতে যদি দু-চারটি কমলালেবু খাওয়ারও সুযোগ পাওয়া যায় তাহলে তা ছাড়া উচিত হবে না।