জহির রায়হান

জহির রায়হান

জহির রায়হান (Zahir Raihan) ছিলেন একজন বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পরিচালক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। এছাড়াও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি গণ আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে মরণোত্তর বিশেষ পুরস্কার প্রদান করা হয় তাঁকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনার দিন থেকে জহির রায়হান এখনও পর্যন্ত নিখোঁজ।

১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বাংলাদেশের ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার মজুপুরে জন্ম হয় জহির রায়হানের। বাবা মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার ছিলেন একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। জহির রায়হান ব্যক্তিগত জীবনে দুই বিয়ে করেছেন। ১৯৬১ সালে বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী সুমিতা দেবীকে বিয়ে করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি বিয়ে করেন আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সুচন্দাকে। সুমিতা দেবীর সঙ্গে দুটি ছেলে ও সুচন্দার ঘরে এক ছেলে রয়েছে। তাঁরাও বর্তমানে বাংলাদেশের বিখ্যাত অভিনেতা ও নাট্য নির্মাতা।

বাবার চাকরির সুবাদে জহির রায়হানের শৈশব কেটেছে কলকাতায়। তাঁর আসল নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ১৯৪০ সালে কলকাতা মডেল স্কুলে ভর্তি হয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরে মিত্র ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। তারপর তাঁকে ভর্তি করানো হয় আলিয়া মাদ্রাসায়। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময় তাঁর বাবা স্বপরিবারে চলে আসেন বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান)।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৫০ সালে ফেনীর আমিরাবাদ হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন জহির রায়হান। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে আই.এসসি পাস করেন তিনি। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে দ্বিতীয় শ্রেণিতে অনার্স পাস করেন। এরপর এম.এ. ক্লাসে ভর্তি হন।

পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের সংস্পর্শে রাজনীতিতে যুক্ত হন জহির রায়হান। সে সময় কলকাতার রাস্তায় ফেরি করে বিক্রি করতেন ‘স্বাধীনতা পত্রিকা’। ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন ঢাকা কলেজে ইন্টারমিটিয়েড পড়া অবস্থাতেই । ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশেও উপস্থিত ছিলেন তিনি। সেদিন প্রথম যে ১০ জনের দলটি ১৪৪ ধারা ভেঙেছিল, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন জহির রায়হান। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ক্যামেরা হাতে সক্রিয় ছিলেন বিভিন্ন কর্মসূচিতে।

ছোট থেকেই লেখালেখির চর্চা ছিলো জহির রায়হানের। ১৯৪৯ সালে নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন তাঁর লেখা প্রথম কবিতা ‘ওদের জানিয়ে দাও’ প্রকাশিত হয়েছিল চতুষ্কোণ পত্রিকায়।

১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ার সময়ই সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ‘যুগের আলো’ পত্রিকায়। এই সময়ই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সূর্যগ্রহণ’। পরবর্তীকালে যান্ত্রিক, সিনেমা ও খাপছাড়া নামক কিছু পত্রিকাতেও কাজ করেছেন। এরপরের বছরই ‘প্রবাহ’ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।

ছোটগল্পকার হিসেবেও তিনি ছিলেন সফল। একটা সময় পাঠ্য বইতে অন্তর্ভূক্ত ছিল তাঁর লেখা ছোটগল্প ‘সময়ের প্রয়োজনে’।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পঠিত উপন্যাস হিসেবে পরিচিত জহির রায়হানের লেখা ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটি । তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘বরফ গলা নদী’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’।

চলচ্চিত্র জগতে তাঁর প্রবেশ ১৯৫৭ সালে প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক আখতার জং কারদারের হাত ধরে। ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ চলচ্চিত্রে তিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এরপর পরিচালক সালাউদ্দিনের ‘যে নদী মরুপথে’ এবং পরিচালক এহতেশামের ‘এদেশ তোমার আমার’ ছবিতে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর নিজেই ছবি পরিচালনার কাজ শুরু করেন।

১৯৬১ সালে মুক্তি পায় জহির রায়হানের প্রথম পরিচালিত ছবি ‘কখনো আসেনি’। এই চলচ্চিত্রের অভিনয় করেছিলেন খান আতাউর রহমান, শবনম ও সুমিতা দেবী। এই বছরই সুমিতা দেবীকে বিয়ে করেন জহির রায়হানের।

জহির রায়হান আলোচনায় এসেছিলেন ১৯৬৩ সালে ‘কাঁচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তাঁর হাত দিয়েই নির্মাণ হয়েছিল পাকিস্তানের প্রথম রঙিন উর্দু ছবি ‘সঙ্গম’ । এই চলচ্চিত্রের ৬টি গানই বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পায় তাঁর এবং পাকিস্তানের প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি ‘বাহানা’। এরপর একাধারে ‘বেহুলা’, ‘সোনার কাজল’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’, ‘আনোয়ারা’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।

১৯৬৯ এর গনঅভ্যূথ্থান আর ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ’র মাঝামাঝি সময়েই তিনি তৈরি করেন বাংলাদেশের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’। বলা হয় এই চলচ্চিত্রটি জহির রায়হানের এক অমর সৃষ্টি। এই চলচ্চিত্রটির বেশ কিছু ইতিহাসও রয়েছে। চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রথম চিত্রায়িত হয়েছিল। পরবর্তীকালে যা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা হয়। বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি সৈন্যের নির্যাতনের সরাসরি চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি এই চলচ্চিত্রে। পাকিস্তানি সৈন্যরা তখন জহির রায়হানকে নিয়ে গিয়েছিলেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ১৯৭০ সালের ১০ এপ্রিল। সেন্সর জটিলতার কারণ দেখিয়ে মুক্তি না দেওয়ায় আন্দোলনে নেমে পড়েছিল বাংলার জনগণ। ‘জীবন থেকে নেয়া’ একমাত্র চলচ্চিত্র যার মুক্তির জন্য হাজার হাজার মানুষ স্লোগান দিয়ে মিছিল করেছে। পরদিনই অর্থাৎ ১১ এপ্রিল মুক্তি পায় সিনেমাটি। কলকাতাতেও চলচ্চিত্রটির কয়েকটি প্রদর্শনী হয়েছিল। যেখানে উপস্থিত ছিলেন- সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিনহাদের মতো নির্মাতারা।

সেই একই বছরে তিনি নির্মাণ করেছিলেন ‘টাকা আনা পাই’ নামে আরও একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র। সেই বছরই তিনি নির্মাণ শুরু করেছিলেন ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ চলচ্চিত্রের। এই চলচ্চিত্রটির বিশেষত্ব হচ্ছে কোনো ধরণের চিত্রনাট্য ছাড়াই তিনি নির্মাণ করেছিলেন। যার প্রতিটি দৃশ্য থেকে সংলাপ সবই ছিল জহির রায়হানের উপস্থিত মেধা দিয়ে তৈরি। তবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় চলচ্চিত্রটির নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়।

স্বাধীনতা যুদ্ধে জহির রায়হানের ছিল বিশাল ভূমিকা। অস্ত্র হিসেবে তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন ক্যামেরা আর যুদ্ধ হিসেবে তিনি প্রকাশ করে গেছেন যুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে যুদ্ধ শুরু হলে ভারতে চলে যান জহির রায়হান। কলকাতায় গিয়ে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সে সময় কলকাতায় বাংলাদেশের যত সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী এবং সংস্কৃতিকর্মী শরণার্থী হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই সংগঠিত হন। তাঁরা সকলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার উদ্দেশ্যে গঠন করেছিলেন ‘বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্সিয়া’। সেখানে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন জহির রায়হান। সে সময়ে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অত্যাচারকে কেন্দ্র করে তৈরি করেন প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ যা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারি হিসেবে পরিচিত। সে সময় ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের কষ্ট, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যা, ভারতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের দিনকালসহ অনেক বাস্তব তথ্য এই প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরেছিলেন জহির রায়হান। প্রামাণ্যচিত্রটি প্রদর্শনী হয়েছিল কোনও এক অজ্ঞাত স্থানে যেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদসহ মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা। জহির রায়হানের আরও একটি ঐতিহ্যবাহি প্রামান্যচিত্র ‘বার্থ অব আ নেশন’ ।

জহির রায়হান ১৯৬৪ সালে ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের জন্য ‘আদমজী সাহিত্য পুরস্কার’ পান। ১৯৬৫ সালে শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র বিভাগে ‘নিগার পুরস্কার’ পায় তাঁর রচিত ‘কাঁচের দেয়াল’ সিনেমাটি। বাংলা সাহিত্যের গল্প শাখায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ‘মরণোত্তর বিশেষ পুরস্কার’ প্রদান করা হয় জহির রায়হানকে। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক (মরণোত্তর) এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর) ভূষিত করে। ২০০৫ সালে ‘হাজার বছর ধরে’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (মরণোত্তর) সম্মান পান তিনি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে জহির রায়হান জানতে পারেন পাক হানাদার বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট চলাকালীন সময় তুলে নিয়ে গেছে তাঁর বড় ভাইকে। তখন ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি’ নামে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন তিনি। এ কমিটি গঠনের মাধ্যমে আলবদর ও রাজাকারদের অনেক গোপন তথ্য খুঁজে পান তিনি। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পেছনে কারা জড়িত ছিলেন এবং হত্যাকারীদের অনেকেরই গোপন আড্ডাখানা সম্পর্কেও তথ্য উদ্‌ঘাটন করেছিলেন।

১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি রোববার সকালে এক এক অজ্ঞাত টেলিফোন কল থেকে জহিরকে জানানো হয় তাঁর বড় ভাই মহীদুল্লাহ কায়সারকে মিরপুর বারো নম্বরে বন্দী রাখা হয়েছে। খবরটি পাওয়ার পরই জহির রায়হান পরিচিত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে করে মিরপুরে যান। সেদিন সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ পাকিস্তানী বিহারিরা আশেপাশের বাড়িঘর থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও হ্যান্ড গ্রেনেড নিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। কেউ এই হামলার জন্য প্রস্তুত না থাকায় পাল্টা আক্রমণের সুযোগ পায়নি। বিহারিদের অতর্কিত এই হামলায় ৪২ জন সেনাসদস্য নিহত হন। কিন্তু নিহতদের মাত্র ৩ থেকে ৪ জনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল।

১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির সেই রাতের পর থেকেই নিখোঁজ রয়েছেন ৩৭ বছরের তরুণ চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান।

One comment

আপনার মতামত জানান