ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভ্রমণ

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভ্রমণ

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল (Victoria Memorial) শুধুমাত্র কলকাতারই নয়, বরং সমগ্র ভারতের মধ্যেই এক অন্যতম স্মৃতিসৌধ। এটি ব্রিটিশ স্থাপত্য শিল্প এবং ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। গ্রেট ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পরে সাদা মার্বেল পাথরে নির্মিত এই স্মৃতিসৌধ বহু পর্যটকদের কাছে আজও আকর্ষণীয়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে বলা হয় ‘তাজ অফ দ্য রাজ’ (Taj of the Raj)। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের চূড়ার সেই পরী আজ আর না ঘুরলেও সৌধ-সংলগ্ন বাগানে, নুড়ি বিছানো পথে হেঁটে বেড়ানোর সাধ অধিকাংশ বাঙালিই মনের মধ্যে লালন করেন। কলকাতা এবং আশেপাশের অঞ্চলের মানুষের জন্য এই জায়গা শীতকালের দারুণ একটি পিকনিক স্পট।

কলকাতার ময়দানে অবস্থিত এই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, যদিও এই রাস্তার আসল নাম কুইন্স ওয়ে। জওহরলাল নেহেরু রোড পেরিয়ে একেবারে রাস্তার উপরেই চোখে পড়বে এই স্মৃতিসৌধ। কাছেই ময়দান এবং রবীন্দ্র সদন মেট্রো স্টেশন। ভিক্টোরিয়ার বিপরীত দিকেই রয়েছে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস, নন্দন প্রেক্ষাগৃহ, গগনেন্দ্র চিত্র প্রদর্শনীশালা ইত্যাদি।

১৯০১ সালে গ্রেট ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়া মারা যান। তাঁরই উদ্দেশ্যে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন ভারতের সেই সময়কার রাজধানী কলকাতার বুকে একটি বিশালাকার স্মৃতিসৌধ বানানোর নির্দেশ দেন যেখানে একটি সংগ্রহশালা ও বাগান থাকবে। ১৯০৬ সালে এর শিলান্যাস করেছিলেন ওয়েলসের প্রিন্স পঞ্চম জর্জ। এই স্থাপত্যের জন্য অর্থের যোগান এসেছিল ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে এবং ব্যক্তিগতভাবেও কয়েকজন অর্থ প্রদান করেছিলেন। লর্ড কার্জন সকলের কাছে আবেদন করেছিলেন যাতে চাইলে যে কেউ স্বেচ্ছায় অর্থ প্রদান করতে পারে। আগ্রা ও আউধ, রাজপুতানা, হায়দ্রাবাদ, মাইসোর, বর্মা, নেপাল, অসম, বালুচিস্তান ছাড়াও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি ও মধ্য ভারতের বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যগুলি অর্থ দিয়েছিল। সেই সময় এই স্মৃতিসৌধটি তৈরি করতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় এক কোটি পাঁচ লক্ষ টাকা। রাজস্থান থেকে আনা মাকরানা মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত এই সৌধের মধ্যে ব্রিটিশ ও মুঘল স্থাপত্যরীতির মিশেল লক্ষ্য করা যায়। ১৯২১ সালে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের নির্মাণকার্য শেষ হলে তা জনসাধারণের ভ্রমণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তৎকালীন রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট (Royal Institute of British Architect)-এর প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম এমারসন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল নির্মাণের মুখ্য নির্মাতা ছিলেন। স্কটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী স্যার ডেভিড প্রেইন এবং লর্ড রেডেসডেলকে সৌধ-সংলগ্ন বাগান নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বাগানের ফটক এবং উত্তরের ব্রিজের নকশা তৈরির দায়িত্ব ছিল ভিনসেন্ট জে এইচ মেসার্স-এর উপর। কলকাতার একটি সংস্থা মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি এই নির্মাণের কার্যভার পেয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ সরকার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলকে ঢেকে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়, কারণ সরকার ভেবেছিল জাপান হয়তো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে বোমাবর্ষণ করতে পারে। তাই সম্ভাব্য ধ্বংস থেকে মেমোরিয়াল কে বাঁচানোর জন্য ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে লম্বা বাঁশের মাচান দিয়ে ঘিরে ফেলে আর তার ওপরে কাদামাটি ও গোবরের প্রলেপ লাগিয়ে দেওয়া হয়। ন্যাশনাল লিডার্স গ্যালারির উন্মোচন হয় স্বাধীনতার পরে। ১৯৭০-এর দশকে সৈয়দ নুরুল হাসানের উদ্যোগে কলকাতার ইতিহাস দৃষ্টিগোচর করার জন্য আরও একটা নতুন গ্যালারি খোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ১৯৮৬ সালে সৈয়দ নুরুল হাসান পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হন এবং তার সঙ্গে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বোর্ড অফ ট্রাস্টিস-এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৮৮ সালে হাসান একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করেন। কলকাতা গ্যালারির ধারণাকে অবশেষে বাস্তব রূপ দেওয়া হয় এবং ১৯৯২ সালে কলকাতা গ্যালারির উদ্বোধন করা হয় । 

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল যেন কোনও এক স্বপ্নপুরীর প্রাসাদ। অসাধারণ শিল্প-স্থাপত্যের নমুনা দেখা যাবে এর প্রতিটি প্রান্তে। আর তার সঙ্গে রয়েছে সুদৃশ্য সংরক্ষিত বাগান। প্রায়ই মরশুমি ফুলে এই বাগান সেজে ওঠে। প্রায় ২০০ ফুট উঁচু সৌধের চূড়ায় থাকা ব্রোঞ্জের পরী আজও কার অপেক্ষায় দিন গোনে। কলকাতা এগিয়ে চলেছে, কিন্তু সেই পরী কোন এক গোপন দুঃখে তার ঘোরা থামিয়ে দিয়েছে। সূর্যাস্ত হলেই বাগানের পাশের ঝিল থেকে এক অপরূপ শোভা ফুটে ওঠে আকাশে, পাখিরা কলতান করে ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরে আসে ঘরে। চারিদিকে সুরম্য মূর্তি, সৌধ, কত শত তৈলচিত্র, প্রাচীন নিদর্শন সব মিলিয়ে আভিজাত্যের আর ইতিহাসের যৌথ আয়োজন যেন। এই জমির উপরেই নাকি আগে ছিল প্রেসিডেন্সি জেল যা পরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আলিপুরে।

কলকাতা শহরের যে কোনও জায়গা থেকে বাসে করে ময়দান কিংবা রবীন্দ্র সদনে নেমে কিছুটা হাঁটলেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল চোখে পড়বে। কেউ যদি মেট্রো করে যেতে চান তাহলে কলকাতা ময়দান স্টেশনে অথবা রবীন্দ্র সদন স্টেশনে তাঁকে নামতে হবে, তারপর একইভাবে কিছুটা হাঁটলেই পাওয়া যাবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। হাওড়া স্টেশন থেকে চৌরঙ্গীগামী বাস ধরে চৌরঙ্গী রোডে নেমে মিনিট পনেরো হাঁটলেই ভিক্টোরিয়ায় পৌঁছানো যায় এবং শিয়ালদা স্টেশন থেকে এখানে আসতে হলে রবীন্দ্রসদনগামী বাস ধরে রবীন্দ্রসদনে নেমে কিছুটা হাঁটতে হবে।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ঘুরতে এসে রাত্রিবাসের জন্য আশেপাশে বহু হোটেল, লজ ইত্যাদি রয়েছে। নিকটবর্তী পার্ক স্ট্রিটে বেশিরভাগই অভিজাত হোটেল রয়েছে। তাছাড়া কলকাতা শহরের অন্যত্রও বিভিন্ন দামের ও বিভিন্ন মানের হোটেল রয়েছে। এক্ষেত্রে পুরো কলকাতা শহরের অন্যান্য জায়গা ভ্রমণের পরিকল্পনা থাকলে তবেই একটা নির্দিষ্ট হোটেলে থাকা যায়, নচেৎ শুধুমাত্র ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভ্রমণের জন্য রাত্রিবাসের প্রয়োজন নেই। পর্যটকেরা মূলত দিনের দিন ঘুরে বাড়ি ফিরে যান। স্থানীয় লোকেরা এখানে পিকনিক করতে আসেন। কিন্তু যারা দূরবর্তী কোনও জেলা থেকে আসবেন, তারা এক-দুদিন থেকে কলকাতার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থানগুলি একবারে ঘুরে নিতে পারেন। এখানে সবসময়ই হোটেল বা লজের চাহিদা বেশি থাকে, তাই অবশ্যই আগে থেকে হোটেল বুক করে নিতে ভুলবেন না।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বিশাল পরিসরের মধ্যে অনেকগুলি পৃথক পৃথক ঘোরার জায়গা আছে। একে একে সেই বিশেষ দ্রষ্টব্যগুলি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগান : ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ৬৪ একরের একটি বাগান রয়েছে এবং ২১ জন উদ্যানরক্ষকের একটি দল বাগানের পরিচর্যা ও দেখাশোনা করে থাকে। বাগানে ভিক্টোরিয়ার একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি রয়েছে যেটি বানিয়েছিলেন জর্জ ফ্র্যাম্পটন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দক্ষিণ দিকে রয়েছে সপ্তম এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল আর্ক। এই খিলানে ব্রোঞ্জের একটি মূর্তি আছে সপ্তম এডওয়ার্ডের যেটি বানিয়েছিলেন বের্ট্রাম ম্যাকেনাল। এখানে লর্ড কার্জনেরও একটি মার্বেল পাথরের মূর্তি রয়েছে এবং এই মূর্তিটি তৈরি করেন ডব্লিউ পমেরয়। এছাড়াও বাগানে রয়েছে বহু ব্রিটিশ প্রশাসকদের মূর্তি যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হেস্টিংস, চার্লস কর্ণওয়ালিস, ফার্স্ট মার্কাস কর্ণওয়ালিস, রবার্ট ক্লাইভ, আর্থার ওয়েলেসলি, ফার্স্ট মার্কাস অফ ডালহৌসি, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক, জর্জ রবিনসন, ফার্স্ট মার্কাস অফ রিপন এবং রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জী। বাগানে প্রায় ৮০ রকম প্রজাতির গাছপালা রয়েছে, ৬টি জলাশয় রয়েছে আর তাছাড়া বাগানে বসার জন্যও অনেকগুলি সুদৃশ্য বেঞ্চ রয়েছে। ২০০৪ সালের পূর্বে বাগানে নিখরচায় ভ্রমণ করা যেত। কিন্তু ২০০৪ সালে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী বাগানে প্রবেশের ওপরে টিকিট ধার্য করা হয়। বাগানের মাথাপিছু টিকিটমূল্য কুড়ি টাকা। এছাড়া প্রত্যহ যারা এই বাগানে প্রাতঃভ্রমণ করতে আসেন, তাদের জন্য বার্ষিক ১০০০ টাকা (ষাটোর্ধ্বদের জন্য) এবং অন্যান্যদের জন্য ২০০০ টাকার টিকিটের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এই টিকিট কেটে মেমোরিয়াল হলের ভিতরে ঢোকা যায় না। সপ্তাহে প্রতিদিনই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগান পর্যটকদের জন্য খোলা থাকে সকাল সাড়ে ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। শীতকালে এই বাগানে পিকনিকের জন্য মানুষের ভিড় হয়।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল : তাজমহলের মত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালেও একটি বড় গম্বুজ, অষ্টভুজাকৃতির গম্বুজাকার ছত্রী, সোপান এবং চার কোণে রয়েছে চারটি গম্বুজাকার টাওয়ার। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাঝখানের গম্বুজে রয়েছে ‘অ্যাঞ্জেল অফ ভিক্ট্রি’র (Angel of Victory) একটি মূর্তি। আর এর চারপাশে রয়েছে বেশ কিছু রূপক ভাস্কর্য। যেমন – ‘আর্ট’, ‘আর্কিটেকচার’, ‘জাস্টিস’, ‘চ্যারিটি’ এবং উত্তরের বারান্দার উপরে রয়েছে ‘মাদারহুড’, ‘প্রুডেন্স’ এবং ‘লার্নিং’ নামাঙ্কিত মূর্তিগুলি। 

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের গ্যালারি : ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের ভেতরে মোট ২৫টি গ্যালারি রয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রয়্যাল গ্যালারি, ন্যাশনাল লিডার্স গ্যালারি, পোর্ট্রেট গ্যালারি, সেন্ট্রাল হল, স্কাল্পচার গ্যালারি, আর্মস এবং আর্মারি গ্যালারি এবং নবতম সংযোজন হল কলকাতা গ্যালারি। টমাস ড্যানিয়েল এবং তাঁর ভাইপো উইলিয়াম ড্যানিয়েলের মত চিত্রশিল্পীর শিল্পকর্মের সবথেকে বেশি সংগ্রহ রয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলেই। শুধু চিত্রশিল্পীর কাজই নয়, এখানে সংরক্ষিত আছে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার চিত্রিত বেশ কিছু বই, ওমর খৈয়ামের বই, কত্থক সম্পর্কিত বই, নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের ঠুমরী সঙ্গীত নিয়ে লেখা বই ইত্যাদি। ভিক্টোরিয়া গ্যালারিতে রানি ভিক্টোরিয়া এবং প্রিন্স অ্যালবার্টের বিভিন্ন প্রতিকৃতি আছে। এছাড়া আছে আরও কিছু ছবি যেখানে তাঁদের জীবনের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। এই ছবিগুলি এঁকেছেন জনসন এবং উইন্টারহল্টার। বহু তৈলচিত্রের সংগ্রহও রয়েছে এখানে। ভিক্টোরিয়া গ্যালারিতে রানি ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশ্যে আঁকা মুখ্য ছবিগুলি হল ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে রানির রাজ্যাভিষেকের সময়ের ছবি, সেন্ট জেমস প্যালেসে তাঁর সাথে অ্যালবার্টের বিবাহের ছবি, উইন্ডসর ক্যাসেলে প্রিন্স অফ ওয়েলসের নামকরণ, সপ্তম এডওয়ার্ডের সঙ্গে প্রিন্সেস আলেক্সান্দ্রার বিবাহের ছবি, তাঁর রাজত্বের ৫০তম জয়ন্তীতে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে তাঁর ছবি এবং সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে তাঁর ছবি। এই গ্যালারির ঘরের একদম মাঝখানে রয়েছে রানি ভিক্টোরিয়ার ছোটবেলার গোলাপ কাঠের তৈরি পিয়ানো এবং তাঁর ডেস্ক। সপ্তম এডওয়ার্ড অর্থাৎ তাঁর পুত্র এই সকল জিনিসপত্রগুলি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দান করেন। ন্যাশনাল লিডার্স গ্যালারিতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে যুক্ত বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এবং রাজনৈতিক নেতাদের জন্য আঁকা প্রতিকৃতি ও কর্মকাণ্ডের ছবির সংগ্রহ রয়েছে। এই গ্যালারিতে অস্ট্রিয়ান শিল্পী ওয়াল্টার ল্যাঙ্গহ্যামারের বিশাল অবদান রয়েছে। এই গ্যালারির বহু ছবি তাঁরই আঁকা। কলকাতা গ্যালারিতে দেখানো হয়েছে কলকাতা শহরের ইতিহাস এবং অগ্রগতি। জব চার্ণকের কেনা কয়েকটি গ্রাম থেকে স্বাধীনতা ও দেশভাগ পর্যন্ত কলকাতা শহরের যে বিবর্তন তা ফুটে উঠেছে কলকাতা গ্যালারিতে । যখন কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর করা হয়েছিল তার আগে পর্যন্ত কলকাতার চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় এই গ্যালারিতে। গ্যালারিতে আরেকটি বিশেষ জিনিস আছে, তা হল উনবিংশ শতকের চিৎপুর রোডের একটি ডায়োরামা। আর্মস অ্যান্ড আর্মরি বিভাগে ভারতের দেশীয় রাজাদের ও ব্রিটিশ অফিসারদের ব্যবহার করা অস্ত্রের সংগ্রহ রয়েছে। লর্ড কার্জন বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য থেকে তলোয়ার, যুদ্ধের কুঠার, বর্শা, বন্দুক, কামান, কামানের বল প্রভৃতি সংগ্রহ করে জাদুঘরে রাখতে চেয়েছিলেন। নবাব সিরাজদৌল্লার ব্যবহৃত তলোয়ারটিও এখানে দেখতে পাওয়া যায়। গ্যালারির টিকিটমূল্য ভারতীয়দের জন্য মাথাপিছু ৩০ টাকা, সার্কের (SAARC) অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির পর্যটকদের জন্য মাথাপিছু ১০০ টাকা আর অন্যান্য যে কোনও দেশের পর্যটকদের জন্য মাথাপিছু ৫০০ টাকা। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল ইউনিফর্ম এবং স্কুলের পরিচয়পত্র থাকলে তাদের ক্ষেত্রে বিনামূল্যে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের জন্য কিংবা সেনাবাহিনীর কর্মী ও তাঁর স্ত্রী সন্তানদের জন্য কোনও প্রবেশমূল্য নেই। তবে উভয়ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। একইভাবে সার্ক-অন্তর্ভুক্ত দেশের পর্যটকদের পাসপোর্ট দেখালে তবেই তাদের জন্য ১০০ টাকা টিকিট ধার্য হবে, নচেৎ অন্যান্য দেশের পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত ৫০০ টাকার টিকিট কাটতে হবে। সোমবার এবং জাতীয় ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহের সব দিনেই সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গ্যালারি খোলা থাকে।

লাইট অ্যান্ড সাউন্ড প্রদর্শনী : প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের এক আকর্ষণীয় প্রদর্শনী হয় যেখানে কলকাতার ঐতিহ্য এবং ইতিহাস তুলে ধরা হয়। এর শিরোনাম হল ‘প্রাইড অ্যান্ড গ্লোরি – দ্য স্টোরি অফ ক্যালকাটা’ (Pride and Glory -The Story of Calcutta)। বাংলা ও ইংরেজি দুটি ভাষাতেই এই প্রদর্শনী দেখানো হয়। বাংলা ভাষায় প্রদর্শনীর টিকিটমূল্য ১০ টাকা এবং ইংরেজি ভাষায় এই টিকিটের মূল্য ২০ টাকা। লাইট অ্যান্ড সাউন্ড প্রদর্শনীটি সোমবার ও অন্যান্য জাতীয় ছুটির দিন বাদে সবদিনই দেখানো হয় নির্দিষ্ট সময়ে। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সন্ধ্যা ৬টা ১৫ থেকে ৭টা এবং মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ থেকে ৭টা ৩০ এই সময়ের মধ্যে বাংলা ভাষায় প্রদর্শনী চলে। আর অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় প্রদর্শনীর সময় হল অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সন্ধ্যা ৭টা ১৫ থেকে ৮টা এবং মার্চ থেকে জুন মাসের মধ্যে সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ থেকে ৮টা ৩০। জুলাই মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই প্রদর্শনীটি বন্ধ থাকে।

এছাড়াও আশেপাশে সাইটসিইং করতে হলে বিড়লা তারামণ্ডল, নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম, নন্দন চত্বর, ভারতীয় জাদুঘর ইত্যাদি দেখে নেওয়া যায়। আর দু-তিনদিন থাকলে ভিক্টোরিয়ার পাশাপাশি কলকাতার আরও বিখ্যাত কিছু জায়গাও সাইটসিইং হিসেবে ঘুরে আসা যায়। যারা পিকনিক করতে আসেন, তাঁরা কাছেপিঠের পার্কেও ঘুরে নিতে পারেন।

ভিক্টোরিয়ার বাগানে ঢোকার মুখে ফেরিওয়ালাদের কাছে খুব সুন্দর তালপাতার টুপি পাওয়া যায় যা পুরো কলকাতার একমাত্র এখানেই মেলে। সেই টুপি সংগ্রহ করে রাখলে ভিক্টোরিয়া ভ্রমণ স্মৃতিতে আরও জাগরুক হয়ে থাকবে।


ট্রিপ টিপস :

  • কীভাবে যাবেন – কলকাতা শহরের যে কোনও জায়গা থেকে বাসে করে ময়দান কিংবা রবীন্দ্র সদনে নেমে কিছুটা হাঁটলেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল চোখে পড়বে। কেউ যদি মেট্রো করে যেতে চান তাহলে কলকাতা ময়দান স্টেশনে অথবা রবীন্দ্র সদন স্টেশনে তাঁকে নামতে হবে, তারপর একইভাবে কিছুটা হাঁটলেই পাওয়া যাবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।
  • কোথায় থাকবেন – ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে সাধারনত একদিনের জন্য ঘুরতে আসেন অথবা স্থানীয়রা পিকনিক করতে আসেন শীতকালে। কলকাতার বাইরে থেকে ঘুরতে এসে রাত্রিবাসের জন্য আশেপাশে বহু হোটেল, লজ ইত্যাদি রয়েছে।
  • কী দেখবেন – ভিক্টোরিয়ার বাগান, মেমোরিয়াল হলের সুরম্য মূর্তি ও নিদর্শনগুলি, ভিতরের গ্যালারিতে সংরক্ষিত প্রাচীন নিদর্শন এবং বহু তৈলচিত্র, কলকাতার ইতিহাসের ধারাক্রম, লাইট অ্যান্ড সাউন্ড প্রদর্শনী ইত্যাদি এখানকার বিশেষ দ্রষ্টব্য। আশেপাশে সাইটসিইং করতে হলে বিড়লা তারামণ্ডল, নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম, নন্দন চত্বর, ভারতীয় জাদুঘর ইত্যাদি দেখে নেওয়া যায়। 
  • কখন যাবেন –  বছরের যে কোনও সময়ে এখানে আসা যায়। তবে সোমবার ও অন্যান্য জাতীয় ছুটির দিনে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গ্যালারি ও ভিতরের হল বন্ধ থাকে। বাগান সবদিনই খোলা। তবে প্রতিটি অংশের নির্দিষ্ট সময়সূচি রয়েছে।
  • সতর্কতা –  
    • বাগানে বসা বা ঘুরে বেড়ানোর সময় কোনওভাবেই প্রাঙ্গণ নোংরা করা যাবে না। বাগানের মধ্যে প্লাস্টিকের বোতল, খাবার-দাবারের প্যাকেট ইত্যাদি ফেলে আসবেন না।
    • যারা পিকনিক করতে চান, তাঁরা শুধুমাত্র ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানেই তা করতে পারেন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের ভেতর পিকনিকের অনুমতি নেই।
    • মেমোরিয়ালের ভিতরে ঘোরার সময় যথাসম্ভব নীরবতা বজায় রাখুন।
    • বাগানের সর্বত্র ছবি তোলা যায়, কিন্তু গ্যালারির ভিতরে ছবি তোলা আইনত নিষিদ্ধ।
    • জলের বোতল, খাবারের প্যাকেট ইত্যাদি নিয়ে গ্যালারির ভিতরে প্রবেশ করা নিষেধ।
    • একইভাবে কোনও দাহ্য পদার্থ নিয়ে ভিতরে ঢোকা যাবে না।
  • বিশেষ পরামর্শ –
    • ভিক্টোরিয়ার বাগানে ঢোকার মুখে ফেরিওয়ালাদের কাছে খুব সুন্দর তালপাতার টুপি পাওয়া যায় যা পুরো কলকাতার একমাত্র এখানেই মেলে। সেই টুপি সংগ্রহ করে রাখলে ভিক্টোরিয়া ভ্রমণ স্মৃতিতে আরও জাগরুক হয়ে থাকবে।

3 comments

আপনার মতামত জানান