অরুন্ধতী রায়

অরুন্ধতী রায়

অরুন্ধতী রায় (Arundhati Roy) একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন প্রখ্যাত ভারতীয় লেখিকা যিনি মূলত ইংরেজি ভাষায় লিখে থাকেন। তিনি তাঁর লেখা দ্য ‘গড অফ স্মল থিংস’ (God of small things) বইটির জন্য ‘ম্যান বুকার প্রাইজ ফর ফিকশন’ পেয়েছেন। এছাড়াও তিনি একজন রাজনৈতিক কর্মী এবং মানবাধিকার ও পরিবেশ নিয়ে তিনি সবসময় সোচ্চার হয়েছেন।

১৯৬১ সালে ২৪ নভেম্বর মেঘালয়ের শিলংয়ে অরুন্ধতী রায়ের জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম সুজান্না অরুন্ধতী রায়। তাঁর বাবার নাম রাজীব রায় এবং তাঁর মায়ের নাম মেরী রায়। তাঁর বাবা ছিলেন একজন বাঙালি এবং তিনি শিলংয়ে চা বাগানের ম্যানেজার ছিলেন। তাঁর মা ছিলেন একজন মালায়ালি ক্রিশ্চান এবং তিনি একজন নারীবাদী ছিলেন। অরুন্ধতীর দুবছর বয়সেই তাঁর বাবা মার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর তিনি এবং তাঁর ভাই তাঁদের মায়ের সাথে কেরালায় চলে যান। সেখানে তাঁর মা একটি স্কুল খোলেন।

অরুন্ধতীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কোট্টাইয়ামের কর্পাস ক্রিস্টি স্কুলে। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার পর তিনি তামিলনাড়ুর নীলগিরিতে লরেন্স স্কুলে ভর্তি হন। বিদ্যালয় শিক্ষার পর তিনি স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে দিল্লির স্কুল অফ প্ল্যানিং অ্যান্ড আর্কিটেকচারে পড়াশোনা করেন। সেখানেই তাঁর সাথে স্থাপত্যবিদ গেরার্ড দ্য কুন্হার দেখা হয় এবং এরপর তাঁরা একসঙ্গে দিল্লিতে এবং গোয়ায় বসবাস শুরু করেন। পরে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ১৯৮৪ সালে তাঁর সাথে চলচ্চিত্র পরিচালক প্রদীপ কৃষেণের দেখা হয় এবং তাঁরা বিয়ে করলেও পরবর্তীকালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

অরুন্ধতী তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার হিসেবে। ১৯৮৯ সালে চিত্রনাট্যকার হিসেবে তাঁর প্রথম কাজ ছিল ‘ইন হুইচ অ্যানি গিভ ইট দোজ ওয়ানস’ নামক একটি চলচ্চিত্রে যেটি তাঁর স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্রী হিসেবে অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে রচিত ছিল। এই চলচ্চিত্রটিতে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন এবং ১৯৮৮ সালে তিনি এই ছবির চিত্রনাট্য লেখার জন্য জাতীয় পুরস্কার পান। এরপর ১৯৯২ সালে তিনি ‘ইলেকট্রিক মুন’ নামক আরেকটি ছবির চিত্রনাট্য লেখেন। এই দুটি চলচ্চিত্রই তাঁর স্বামী প্রদীপ কৃষেণের দ্বারা পরিচালিত ছিল। এর পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন ছবির সমালোচনা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লিখতেন।

১৯৯২ সালে অরুন্ধতী তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘গড অফ স্মল থিংস’ লিখতে শুরু করেন এবং ১৯৯৬ সালে সেটি শেষ করেন। এই বইটি কিছুটা আত্মজীবনীমূলক এবং কিছুটা উপন্যাসের মিশ্রণ। এই বইটি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর নাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৭ সালে এই বইটি ‘ম্যান বুকার প্রাইজ ফর ফিকশন’ লাভ করে। এই বইটিকে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস তাদের সেই বছরের উল্লেখযোগ্য বইয়ের তালিকায় তালিকাভুক্ত করে। এই বইটি দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্টসেলার (bestseller) তালিকায় চতুর্থ স্থানে ছিল। বইটি প্রকাশের এক মাসের মধ্যেই সেটি ১৮টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তার চাহিদা খুবই বেড়ে যায়। বহু বিদেশি পত্রিকায় এবং সংবাদপত্র এই বইটির সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল।

অরুন্ধতী এর পরে একটি টেলিভিশন ধারাবাহিকের চিত্রনাট্য লেখেন। সেই ধারাবাহিকটি নাম ছিল ‘দ্য বেনিয়ান ট্রি’ )। ২০০২ সালে তিনি একটি তথ্যচিত্রের চিত্রনাট্য লেখেন যার নাম ছিল ‘ড্যাম/এজ’ (Dam/Age)। তিনি সমকালীন রাজনীতি এবং সমাজ নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বহু লেখা লিখেছেন। এই লেখাগুলি পরে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৭ সালের জুন মাসে পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া এবং হামিশ হামিল্টন ইউকে (Hamish Hamilton UK)) যৌথভাবে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ প্রকাশ করে। এই বইটিও সেই বছরের ম্যান বুকার প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়েছিল। এছাড়া তাঁর অনেকগুলি প্রবন্ধ নিয়ে আরেকটি বই প্রকাশিত হয়েছে যার নাম ‘মাই সেডেশিয়াস হার্ট’ (My Seditious Heart)। ২০২০সালে বর্তমান ভারতীয় রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা নিয়ে তিনি ‘আজাদি’ নামক একটি বই লিখেছেন।

লেখালেখির পাশাপাশি অরুন্ধতী একজন রাজনৈতিক ও সমাজকর্মী। অ্যান্টি গ্লোবালাইজেশন (anti globalization) বা অল্টার গ্লোবালাইজেশনের (alter globalization) মতো আন্দোলনে তিনি যোগদান করেছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেন। তিনি ভারতের পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার হয়েছেন। কাশ্মীরের মানুষ যখন ২০০৮ সালে কাশ্মীরকে ভারতের থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন কাশ্মীরের দাবি করে তখন তিনি সেই দাবিকে সমর্থন করেন। এই কারণে তাঁকে বহু রাজনৈতিক দলের এবং মানুষের সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। তিনি নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে মেধা পাটেকর এর সাথে যোগ দেন। তিনি তাঁর বইয়ের রয়্যালটির (royalty) সব টাকা এবং বুকার প্রাইজ থেকে পাওয়া টাকা এই আন্দোলনের কাজের জন্য দান করেন। তিনি এই আন্দোলনের ওপর তৈরি হওয়া ফ্যানী আর্মস্ট্রঙ পরিচালিত তথ্যচিত্র ‘ড্রাউন্ড আউট’ (Drowned Out) এ কাজ করেছেন। এই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণেও তাঁকে বেশ কিছু আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়তে হয়েছে।

তিনি আমেরিকার দ্বারা আফগানিস্তানে মিলিটারি আক্রমণকেও কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন জায়গায় আমেরিকার আগ্রাসন নীতিকে দৃঢ় ভাষায় আক্রমণ করেছেন। তিনি ইরাক আমেরিকার যুদ্ধকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছিলেন এবং ২০০৫ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রাইবুনাল অন ইরাকে (World Tribunal on Iraq) যোগদান করেন। ২০০৬ সালের মার্চ মাসে তিনি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশের ভারত সফরকে সমালোচনা করেন এবং তাঁকে একজন ‘যুদ্ধ অপরাধী’ (war criminal) বলে উল্লেখ করেন। ১৯৯৮ সালে রাজস্থানের পোখরানে ভারতের করা পরমাণু বিস্ফোরণের নিন্দাও করেছিলেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সাম্প্রতিক সমস্যা নিয়ে বারবার সোচ্চার হয়েছেন তার মধ্যে ২০০১ সালের পার্লামেন্ট আক্রমণ থেকে শুরু করে ২০০৮ সালে জঙ্গিদের দ্বারা মুম্বাই আক্রমণ, কেরালার মুথাঙ্গার ঘটনা, শ্রীলঙ্কা সরকারের সমালোচনা করা, সমাজকর্মী আন্না হাজারের সমালোচনা করা, নরেন্দ্র মোদীর দ্বারা চালিত বিজেপি সরকারের কঠোর সমালোচনা করা, বিজেপি সরকারের দ্বারা আনিত এনআরসি (National Register of Citizens) এবং এনপিআর (National Population Register, NPR) এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা সবই রয়েছে।

তিনি সারাজীবনে বেশকিছু পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন। বুকার প্রাইজ এবং জাতীয় পুরস্কার ছাড়াও তিনি ২০০২ সালে লান্নান সংস্থার দ্বারা প্রদত্ত সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা সম্মান (Cultural Freedom Award) লাভ করেন। ২০০৩ সালে সানফ্রান্সিসকোতে তাঁকে গ্লোবাল এক্সচেঞ্জ হিউম্যান রাইটস অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। ২০০৪ সালের মে মাসে তিনি সিডনি শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৬ সালে তাঁর প্রবন্ধের বই ‘দ্য অ্যালজেবরা অফ ইনফাইনাইট জাস্টিস’ (The Algebra of Infinite Justice) এর জন্য সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার প্রাপক হিসেবে তাঁর নাম মনোনীত করা হয়। কিন্তু তিনি সেই পুরস্কার গ্রহণ করেননি। এছাড়া ২০১৫ সালে তিনি জাতীয় পুরস্কার ফিরিয়ে দেন ভারতে হওয়ার ধর্মীয় হিংসার প্রতিবাদে। ২০১১সালের নভেম্বরে তাকে নরম্যান মেইলার পুরস্কার (Norman Mailer Prize) প্রদান করা হয়।

পৃথিবীর ১০০ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মধ্যে তাঁকে অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়।

আপনার মতামত জানান