গণেশ পাইন

গণেশ পাইন

ভারতীয় চিত্রকলাকে যাঁরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সসম্মানে পৌঁছে দিয়েছেন এবং সমস্ত বিশ্বের সামনে বাংলাকে গৌরবান্বিত করে তুলেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম চিত্রশিল্পী গণেশ পাইন (Ganesh Pyne)। তিনি জলরঙ, গাউচে, টেম্পারা ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমে ছবি এঁকেছেন আজীবন। পেশায় একজন ড্রাফটসম্যান হিসেবেও কাজ করেছিলেন তিনি। বিখ্যাত ‘বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট’ আন্দোলনের একজন অগ্রগণ্য শিল্পী ছিলেন তিনি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই আন্দোলনকে সংগঠিত করেছিলেন। শৈশব থেকেই যে সমস্ত উত্তাল রক্তাক্ত সময়ের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন তিনি, তাঁর রঙ-তুলি-ক্যানভাস পরবর্তীকালে সেই অশান্ত অন্ধকারময় সময়কেই জীবন্ত করে তুলেছে বারংবার। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় কলকাতা শহরের রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষের লাশ ডিঙিয়ে গিয়েছেন তিনি আর রঙে-রেখায় তারই জলন্ত প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। আবার সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলনে যে মৃত্যু-মিছিল দেখেছিল শহরবাসী, তাঁর ক্যানভাসে সেই বিভীষিকাময় সময়ও যথাযথভাবে  ফুটে উঠেছিল। তাঁর একের পর এক ছবিতে তীরবিদ্ধ মাথার খুলি, কঙ্কাল ইত্যাদি বীভৎসতা লক্ষণীয়। একরকম কাব্যিক পরাবাস্তবতা লক্ষ্য করা যায় তাঁর ছবির মধ্যে। বাংলা লোককাহিনী, কখনও বা পৌরাণিক কাহিনীকে তিনি তাঁর ছবির বিষয় হিসেবে ব্যবহার করেছেন বারবার। মৃত্যু, বেদনা, একাকীত্ব তাঁর ক্যানভাসের কালো রঙের ভিতরে স্পষ্ট হয়ে ফুটে থাকে। জীবনে খুব কমই প্রদর্শনী করেছিলেন গণেশ পাইন। তবে কেবল দেশে নয়, বিদেশেও তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল। পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁর শিল্পপ্রতিভার উপর একটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছিলেন।

১৯৩৭ সালের ১১ জুন কলকাতা শহরের এক অভিজাত পরিবারে শিল্পী গণেশ পাইনের জন্ম হয়। উত্তর কলকাতার কবিরাজ রো-তে, একটি বিধ্বস্ত প্রাসাদোপম বাড়িতে তাঁরা থাকতেন। কলকাতা শহরেই বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। তাঁর বড় ভাই কার্তিকচন্দ্র পাইনও ছিলেন একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। ছোটবেলায় ঠাকুমা নন্দরাণীর মুখে রূপকথা, লোককাহিনী ইত্যাদি শুনেছিলেন গণেশ। সেই কাহিনী শুনে শুনেই তাঁর কল্পনাশক্তির জোর বেড়ে উঠেছিল। সেই কাহিনী শোনার অভিজ্ঞতা আজীবন তাঁর ভিতরে রয়ে গিয়েছিল এবং তাঁর চিত্রকর্মেও প্রভাব ফেলেছিল বিস্তর। তিনি নিজেই বলেছিলেন যে তাঁর আভ্যন্তরীণ জগত শৈশবের মধ্যে নিহিত। এছাড়াও ছোটবেলায় শিশু-কিশোরদের সাময়িকপত্র ‘মৌচাক’-এরও আগ্রহী পাঠক ছিলেন তিনি। সেই পত্রিকাতেই বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা একটি ছবি দেখে তাঁর কল্পনাপ্রবণ কিশোর মন আন্দোলিত হয়ে ওঠে। এই ছবিটি বাস্তবিকই গভীর প্রভাব ফেলেছিল তাঁর উপর। তিনি তখন সেই পত্রিকাটি পড়তে শুরু করেন মন দিয়ে এবং ঘন্টার পর ঘন্টা নিজের কালো পাথরের স্লেটে চক দিয়ে আঁকাআঁকি করতে থাকেন। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে পড়ার সময় মীরা দত্তের (Mira Dutta) সঙ্গে পরিচয় এবং প্রেম হয়েছিল তাঁর। কিন্তু ধারাবাহিক দারিদ্র্যের কারণে কখনও তাঁকে বিবাহ করবার সুযোগ পাননি তিনি। আশির দশকের শেষ দিকে পুনরায় তাঁদের দেখা হয় এবং অবশেষে প্রায় তিরিশ বছর অপেক্ষা করবার পর ১৯৯০ সালে মীরা এবং গণেশ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। 

চার বছর বয়সে গণেশ পাইনকে সিটি কলেজিয়েট স্কুলের শিশু বিভাগে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানেই ম্যাট্রিকুলেশন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন তিনি।  ১৯৪৬ সালে যখন তাঁর নয় বছর বয়স তখন প্রথমে তাঁর বাবার মৃত্যু হয় যা তার উপরে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। সে বছরই কলকাতায় ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে তাঁর পরিবারকে সেই বিশাল বাড়ি থেকে উৎখাত করা হয়েছিল। অবশেষে কলকাতা মেডিকেল কলেজের একটি নিরাপদ অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয় তাঁদের। সেসময় গাড়ি বোঝাই মৃতদেহ আনার বীভৎস দৃশ্য দেখেছিলেন তিনি। দাঙ্গার দিনগুলির ভয়াবহ স্মৃতি তাঁর মনে প্রোথিত হয়ে ছিল আজীবন। কলকাতার রাস্তায় লাশের গায়ে হোঁচট পর্যন্ত খেয়েছিলেন তিনি। সেই স্মৃতি রঙে-রেখায় তাঁর ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছিল পরবর্তীকালে। 


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

পনেরো বছর বয়সটি তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। সেই বয়সে ভারতীয় জাদুঘরে শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাজের একটি বড় প্রদর্শনী দেখবার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। ছোটবেলায় দেখা অবন ঠাকুরের ছবি শিশু মনে আলোড়ন তুলেছিল, কিন্তু এবারে তুলনামূলক পরিণত মনের গণেশ অবনীন্দ্রনাথের একরাশ চিত্রকর্মের সামনে দাঁড়িয়ে যেন মনে মনে নিজের জীবনের উদ্দেশ্য আবিষ্কার করতে পারলেন। এই ঘটনা তাঁর জীবনের এক বাঁকবদল নিঃসন্দেহে। এরপর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পাশ করবার পর গণেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার দিকে আর যাবেন না তিনি। বরং বড় কিছু করতে চান তখন। যদিও তাঁর প্রথাগত শিক্ষা থেকে সরে আসার এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে পরিবারের লোকজন একমত হতে পারেননি। তাঁরা চেয়েছিলেন তাঁদের ছেলে বিদ্যায়তনিক শিক্ষা সমাপ্ত করে কোনো একটি কাজের জন্য যোগ্যতা অর্জন করুক। অবশেষে তাঁর কাকা মনোহর পাইনের উদ্যোগে তিনি ভর্তি হন ‘গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্ট’-এ৷ চিত্রশিল্পে তাঁর দক্ষতা এবং সহজাত সৃষ্টি প্রবণতা দেখে তাঁকে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। গণেশ যদিও ওয়েস্টার্ন চিত্রকলা বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর হৃদয় পড়ে ছিল প্রাচ্য চিত্রকলার দিকেই। তবে পাশ্চাত্য চিত্রকলার বিকাশকে যত্নসহকারে অধ্যয়ন করেছিলেন তিনি। গণেশ পাইন ঠিক করেছিলেন কোনও রকম আন্দোলনের অনুসরণ তিনি করবেন না। তবে ‘বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট’ আন্দোলনের ধারায় তাঁর অনেক ছবিকেই ফেলা চলে। ১৯৫৫ সালে জলরঙে তাঁর আঁকা ‘শীতের সকাল’ শিরোনামের ছবিতে স্পষ্টত অবনীন্দ্রনাথের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। 

একবার পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু একটি প্রদর্শনীতে তাঁর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। গণেশ খুবই লাজুক এক শিল্পী ছিলেন। এই দৃশ্য দেখে তিনি লুকিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন কিন্তু লেডি রাণু মুখার্জি তাঁর সঙ্গে জওহরলালের পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁর ছবিটি সেই প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার লাভ করেছিল। অধ্যাপকেরা অবশ্য এতে তেমন বিস্মিত হননি, কারণ তাঁরা গণেশের প্রতিভা সম্পর্কে যথেষ্ট আশাবাদী ছিলেন। ১৯৫৯ সালে তিনি গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ভারতের প্রথম অ্যানিমেশন স্টুডিও মন্দার স্টুডিওতে কাজ করতে গিয়েছিলেন। জীবনের এই পর্বটিও তাঁর ওপরে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। মান্দার স্টুডিওতে একজন ড্রাফটসম্যান হয়ে ওঠেন তিনি। স্টুডিওটি পরিচালনা করতেন বিদ্রোহী চলচ্চিত্র পরিচালক মান্দার মল্লিক যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানি সফর করেছিলেন এবং ফ্রিটজ ল্যাং এবং লেনি রিফেনস্টালের সংস্পর্শে এসেছিলেন। মল্লিক ক্যালিফোর্নিয়ার ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওর মতো কলকাতায় একটি প্রাণবন্ত কার্টুন শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি তার শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে অভিজ্ঞ ডিজনি অ্যানিমেটর ক্লেয়ার উইকসকে নিয়ে এসেছিলেন। উইকসের কাছে পাইন শিখেছিলেন বিভিন্ন আবেগ প্রকাশের জন্য চরিত্রের আকৃতিকে কীভাবে বিকৃত এবং অতিরঞ্জিত করতে হয়। এই শৈলীটি পাইন আজীবন তাঁর চিত্রকর্মে নানাভাবে ব্যবহার করে গিয়েছেন। মন্দার মল্লিক পাইনকে ইউরোপীয় আভাঁ-গার্দ ছবির সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এই চলচ্চিত্রগুলির শৈল্পিক দৃশ্যাবলি গণেশের ছবিতে প্রভাব ফেলতে থাকে। 

একসময় জীবনধারণের জন্য গণেশ পাইন কেসোরাম কটন মিলসে একজন ডিজাইনার হিসেবেও কাজ করেছিলেন। এইসময়ে রঙ কেনার জন্য যথোপযুক্ত অর্থের অভাবে তিনি কালি ও কলম ব্যবহার করে ছোট ছোট স্কেচ তৈরি করতে থাকেন। ১৯৬৩ সালে গণেশ ‘সোসাইটি ফর কনটেম্পোরারি আর্টিস্ট’-এ যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে বিকাশ ভট্টাচার্য, শ্যামল দত্ত রায়, ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত এবং গণেশ হালুইয়ের মতো স্থানীয় শিল্পীরা ছিলেন। শীঘ্রই চিত্রশিল্পের এই নব্য আন্দোলনের একজন মুখ্য অংশ হয়ে ওঠেন গণেশ পাইন। যদিও রঙ্ দিয়ে ছবি আঁকতে পারতেন না সেসময়, কিন্তু এসময় চিত্রকর্মে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন তিনি। 

ষাটের দশকে তিনি আভারী মাধ্যমে ছবি এঁকেছিলেন বেশ কিছু। ক্যানভাসে স্বচ্ছ রঙ প্রয়োগ করে তারপর তা পুড়িয়ে একপ্রকার আলো-ছায়ার ক্ষেত্র ক্যানভাস জুড়ে ফুটিয়ে তুলতেন। এই প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট শ্রমসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ ছিল। সেই কারণে এই মাধ্যমে বছরে মাত্র ১০টির মতোই ছবি তৈরি করতে পারতেন গণেশ পাইন। তাঁর আভারী মাধ্যমের ছবিগুলির মধ্যে ফুটে উঠত এক পরাবাস্তবতা। বাস্তবতা এবং কল্পকাহিনীর মধ্যবর্তী এক জগত গড়ে তুলতেন তিনি।  ১৯৭০-এর দশক তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এসময় জলরঙে ছবি আঁকছিলেন তিনি। তাছাড়াও সত্তর দশকের কলকাতায় নকশাল আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক ডামাডোলের সময়, চারিদিকে কেবলই মৃত্যু-মিছিল আর হাহাকার। সেই রক্তাক্ত সময়ের আলেখ্য রূপ পেয়েছিল তাঁর রঙ-তুলির আঁচড়ে। ১৯৭২ সালে আঁকা ‘দ্য বার্ড’ নামক ছবিতে যে বিধ্বস্ত পাখিটিকে লক্ষ্য করা যায় তা আসলে ভগ্নপ্রায় সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। ১৯৭৬ সালে তাঁর আঁকা ‘দ্য উন্ডেড বিস্ট’ ছবিটিও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে মুম্বাইয়ের একটি পত্রিকা ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’-র পক্ষ থেকে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনকে ভারতের সেরা চিত্রশিল্পীর নাম বলতে বলা হলে, মকবুল নির্দ্বিধায় গণেশ পাইনের নাম বলেছিলেন। 

সুইস-জার্মান চিত্রশিল্পী পল ক্লী-র ‘দ্য থিঙ্কিং আই’ এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল পাইনকে। ছাত্রাবস্থায় ডাচ চিত্রশিল্পী রেমব্রান্টের দ্বারাও ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। পরাবাস্তববাদী এবং বিমূর্ত ছবিগুলি জলরঙে আঁকা শুরু করেছিলেন তিনি, তারপর গাউচে, টেম্পারা, আভারী ইত্যাদি নানা মাধ্যমে কাজ করতে থাকেন। মহাভারতের উপর আঁকা তাঁর সিরিজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মূলত একলব্য এবং অম্বার উপরে দৃষ্টিনিবদ্ধ রেখেই অধিকাংশ ছবি এঁকেছিলেন তিনি। ২০১০ সালে কলকাতায় এই সিরিজটি প্রদর্শিত হয়েছিল। এছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য একটি চিত্রকর্ম হল, মা ও শিশুর ছবি ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’। মা ও শিশুর একটি ঐতিহ্যগত ধারণা ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি এই ছবিতে। উল্লেখ্য এই ছবিতে মায়ের চেহারাটিকে অনেকটা দুর্গা বা জগদ্ধাত্রীর মতো করে অঙ্কন করেছেন শিল্পী গণেশ পাইন। লোকশিল্পের সাধারণ রূপগুলি ভেঙে দিয়ে যেন পুনর্গঠন করেছিলেন পাইন। ঐতিহ্য এবং আধুনিকতা, অতীত ও বর্তমানের সেতুবন্ধন ঘটিয়েছিলেন যেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি চিত্রকর্ম হল, ‘বয় অ্যান্ড দ্য পেইন্টেড হর্স’, ‘বিফোর দ্য চ্যারিয়ট’ (১৯৭৮), ‘দ্য সেন্টস অ্যান্ড দ্য অফিসিয়ালস’ (১৯৯১), ‘নাইট অফ দ্য পাপেটিয়ার’ (১৯৯৪) ইত্যাদি। একসময় তিনি মন্দিরের স্কেচ করেছিলেন অনেকগুলি।  ১৯৮০-এর দশকে তাঁর ছবিগুলি সমস্ত ভারতীয় শিল্পীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম পেয়েছিল। কিন্তু শিল্পের বাণিজ্যীকরণকে পছন্দ করতেন না তিনি। ফলে শিল্প সংগ্রাহকদের থেকে সবসময় দূরে থাকতেন এবং একক প্রদর্শনীও খুব বেশি করেননি গণেশ পাইন। 

১৯৬৯ সালে প্যারিস বিয়েনেলের প্রদর্শনীতে তাঁর ছবি অংশগ্রহণ করেছিল। আবার ১৯৭০ সালে পশ্চিম জার্মানিতে সমসাময়িক ভারতীয় চিত্রকর্মের প্রদর্শনীতেও তাঁর ছবি জায়গা পেয়েছিল। এছাড়াও প্যারিস, লন্ডন, ওয়াশিংটনে তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল। দিল্লির ‘দ্য ভিলেজ’ গ্যালারিতে প্রথম গণেশ পাইনের একক প্রদর্শনী হয়েছিল। তখন তাঁর বয়স ছিল পঞ্চাশ বছর। ১৯৯৮ সালের শেষের দিকে কলকাতার ‘সেন্টার অফ ইন্টারন্যাশনাল মডার্ন আর্ট’ তাঁর কাজের বিরাট প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। 

২০১১ সালে ‘ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স’ চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার প্রদান করেছিল গণেশ পাইনকে। কেরালা সরকার রাজা রবি বর্মা পুরস্কারে সম্মানিত করেছিল তাঁকে। গণেশ পাইনকে নিয়ে লেখা হয়েচে একাধিক গ্রন্থ। এলা দত্ত রচনা করেছিলেন ‘গণেশ পাইন, হিজ লাইফ অ্যান্ড টাইমস’-এর মতো বই। রঞ্জিত হোসকোটের লেখা ‘গণেশ পাইন : আ পিলগ্রিম ইন দ্য ডোমিনিয়ন অফ শ্যাডোজ’ একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। ১৯৯৮ সালে বিখ্যাত পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত গণেশ পাইনকে নিয়ে ‘আ পেইন্টার অফ ইলোকেন্ট সাইলেন্স: গণেশ পাইন’ নামে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছিলেন। সেটি শ্রেষ্ঠ শিল্পকলা বিষয়ক চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সম্মানিত হয়৷ 

২০১৩ সালের ১২ মার্চ কলকাতার একটি হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৭৬ বছর বয়সে গণেশ পাইনের মৃত্যু হয়। 

One comment

আপনার মতামত জানান