সমগ্র বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলির মধ্যে অলিম্পিক গেমসের কোনো বিকল্প নেই। বহু বছরের ঐতিহ্য বুকে নিয়ে আজও সমান গুরুত্ব সহকারে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। আর বিশ্বের চলচ্চিত্র জগত এর দ্বারা প্রভাবিত হবে না তা ভাবাই উচিত না। সমগ্র বিশ্বে নানা পরিচালক বিভিন্ন সময় অলিম্পিককে কেন্দ্র করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ডাউনহিল রেসার (১৯৬৯), চ্যারিয়টস অফ ফায়ার (১৯৮১), কুল রানিং (১৯৯৯), ফিস্টস অফ ফ্রিডম (১৯৯৯), ওয়ান ডে ইন সেপ্টেম্বর (১৯৯৯), মিউনিখ (২০০৫), ইত্যাদি সব বিখ্যাত চলচ্চিত্রই অলিম্পিককে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে। কিন্তু এই তালিকায় না বলা অথচ সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দুটি চলচ্চিত্র – ১৯৩৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অলিম্পিয়া’ এবং ১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘টোকিও অলিম্পিয়াড’ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে বিশ্ব-চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। চলুন জেনে নিই এই দুটি বিশেষ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যে কীভাবে অলিম্পিক উঠে এসেছে এবং ঠিক কী কারণে এই দুটি ছবি বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল।
১৯৩৬ সালে জার্মান পরিচালক লেনি রিফেন্সট্যালের পরিচালনায় মুক্তি পায় ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিক-নির্ভর পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ‘অলিম্পিয়া’। এর দুটি পর্ব ছিল – প্রথম পর্বের নাম ‘ফেস্টিভ্যাল অফ নেশনস’ এবং দ্বিতীয় পর্বটি হল ‘ফেস্টিভ্যাল অফ বিউটি’। এই অলিম্পিয়া ছবিটিই অলিম্পিককে কেন্দ্র করে নির্মিত প্রথম তথ্যচিত্র। অথচ এই ছবিতে তথ্যচিত্রের প্রাথমিক ধরা-বাঁধা রীতি থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন পরিচালক এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন যা কিনা পরবর্তীকালের তথ্যচিত্র নির্মাণের রীতিকে প্রভাবিত করে। ছবিটির প্রথম পর্বে অলিম্পিকের সূচনার ইতিহাস, অলিম্পিয়া শহরের কথা দিয়ে শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকের সূচনায়। আর দ্বিতীয় পর্বে বার্লিন অলিম্পিকের ট্র্যাক অ্যাণ্ড ফিল্ড খেলাগুলির একেবারে আসল ভিডিও ক্লিপিং দেখা যায়। তিনটি ভিন্ন ভাষায় আলাদা আলাদাভাবে মুক্তি পায় ছবিটি। ইংরেজি, ফরাসি এবং জার্মান ভাষায় পৃথকভাবে মুক্তি পাওয়ার পর লক্ষ করা গেছে অনেকক্ষেত্রেই মূল বয়ান একই থাকলেও ছবিটির সম্পাদনার অংশে অনেক বদল ঘটে গেছে। এমনকি ফরাসি ভাষায় ‘অলিম্পিয়া’র একটি বিকল্প নামও দেওয়া হয় ‘গডস অফ দ্য স্টেডিয়াম’। আসলে পরিচালক ছবি পুনর্মুক্তি পাওয়ার আগে আরেকবার নতুন করে সম্পাদনা করতেন। দেখা গেছে মূল ছবিতে যে বিখ্যাত ডাইভিংয়ের দৃশ্যটি দীর্ঘ চার মিনিটের ছিল তা অন্য এক ভাষার ছবিতে কমে গিয়ে পঞ্চাশ সেকেণ্ডে পরিণত হয়েছে। দুটি কারণে এই চলচ্চিত্রটি সমালোচক এবং দর্শক মহলে সাড়া জাগিয়েছিল। প্রথমত সেকালে কোনো তথ্যচিত্র এত প্রাণবন্ত, স্বতস্ফূর্ত ভঙ্গিতে নির্মিত হতো না। পরিচালক লেনি এই ছবিতে প্রথম কিছু অপ্ৰচলিত কৌশল প্রয়োগ করেন। অপ্ৰচলিত ক্যামেরা অ্যাঙ্গল, স্ম্যাশ কাট, বিগ ক্লোজ আপ, ট্র্যাকিং শট ইত্যাদি সেকালের তথ্যচিত্রে আশাতীত ছিল। তাছাড়া সেসময় চলমান ছবিতে আবহ সঙ্গীত সংযোজন করা দুঃসাধ্য ছিল। কিন্তু লেনি রিফেনস্ট্যাল এই পরীক্ষাতেও সফল হন। তবে লেনি -র এই চলচ্চিত্র নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধে একটি বিষয়ে। অনেকে এই চলচ্চিত্রকে নাৎসি-প্রপাগাণ্ডা বলে চিহ্নিত করেছেন। এর পিছনে যুক্তি ছিল এই যে পরিচালক রেনি রিফেন্সট্যালের সঙ্গে নাৎসি নেতা অ্যাডল্ফ হিটলার, অন্যদিকে বেনিটো মুসোলিনি কিংবা জোসেফ স্তালিনের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল এবং বহুবার হিটলারের ডাকে তিনি মুসোলিনির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। বার্লিনের আয়োজিত সেই অলিম্পিকে জার্মানির গৌরব প্রদর্শন করাই ছিল পরিচালকের উদ্দেশ্য এমনটাও অনেকে মনে করেছিলেন সেই সময়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে সেই ১৯৩৬ সালের অলিম্পিকে আফ্রো-আমেরিকান অ্যাথলিট জেসি ওয়েন্সের স্বর্ণপদক প্রাপ্তিই ছিল মুখ্য আলোচ্য প্রতিপাদ্য। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জার্মান-বিরোধী মনোভাবের প্রাবল্যের কারণে ছবিটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টিকে বড়ো করে দেখাতে চেয়েছেন লেনি এমন বিরুদ্ধ মন্তব্য সেসময়ে উঠে এসেছিল এই ছবিটির প্রসঙ্গে। অনেকেই মনে করেন, সেই বিশৃঙ্খল সময়ে জার্মান সরকার এই চলচ্চিত্রটিকে মুক্তি দিতে চাইতোই না, যদি না এতে কোনোভাবে জার্মান-তোষণ বা জার্মান-স্তুতি না থাকতো। কিন্তু এই সব বিতর্ক বাদ দিলে বিশ্ব সিনেমার জগতে সিনেমার আঙ্গিকে প্রথম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সাহস দেখিয়েছিলেন লেনি তাঁর এই চলচ্চিত্রে। আর তাই বিখ্যাত ‘টাইম’ পত্রিকা ‘অলিম্পিয়া’কে তাদের বিচারে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ১০০ চলচ্চিত্রের মধ্যে অন্যতম ছবি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির পক্ষ থেকে লেনি রিফেন্সট্যাল ১৯৩৯ সালে স্বর্ণপদক লাভ করেন এই চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য। তবে বিতর্ক থেমে থাকেনি। ২০১৬ সালে জেসি ওয়েন্সের জীবন অবলম্বনে যখন রেস নামের চলচ্চিত্র নির্মিত হল সেখানে দেখা যায় গোয়েবলসের সঙ্গে চলচ্চিত্রের শিল্পরূপ নিয়ে লেনি তর্কে মত্ত এবং সেখানে গোয়েবলস তাঁকে অপবাদ দিচ্ছেন যে তিনি তাঁর ছবিতে জেসি ওয়েন্সের মতো একজন আফ্রো-আমেরিকানকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে অলিম্পিকের আর্য-আধিপত্যকে খণ্ডন করেছেন। এই কাহিনি অপ্রমাণিত এবং একপাক্ষিক হলেও জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে এই ঘটনাই আজও বহমান।
এরপরে চলে আসা যাক দ্বিতীয় ছবিটির কথায়। সাল ১৯৬৫। মুক্তি পেল জাপানি তথ্যচিত্র ‘টোকিও অলিম্পিয়াড’ যার পরিচালক কন্ ইচিকাওয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে জাপানের আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল প্রবল। অনেক সাধ্য-সাধনা করে অলিম্পিক আয়োজিত হয় টোকিওতে ১৯৬৪ সালে। অলিম্পিককে কেন্দ্র করে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হওয়ার রেওয়াজ জারি রাখতে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি দেশগুলিকে অর্থ সাহায্য করতো। কিন্তু সেবার জাপান সরকার নিজেদের প্রযোজনাতেই একটি চলচ্চিত্র তৈরি করার জন্য বিখ্যাত পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার কাছে প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু তিনি শেষমেশ অসম্মত হলে, কন্ ইচিকাওয়ার উপর দায়িত্ব পড়ে এই চলচ্চিত্রটি তৈরি করার। কিন্তু তিনি যে ছবিটি বানান তা পছন্দ হয়নি জাপান অলিম্পিক কমিটির। কারণ ইচিকাওয়া নিরেট তথ্যচিত্র নির্মাণের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে শৈল্পিক আঙ্গিকে অভিনব এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ছবিতে এক জায়গায় দেখা যায় অলিম্পিকের মশালবাহক ফুজি পর্বতের পরিপ্রেক্ষিতে অতি ক্ষুদ্র, নগণ্য যে শটটা এই চলচ্চিত্রের একটি বিখ্যাত দৃশ্য বলে পরিগণিত। জাম্প কাট, স্লো মোশান, এক্সট্রিম ক্লোজ আপ ইত্যাদি অভিনব আঙ্গিকের প্রয়োগে সেই সময়ের প্রেক্ষিতে এই চলচ্চিত্রটি সমালোচকদের চোখে প্রশংসিত হয়েছিল। এমনকি জানা যায় যে প্রথমে ইচিকাওয়া ১৬৮ মিনিটের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, কিন্তু জাপান অলিম্পিক কমিটির প্রধানদের নির্দেশে বহু গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য বাদ দিয়ে তা ৯৩ মিনিটে কমিয়ে আনেন তিনি। লেনি রিফেনস্ট্যালের অলিম্পিয়ার পাশাপাশি টোকিও অলিম্পিয়াড চলচ্চিত্রটিও সমান সমাদর পেয়েছিল এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির পক্ষ থেকে ‘অলিম্পিক ডিপ্লোমা অফ মেরিট’-এর সম্মান লাভ করেছিল। এই তথ্যচিত্রেই ইথিওপিয়ান দৌড়বিদ আবেবে বিকিলাকে ম্যারাথনে অংশ নিতে দেখা যায়।
এই দুটি ছবিই সর্বকালের সেরা ক্রীড়াভিত্তিক তথ্যচিত্রের মর্যাদা পেয়েছে। সব মিলিয়ে কখনোই শুধু ক্রীড়া-প্রদর্শনী বা প্রতিযোগিতার ছবিতে গাঁথা ছিল না এই দুটি চলচ্চিত্র। বরং অনেকক্ষেত্রেই ইম্প্রেশনিস্টিক প্রভাব পড়েছিল দুটি চলচ্চিত্রেই। ফলে ক্রীড়াভিত্তিক তথ্যচিত্র হয়েও ‘অলিম্পিয়া’ বা ‘টোকিও অলিম্পিয়াড’ দুটিই হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র এক চলচ্চিত্র।