সতীপীঠ উজানি বা সতীপীঠ মঙ্গলচণ্ডী পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার কোগ্রামে অবস্থিত। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর বাঁ হাতের কনুই পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী মঙ্গলচন্ডী এবং ভৈরব হলেন কপিলাম্বর বা কপিলেশ্বর।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। বলা হয় কোগ্রামের সতীপীঠ উজানিতে মাতা সতীর বাঁ হাতের কনুই পড়েছিল।
পীঠনির্ণয়ের মতে ত্রয়োদশ সতীপীঠটি হল উজ্জয়িনী। অন্নদামঙ্গল কাব্য অনুযায়ী স্থানটির নাম উজানি। অনেক গবেষকদের মতে, “ওড্ডিয়ান মঙ্গলকোট” অনুযায়ী কোগ্রামেই অবস্থিত উজানি সতীপীঠ। প্রচলিত কাহিনী অনুসারে মর্ত্যে মা মঙ্গলচন্ডীর পূজা প্রচারের জন্য অভিশাপগ্রস্থ স্বর্গের অপ্সরা খুল্লনা রূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। ধনপতি সওদাগর খুল্লনাকে বিয়ে করেন। কিন্তু শিবভক্ত সওদাগর মঙ্গলচন্ডীর পূজা করতেন না। একবার বাণিজ্যে বেরোবার আগে তিনি মায়ের ঘটে লাথি মেরে বাণিজ্যে গিয়েছিলেন। দেবীর আক্রোশে তিনি আর উজানি নগরে ফিরে আসেননি। খুল্লনা মা মঙ্গলচন্ডীকে পুজোয় সন্তুষ্ট করে তাঁর স্বামীর ফিরে আসবার জন্য প্রার্থনা করতেন। অনেক বছর পর সওদাগর ফিরে আসেন। সেই থেকে মঙ্গলচণ্ডীর পূজা হয়ে আসছে।
অজয় নদের পাড়ে এই মন্দির অবস্থিত। মূল মন্দিরটিতে প্রথমে একটি বারান্দা আছে। তার ভিতরে আয়তাকার গর্ভগৃহ। এই গর্ভগৃহের মধ্যে মা মঙ্গলচণ্ডীর ছোটো কালো পাথরের দশভূজা মূর্তি রয়েছে। প্রাচীন মূর্তিটি নব্বইয়ের দশকে চুরি হয়ে যায়। ১৯৯৪ সালে মল্লিক উপাধিধারী গ্রামের এক ধনী পরিবার বর্তমানের কষ্টিপাথরের দশভুজা মূর্তিটি নির্মাণ করে দেন। সেই থেকে এই কষ্টিপাথরের মূর্তিটির পূজা হচ্ছে। ২০০৬ সালে মন্দিরটি সারানো এবং বাড়ানো হয়েছে। মূল মন্দিরের সামনে একটি ছোট নাটমন্দির যোগ করা হয়েছে।
প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। উজানি সতীপীঠে দেবীর নাম মঙ্গলচন্ডী। উঁচু কালো রঙের পাথরের একটি শিবলিঙ্গ হল দেবীর ভৈরব । ভৈরবের নাম কপিলাম্বর। অনেকে কপিলেশ্বর বলেও উল্লেখ করেন। শিবলিঙ্গের সামনে নন্দীর কালো পাথরের একটি ছোট মূর্তি আছে। শুধু তাই নয়, ভৈরবের বাঁদিকে একটি বজ্রাসন বুদ্ধমূর্তিও আছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এই মূর্তিটি পাল যুগের।
কোগ্রামের অন্যতম বিখ্যাত উৎসব হচ্ছে উজানির মেলা। “মনসা মঙ্গল” কাব্য থেকে জানা যায়, উজানিনগরের রাজা তাঁর প্রজাদের মকরসংক্রান্তির স্নানের জন্য কোগ্রামে অজয় নদের চর কে বেছে নিয়েছিলেন। সেই থেকে প্রতি বছর ১ লা মাঘে অজয় নদের চরে উজানির মেলা বসে। এই সতীপীঠের প্রধান পূজা দুর্গাপূজা এবং তখনও মেলা বসে। সেই সময়ে প্রচুর মানুষ এখানে পূজা দিতে আসে। সপ্তমী এবং অষ্টমীতে চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। নবমীতে চালকুমড়ো, কলা, আখ এবং ছাগ বলি হয়। এছাড়াও বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসের মঙ্গলবারে এবং দোল পূর্ণিমার দিনেও মঙ্গলচণ্ডীর পুজো হয়।
এই সতীপীঠের তথ্য ভিডিও আকারে দেখুন এখানে
তথ্যসূত্র
- একান্ন পীঠ, হিমাংশু চট্টোপাধ্যায়, দীপ প্রকাশন, পৃষ্ঠা ২৪২-২৪৪, উজ্জয়িনীতে মঙ্গলচণ্ডিকা
- https://www.kramabardhaman.com/
- https://bengali.koulal.com/
- https://bengali.news18.com/