সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়

সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়

বীরভূমের ভূমিপুত্র ডা: সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় (Sushovan Bandopadhyay) সমগ্র শান্তিনিকেতনের জনসাধারণের কাছে ‘এক টাকার ডাক্তার’ নামেই পরিচিত। ইংল্যাণ্ডের শেফিল্ডের ভালো বেতনের নিশ্চিন্ত চাকরির মায়া ত্যাগ করে দরিদ্র মানুষের সেবায় নিজের সারাজীবন উৎসর্গ করেছেন তিনি। ৫৭ বছর ধরে মাত্র এক টাকা ভিজিটের বিনিময়ে রোজ প্রায় দেড়শো জন করে রোগী দেখার মহান কাজ গড়েছে ‘গিনেস ওয়ার্ল্ড রের্কড’। বীরভূমের ‘অগ্নীশ্বর’ ডা. সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানেও ভূষিত হয়েছেন।

১৯৩৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সালে বীরভূমে সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় -এর জন্ম হয়। তাঁর বাবা বিনয়কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বীরভূমের জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ইনস্পেক্টর। ছোট থেকেই তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী।

বোলপুর নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়ে সুশোভনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। এরপরে বিশ্বভারতীর পাঠভবন থেকে পাশ করে ১৯৪৮ সালে তিনি বোলপুর স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে এই স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরে কলকাতার আর. জি. কর মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। ইন্টার্নশিপ করতে তিনি শান্তিনিকেতনের হাসপাতালে ফিরে আসেন। ১৯৬২ সালে আর. জি. কর মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন তিনি। ১৯৬৯ সালে প্যাথোলজিতে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হয়ে স্বর্ণপদক পান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এই সময় তিনি অস্ট্রেলিয়ায় চাকরিসূত্রে সেখানকার নাগরিকত্বের সুযোগ পান। কিন্তু তাঁর বাবা-মায়ের আপত্তির কারণে তিনি সেখানে যেতে পারেনি। এরপরে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯৭২ সালে লণ্ডনে চলে যান সুশোভন এবং সেখান থেকে হেমাটোলজিতে ডিপ্লোমা করেন। ১৯৭৮ সালে ইংল্যাণ্ডের শেফিল্ড কোম্পানির বড় অঙ্কের চাকরি এবং সুনিশ্চিত জীবনকে প্রত্যাখ্যান করে দেশে ফিরে আসেন তিনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ইংল্যাণ্ডে ছাত্র থাকাকালীন হাউসস্টাফ থেকে সিনিয়র রেজিস্ট্রার পদে উন্নীত হয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় -এর বাবা-মা তাঁকে উৎসাহিত করেছিলেন দেশের গরীব মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। তিনি তাঁদের জীবনদর্শন সারাজীবন মেনে চলার চেষ্টা করেছেন। তখন তাঁর চোখে ছিল উজ্জ্বল জীবনের হাতছানি। সেই সময় তিনি হেমাটোলজির অধ্যাপক ডা. লরেন্সের সাহচর্যে আসেন এবং ইংল্যাণ্ডে তাঁর অধীনেই সুশোভনবাবু কাজ করতেন। তাঁর প্রশিক্ষণপর্বের শেষদিকে ডা. লরেন্স ইংল্যাণ্ড ছেড়ে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া দেশ আফ্রিকার ঘানায় চলে যান সেবাকর্মের ব্রত নিয়ে, সেখানে প্রয়োজন ছিল তাঁর মতো নিবেদিতপ্রাণ মেধাবী ডাক্তারের। ডা. লরেন্স জীবনের শেষদিন পর্যন্ত গরীব এবং অসহায় ব্যক্তিদের সেবার উদ্দেশ্যে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন যা সুশোভনবাবুর জীবনে এক পরিবর্তন আনে। তিনি ডা. লরেন্সের মতাদর্শে গভীরভাবে প্রভাবিত হন। ইংল্যাণ্ডের সুনিশ্চিত চাকরি, প্রাচুর্য, বৈভব সব অবলীলায় ত্যাগ করে দেশে ফিরে আসেন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর বোলপুরের পিয়ারসন মেমোরিয়াল হাসপাতালে ডেপুটি চিফ্‌ মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। মাত্র কয়েকমাস চাকরি করার পর বোলপুরের হরগৌরীতলায় পৈতৃক বাসভবনে তিনি নিজস্ব চেম্বার শুরু করেন। গরীব মানুষদের সেবা করার উদ্দেশ্যেই তিনি নিজের কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন। আজও সকাল আটটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত প্রত্যহ নিয়মমাফিক তিনি রোগী দেখেন। জনসাধারণকে স্বল্পমূল্যে সেবা করার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এই বাড়িতেই একটা ল্যাবরেটরি খোলেন যেখানে ন্যূনতম মূল্যে গ্রামবাসীদের পরীক্ষা করার সুযোগ করে দেন। এর কিছু বছর পরে তিনি নিজের বাসভবনে অল্পসংখ্যক শয্যাবিশিষ্ট একটি নার্সিংহোমও চালু করেন।

১৯৬৩ সাল থেকে শুধুমাত্র এক টাকার বিনিময়ে তিনি রোগী দেখে চলেছেন। তিনি মনে করেন, এক টাকার পরিবর্তে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা করলে রোগীরা যাতে সেটি ‘দয়া’ ভেবে সঙ্কুচিত না হন, সেই কারণেই তিনি মাত্র এক টাকা ভিজিট নিয়ে প্রতিদিন দেড়শো রোগীর চিকিৎসা করে থাকেন। এমনকি চেম্বারে আসতে না পারলেও, তিনি রোগীর বাড়িতে গিয়েও চিকিৎসা করেন। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীতে যখন সারা পৃথিবীর মানুষ আক্রান্ত, তখনও তিনি অকুতোভয় হয়ে তাঁর বাড়ির দরজা সর্বসাধারণের জন্য খুলে রেখেছিলেন এবং এই বিপর্যয়েও প্রতিদিন একশো জন করে রোগী দেখেছেন তিনি। নিজে এই মহামারিতে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত অসুস্থ মানুষদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। দীর্ঘ ৫৭ বছর ধরে একইভাবে তিনি রোগী দেখে আসছেন। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি তথা ‘ভারতরত্ন’ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পারিবারিক ডাক্তার সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়কে বীরভূমের মানুষ ‘এক টাকার ডাক্তার’ নামেই চেনেন।

সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় একসময় সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। আর্দশগতভাবে গান্ধীজির ভাবাদর্শে অণুপ্রাণিত হয়ে আর .জি. কর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র থাকাকালীনই নিজের পেশাগত পরিধির বাইরে বেরিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করার উদ্যোগে তিনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। আর. জি. কর মেডিক্যাল কলেজে থাকাকালীন প্রথম বর্ষে শ্রেণি প্রতিনিধি, দ্বিতীয় বর্ষে আ্যসিস্ট্যান্ট সোশ্যাল সি.এ.টি এবং তৃতীয় বর্ষে সি.এ.টি হন এবং চতুর্থ বর্ষে ছাত্র সংগঠনের সহ সভাপতি নির্বাচিত হন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের উৎসাহে ও অণুপ্রেরণায় সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন। ১৯৮০ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শান্তিনিকেতনে আসেন এবং সুশোভনবাবুকে বিশ্বভারতীর সদস্য নিযুক্ত করেন তিনি। ১৯৮৩ সাল থেকে বীরভূমের বিশ্বভারতীর পরিচালন সমিতির সদস্য হয়েছেন তিনি, এই মুহূর্তে তিনিই বিশ্বভারতীর পরিচালন সমিতির প্রবীণতম সদস্য। প্রথমবার ভারতের রাষ্ট্রপতি জৈল সিং তাঁকে এই পদে মনোনীত করেন। এছাড়াও তিনি বোলপুর মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির পদে দীর্ঘদিন আসীন রয়েছেন এবং ১৯৮৪ সালে বোলপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের বিধায়ক নির্বাচিত হন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। বোলপুরের কংগ্রেসের দুর্বল সংগঠনকে পুনরুদ্ধারের জন্য উদ্যোগী হন তিনি। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীই তাঁকে প্রথম ‘ওয়ান রুপি ডক্টর’ নামে অভিহিত করেন। ১৯৯৯ সালে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি বীরভূমের তৃণমূল কংগ্রেসের জেলাসভাধিপতি পদে নির্বাচিত হন।

সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় ডাক্তারি এবং রাজনীতির সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছেন। দীর্ঘদিন ‘বীরভূম রেলযাত্রী সমিতি’র সভাপতির পদে আসীন ছিলেন তিনি। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী যখন বিশ্বভারতীর আচার্য ছিলেন, সেইসময় সুশোভনবাবুর নেতৃত্বে রেলযাত্রী সমিতি সাঁইথিয়ায় ডবল লাইন করার জন্য আবেদন জানায় এবং বীরভূমে একটি সুপারফাস্ট ট্রেন চালানোর জন্যও অনুরোধ করেন তিনি যার দরুণ ১৯৮৭ সালে বীরভূম থেকে ‘শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস’-এর যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘদিন রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও সাধারণ মানুষ থেকে রাজনৈতিক মহলে তাঁর অবাধ বিচরণ। মানুষের জন্য কাজ করার ব্রত থেকে তিনি কোনোদিনই সরে আসেননি। রাজনৈতিক ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে নিজের সাধ্যমতো নিরন্তর মানুষের সেবা করে চলেছেন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়।

ডা. সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে চিকিৎসাক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ভারত সরকারের তরফ থেকে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে ভূষিত হন। যদিও এই পুরস্কার তিনি উৎসর্গ করেছেন বোলপুরের সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে যারা এই সম্মানের প্রকৃত অধিকারী। ২০২০ সালের জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি রোগী দেখার জন্য ‘গিনেস বুক অফ ওর্য়াল্ড’-এ তাঁর নাম নথিভুক্ত হয়। তাঁরা ‘লঙ্গেস্ট অ্যাওয়ারনেস রিবন’ (Longest Awareness Ribbon) উপাধি প্রদান করেন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

বোলপুরের মানুষদের কাছে ঈশ্বরের দূত সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের পৈতৃক বাড়িতে একাই থাকতেন। তাঁর একমাত্র মেয়ে কলকাতার বি. আর. সিং হাসপাতালের সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার।

২০২২ সালের ২৬ জুলাই বার্ধক্যজনিত কারণে সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান