রাজনারায়ণ বসু

রাজনারায়ণ বসু

উনিশ শতকে যে সমস্ত বুদ্ধিজীবী এবং লেখক বঙ্গীয় রেনেসাঁসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম রাজনারায়ণ বসু (Rajnarayan Basu)। ব্রাহ্মবাদের প্রতিরক্ষাকারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে তাঁকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পিতামহ’ অ্যাখা দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়কার প্রগতিশীল প্রবন্ধকার হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় নিয়মিত লিখতেন তিনি। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধে উপনিষদের ইংরেজি অনুবাদও করেছিলেন রাজনারায়ণ যিনি আবার ইয়ং বেঙ্গলেরও সদস্য ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের জগতে মধুসূদন দত্তের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব সুবিদিত। ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার উন্নতির প্রতি তাঁর গভীর লক্ষ্য ছিল। নারীশিক্ষার জন্য মেদিনীপুরে প্রথম বালিকা বিদ্যালয়ও স্থাপন করেছিলেন রাজনারায়ণ বসু। নবগোপাল মিত্রের ‘হিন্দুমেলা’র উদ্বোধন হয়েছিল তাঁরই হাতে। সাহিত্য পরিষদের সভায় বাংলা ভাষার প্রচলনের কথা প্রথম বলেন তিনিই। ‘সঞ্জীবনী সভা’ নামে এক রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও রাজনারায়ণ বসু ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।

১৮২৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ শাসনাধীন কলকাতার নিকটবর্তী চব্বিশ পরগণা জেলার বোড়াল গ্রামে এক শিক্ষিত পরিবারে রাজনারায়ণ বসুর জন্ম হয়। তাঁর বাবা নন্দকিশোর বসু রাজা রামমোহন রায়ের স্কুলে ইংরেজি শিখেছিলেন এবং তাঁর ভাবাদর্শ দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। রাজনারায়ণের মা-ও ছিলেন অত্যন্ত সরল এবং ধার্মিক। নন্দকিশোর কলকাতায় হরকরা অফিসে কেরানির কাজ করেছিলেন বেশ কিছুদিন। সেই কাজে উৎকোচ গ্রহণের অনেক সুযোগ থাকলেও কখনও তিনি সেকাজ করেননি। রাজনারায়ণ বসু বাল্যকাল থেকেই পড়াশোনায় অতীব মনোযোগী ছিলেন। রাস্তায় কোনও আকর্ষণীয় তামাশা, আমোদ-প্রমোদ ঘটে গেলেও বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলতেন না তিনি।

রাজনারায়ণের যখন সাত বছর বয়স তখন তাঁর বাবা তাঁকে পড়াশোনার জন্য কলকাতায় নিয়ে আসেন এবং এখানে এক গুরুমশায়ের পাঠশালাতে ভর্তি হন তিনি। এরপর ইংরেজি শিক্ষার জন্য তাঁর বাবা তাঁকে বৌবাজারের একটি ছোট্ট অন্ধকার ঘরে শম্ভু মাস্টারের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। এই শম্ভু মাস্টারের স্কুল থেকে হেয়ার সাহেব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্কুলে গিয়ে ভর্তি হন রাজনারায়ণ। হেয়ার সাহেবের স্কুলের নাম ছিল ‘স্কুলস সোসাইটিস স্কুল’। হেয়ার সাহেবের সেই স্কুলে পড়বার সময় শিক্ষক হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেই স্কুলে পড়াকালীন হাতে লেখা একটি সংবাদপত্রও প্রকাশ করতেন রাজনারায়ণ যার নাম ছিল ‘ক্লাব ম্যাগাজিন’। এরপর ১৮৪০ সালে হেয়ার সাহেবের স্কুল থেকে তিনি সেকালের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিন্দু কলেজে ভর্তি হন অধ্যয়নের জন্য। তখন মাঝে-মধ্যে হেয়ার সাহেবের স্কুলের ছাত্ররা অবৈতনিকভাবেই হিন্দু কলেজে ভর্তির সুযোগ পেত। প্রথমে তিনি হিন্দু কলেজের থার্ড ক্লাসে অর্থাৎ স্কুল বিভাগের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সে বছর বহু পুস্তক পুরস্কারস্বরূপ পান রাজনারায়ণ৷ তখন ভাল ছাত্রদের পরীক্ষার উত্তর সংবাদপত্রে ছাপা হত। দুই একবার তাঁর সাহিত্য পুরাতত্ত্ব ও ধর্মনীতি বিষয়ক উত্তর সংবাদপত্রে ছাপা হয় এবং ধর্মনীতির জন্য রৌপ্য পদক লাভ করেন তিনি।


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

সেই হিন্দু কলেজের সময়টা রাজনারায়ণের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল বলেই মনে হয়। সেখানে তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর, নীলমাধব মুখোপাধ্যায়, গোবিন্দচন্দ্র দত্তের মতো প্রতিভাবান সমস্ত মানুষ। এঁদের মধ্যে মধুকবি মাইকেলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কাহিনি তো সুবিদিত। এছাড়াও সেই কলেজে পড়াকালীন তাঁর প্রথম বিবাহ সম্পন্ন হয় শিয়ালদহের রাধামোহন মিত্রের কন্যা শ্রীমতী প্রসন্নময়ীর সঙ্গে। তখন রাজনারায়ণের বয়স সতেরো এবং কন্যার বয়স এগারো বছর। এছাড়াও সেই কলেজে পড়বার সময় বিখ্যাত ইংরেজি লেখক কিশোরীচাঁদ মিত্রকে রামমোহন রায়ের জীবনী রচনায় সাহায্য করেছিলেন তিনি। আবার রামগোপাল ঘোষের সঙ্গে রাজমহল, গৌড় প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণ করে তাঁর ধর্মমতেও কিছু পরিবর্তন চলে আসে। এখানে একটি ব্যাপার উল্লেখ্য। হিন্দু কলেজে পড়াকালীন রাজনারায়ণ বসু মদ্যপানে আসক্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং প্রায়শই বন্ধুদের সঙ্গে গোলদিঘিতে মদ্যপান করতেন। সেই খবর নন্দকিশোর বসুর কানে পৌঁছেছিল। পুত্রের মদ্যপানের পরিমাণ সীমিত করবার জন্য তিনি একটি কৌশল করেছিলেন। নিজের ঘরে একান্তে পুত্রকে ডেকে তাঁর সঙ্গে বসেই মদ্যপানের আয়োজন করলেন নন্দকিশোর এবং দু-পাত্রের বেশি ছেলেকে দিতেন না। শর্ত দিলেন, অন্যত্র মদ খাওয়ার খবর পেলে এইটুকুও আর দেবেন না। কিন্তু পুনরায় অন্যত্র অতিরিক্ত মদ্যপান করে অসুস্থ হয়ে পড়েন রাজনারায়ণ বসু এবং সেসময়তেই কলেজ পরিত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে ইয়ং বেঙ্গলেরও সদস্য হয়েছিলেন তিনি।

কলেজ ছাড়ার পরই রাজনারায়ণের উনিশ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৮৪৫ সালে তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। তার আগে অবশ্য তাঁর প্রথমা স্ত্রী জলে ডুবে মারা যান। বাবার মৃত্যুর পরেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আলাপ হয় রাজনারায়ণের এবং ১৮৪৬-এর শুরুর দিকে তিনি আদি ব্রাহ্মসমাজের অধীনে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। তারপর থেকে সম্পূর্ণরূপে মদ্যপান ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর কলেজের সহপাঠীরাও ভীষণ আশ্চর্য হয়েছিল এই ঘটনায়। একটা বিষয় এখানে উল্লেখ্য যে, পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজের রক্ষণশীল আচরণকে কেন্দ্র করে দুটি দলে তা বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। একদিকে ছিল কেশবচন্দ্র সেনের নববিধান ব্রাহ্মসমাজ, অন্যদিকে দেবেন্দ্রনাথের আদি ব্রাহ্মসমাজ। রাজনারায়ণ অবশ্য দেবেন্দ্রনাথের পক্ষেই ছিলেন আজীবন।

১৮৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তত্ত্ববোধিনী সভা রাজনারায়ণকে ৬০ টাকা বেতনে উপনিষদের ইংরেজি অনুবাদকের কর্মের জন্য নিযুক্ত করে। মূলত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধেই এই কাজে হাত দেন তিনি। দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে ‘ইংরেজি খাঁ’ বলে ডাকতেন। ছয় মাস সেই কাজ করার পর ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ কাজে নিযুক্ত হন তিনি৷ ঈশ, কেন, কঠ, মুণ্ডক ইত্যাদি আরও কয়েকটি উপনিষদেরও ইংরেজি তরজমা করেছিলেন রাজনারায়ণ বসু। দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে উলুবেড়িয়ার নদী ও দামোদর অতিক্রম করে বর্ধমান ভ্রমণের সময়েও তাঁদের মধ্যে ধর্মচর্চা চলত। ইতিমধ্যে ১৮৪৭ সালে রাজনারায়ণ দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। পাত্রী কলকাতার হাটখোলার দত্তবাড়ির অভয়াচরণ দত্তের মেয়ে নিস্তারিণী দত্ত। অভয়াচরণ খুবই স্নেহ করতেন তাঁর জামাইকে। এমনকি রাজনারায়ণ বসু সেসময় ভ্রাতাদের বিধবা বিবাহ দিলেও অভয়াচরণ তাঁর প্রতি বিমুখ হননি।

উপনিষদের শ্লোক, বেদ ঈশ্বরপ্রত্যাদিষ্ট কিনা, ব্রাহ্মধর্ম সম্বন্ধীয় নানা তত্ত্ব আলোচনায় তখন দিন অতিবাহিত হত রাজনারায়ণদের। মাঝেমাঝেই দেবেন্দ্রনাথ এবং তিনি ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তেন। ১৮৪৯ সালে রাজনারায়ণ সংস্কৃত কলেজে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সেই সংস্কৃত কলেজ থেকে মেদিনীপুরে বদলি হয়ে যান তিনি। সেখানকার জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ভার গ্রহণ করেন ১৮৫১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে। পনেরো বছর অর্থাৎ ১৮৬৬ সালের ৬ মার্চ পর্যন্ত সেই পদের দায়িত্ব সামলেছিলেন রাজনারায়ণ। শারীরিক অসুস্থতার কারণেই সেই পদ পরিত্যাগে বাধ্য হন তিনি। সেই মেদিনীপুর তাঁর নানাবিধ কর্মকাণ্ডে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। শিক্ষাব্যবস্থার ভার গ্রহণ করে মেদিনীপুরের সেই জেলা স্কুলের উন্নতিসাধনের জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করেন তিনি। তার ফলও ফলেছিল। এডুকেশন কাউন্সিল স্বীকার করেছিল রাজনারায়ণের দৌলতেই মেদিনীপুরের ছাত্রদের উন্নতি হয়েছে। ছাত্রদের নিয়ে বিতর্কসভাও গঠন করেছিলেন রাজনারায়ণ বসু যাতে তাদের বৌদ্ধিক বিকাশ সম্ভব হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের নানাবিধ বইপত্র পড়ার সুবিধার জন্য একটি পাঠাগারও নির্মাণ করেছিলেন তিনি। এমনকি শ্রমিক কৃষকদেরও শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবেছিলেন রাজনারায়ণ। সেই হেতু তাদের জন্য রাত্রিকালীন এক স্কুল স্থাপন করেন তিনি। সর্বোপরি স্ত্রী শিক্ষার বিস্তারের উদ্দেশ্যে রাজনারায়ণ একটি বালিকা বিদ্যালয়ও স্থাপন করেন।

মেদিনীপুরে তাঁর আরেক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হল সেখনাকার ব্রাহ্মসমাজের পুনঃসংস্থাপন এবং তার উন্নতিসাধন৷ ১৮৫২ সালে এটি পুনঃসংস্থাপিত হয়েছিল। কয়েক বছর পর চাঁদা তুলে এক সমাজগৃহও নির্মাণ করিয়েছিলেন তিনি। ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে একটি ধর্মালোচনা সভা ও কিছুদিন পর তা উঠে গেলে সঙ্গতসভাও স্থাপন করেন তিনি। সেই মেদিনীপুরেই ‘ধর্মতত্ত্বদীপিকা’ নামক গ্রন্থ প্রণয়ন শুরু করেন রাজনারায়ণ বসু এবং সমাপন করেন সেই মেদিনীপুরেই। ব্রাহ্মধর্ম বিষয়ক অধিকাংশ বক্তৃতা তিনি মেদিনীপুরেই দিয়েছিলেন। সেখানে থাকতেই তিনি ইংরেজি ভাষায় ‘ডিফেন্স অফ ব্রাহ্মইজম অ্যান্ড ব্রাহ্মসমাজ’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন।

জাতীয় ভাবধারা বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে রাজনারায়ণ বসুর উদ্যোগে ‘জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনারায়ণের দেশপ্রেম ছিল তীব্র। দেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর প্রবল ও অকৃত্রিম ভালোবাসা সুবিদিত। উক্ত সভার সভ্যদেরকে ‘গুড নাইট’-এর বদলে বলতে হত ‘সুরজনী’ এবং ১ জানুয়ারির বদলে ১ বৈশাখে তাঁরা পরস্পরকে অভিনন্দন জানাত। এসবই রাজনারায়ণের বিধান। পরবর্তীকালে ঐ সভার কার্যবিবরণীর পুস্তক থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়ে নবগোপাল মিত্র ‘হিন্দুমেলা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৮৭৫ সালে সেই মেলার উদ্বোধক ছিলেন রাজনারায়ণ। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের (বাংলা সাহিত্য সমাজ) সভায় বাংলা ব্যবহারের পরামর্শ দেন। বিলাত ফেরতদের আত্মগরিমা ও অহংকারমিশ্রিত আচরণকে সহ্য করতে পারতেন না তিনি, কিন্তু কাউকে বিলাত যাওয়ায় নিষেধ করেননি তিনি কখনও। দেশীয় প্রথায় ব্যায়াম, দেশীয় ঔষধ এমনকি দেশীয় সঙ্গীতের প্রচারের সপক্ষে কথা বলেছেন তিনি বারবার।

মেদিনীপুরে থাকাকালীন তাঁর আরও একটি উল্লেখযোগ্য এবং অভিনব কাজ ‘সুরাপান নিবারণী সভা’ গঠন। ১৮৬০ সালে মদ্যপান ত্যাগ করেছিলেন রাজনারায়ণ এবং তার পরের বছর অর্থাৎ ১৮৬১ সালে এই ‘সুরাপান নিবারণী সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। রাজনারায়ণের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভোলানাথ চক্রবর্তী মদ্যপান-বিরোধী কয়েকটি সঙ্গীতও রচনা করেছিলেন। রাজনারায়ণ মেদিনীপুরের থাকাকালীনই ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। বিচক্ষণ মানুষের মতই তিনিও সিপাহিদের পক্ষে দাঁড়াননি ঠিকই, তবে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন। বিশেষত সেখানকার শেখাওয়াত ব্যাটেলিয়ন নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল।

১৮৬৬ সালে মেদিনীপুর ত্যাগ করেন রাজনারায়ণ। ফিরে এসে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা বিষয়ক, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক কয়েকটি মননশীল বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি। ১৮৭৩ সালে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা বিষয়ক বক্তৃতায় তাঁর জাতীয়তাবাদী চেতনার আঁচ পাওয়া গিয়েছিল স্পষ্টভাবেই। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন স্থাপিত হলে রাজনারায়ণ তার সভ্য হন। ১৮৭৮ সালে লিটনের দেশীয় ভাষা সংক্রান্ত আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন দেশপ্রেমিক রাজনারায়ণ। ‘সঞ্জীবনী সভা’ নামক এক গুপ্ত রাজনৈতিক দলের সভাপতির পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। ১৮৮০ সালে ইংরেজিতে তিনি একটি বই লিখতে শুরু করেন, পরে সেটির বাংলা তরজমা করে ‘বৃদ্ধ হিন্দুর আশা’ নাম দিয়ে ৮০-র দশকের মাঝামাঝি ‘নবজীবন’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন তিনি। দেওঘরে অবস্থানকালে তিনি ‘তাম্বুলোপহার’ এবং ‘সারধর্ম’ নামে দুটি পুস্তক রচনা করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনাকালে প্রথম তিনটি সর্গ মধুসূদন ডাকযোগে রাজনারায়ণকে পাঠিয়েছিলেন পড়ে দেখবার জন্য। ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে’রও একটি আলোচনা লিখেছিলেন রাজনারায়ণ বসু ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ড’ পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথ এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ খুবই প্রভাবিত হয়েছিলেন তাঁর দ্বারা।

রাজনারায়ণের রচিত আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ‘সেকাল আর একাল’, ‘হিন্দু বা প্রেসিডেন্সী কলেজের ইতিবৃত্ত’, ‘সায়েন্স অফ রিলিজিয়ন’, ‘রিলিজিয়ন অফ লাভ’, ‘ব্রহ্মসাধন’, ইত্যাদি। একটি ‘আত্মচরিত’ও রচনা করেন তিনি। মেদিনীপুরে তাঁর মহৎ কর্মকাণ্ড তাঁকে ঋষি রাজনারায়ণে পরিণত করেছিল। তিনি নিজেই লিখেছিলেন যে জনমানসের কাছে তিনি ‘মেদিনীপুরের রাজনারায়ণ বসু’ নামেই পরিচিত।

১৮৯৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ৭৩ বছর বয়সে রাজনারায়ণ বসুর মৃত্যু হয়।

তথ্যসূত্র


  1. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু (সম্পা.), 'সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান', সাহিত্য সংসদ, মে ১৯৬০, কলকাতা, পৃষ্ঠা - ৪৫৭
  2. https://www.midnapore.in/
  3. https://en.wikipedia.org/
  4. https://sahityakalp.com/
  5. https://brill.com/
  6. https://www.anandabazar.com/

One comment

আপনার মতামত জানান