উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের এক অন্যতম পথিকৃৎ হলেন ডিরোজিও (Derozio)। ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। মাত্র ২১ বছর বয়সে হিন্দু কলেজে ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন ডিরোজিও। তবে তাঁর পাঠদান কেবলমাত্র শ্রেণিকক্ষের গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না, তাঁর ছাত্রদের মধ্যে তিনি ইউরোপীয় নবজাগরণের যুক্তিবাদের ধারণা প্রোথিত করেছিলেন। উনিশ শতকের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাঙালি সমাজে যেন এক দমকা হাওয়ার ঝড়ের মত তাঁর আবির্ভাব। একাধারে কবি, সাংবাদিক এবং শিক্ষক ছিলেন তিনি। তাঁর সম্পাদনাতেই ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলের অন্যতম মুখপত্র হিসেবে ‘পার্থেনন’ পত্রিকা প্রকাশিত হত। ১৮২৮ সালে ডিরোজিও গড়ে তুলেছিলেন ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’। তাঁর প্রত্যক্ষ ছাত্র-শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ী, দিগম্বর মিত্র প্রমুখ।
১৮০৯ সালে ১৮ এপ্রিল কলকাতার মৌলালিতে এক ইউরেশীয় পরিবারে ডিরোজিওর জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম ছিল হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। তাঁর বাবা ফ্রান্সিস ডিরোজিও বিখ্যাত ‘জে স্কট এন্ড কোম্পানি’তে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করতেন এবং তাঁর মা সোফিয়া ছিলেন গৃহিণী। মাত্র ছয় বছর বয়সে মা’কে হারান ডিরোজিও। ডিরোজিওর পূর্বপুরুষরা সুদূর পর্তুগাল থেকে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। সেই সময় এরকম আরও অনেক ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত মানুষ ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন যাদের ফিরিঙ্গি বলা হত। ডিরোজিওর বাবা ছিলেন ফিরিঙ্গি সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। ছোটবেলা থেকেই পোশাক-আশাকের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন ডিরোজিও, সচরাচর টুপি পড়তে দেখা যেত না তাঁকে। ঘোড়ায় চড়তে খুবই ভালবাসতেন তিনি।
ডিরোজিওর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ছয় বছর বয়সে ডেভিড ড্রামন্ডের ধর্মতলা অ্যাকাডেমি স্কুলে। ১৮১৫ থেকে ১৮২৩ সাল পর্যন্ত আট বছর ডিরোজিও পড়াশোনা করেছিলেন ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে। এখানেই তাঁর জীবনের আদর্শ গড়ে উঠেছিল। ড্রামন্ডের থেকে তিনি শিখেছিলেন কীভাবে সত্যকে অর্জন করতে হয়, কীভাবে তর্কের মাধ্যমে সত্যকে স্থাপন করতে হয়, জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে কীভাবে মানুষকে ভালবাসতে হয়। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, ভাষা-সংস্কৃতি সব কিছুর জন্য একটা আবেদন সৃষ্টি হয়েছিল ডিরোজিও’র মধ্যে এই সময়ে। হিউম, স্মিথ, রবার্টসন, স্টুয়ার্ট প্রভৃতির দর্শন ডিরোজিওকে আকৃষ্ট করে। ডেভিড ড্রামন্ড কেবল সুপরিচিত এক কবি ও শিক্ষক ছিলেন না, তিনি দার্শনিকও ছিলেন। একজন মুক্ত চিন্তার মানুষ বলতে যা বোঝায় ড্রামন্ড ছিলেন তাই। ডিরোজিও তাঁর বাবা ও শিক্ষক ড্রামন্ডের প্রগতিশীল চিন্তাধারায় ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হন।
ডিরোজিওর যখন চোদ্দ বছর বয়স তখন তাঁর বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর তিনি তাঁর বাবার অফিসে কেরানির চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু পরে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভাগলপুরের মাসির বাড়ি চলে যান। তাঁর মেসোমশাই আর্থার জনসন ছিলেন ভাগলপুরে নীলকুঠির মালিক। এই ব্যবসার কাজে কিছু সাহায্য করা ছাড়া অবসর সময়ে তিনি কবিতা লিখতেন ও বিভিন্ন বই পড়তেন। এই সময় ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ নামে একটি খবরের কাগজে কবিতা পাঠাতে শুরু করেন তিনি এবং তাঁর কবিতা নিয়মিত প্রকাশও পেতে থাকে সেখানে। ডিরোজিও ‘জুভেনিস’ ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। ইংরেজদের কাছে তাঁর কবিতা যথেষ্ট প্রশংসা লাভ করে। এই সময়ে তিনি বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের ‘লেকচার অন ফিলোসফিক্যাল থিওলজি’ (Lectures on philosophical theology) বইটির সমালোচনা লিখে ফেলেন। ১৮২৬ সালে কবিতার বই ছাপানোর কাজে ডিরোজিও কলকাতায় আসেন। এই সময়ে তিনি সুবিখ্যাত হিন্দু কলেজ থেকে শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রস্তাব পান এবং একইসঙ্গে ইন্ডিয়ান গেজেটের সহ-সম্পাদকের কাজের জন্য সুযোগ পান। তিনি হিন্দু কলেজের শিক্ষক হিসেবে মাত্র সতের বছর বয়সে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের কনিষ্ঠতম শিক্ষক। তাঁর পড়ানোর পদ্ধতি ছিল গতানুগতিক ধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পড়ানোর এই প্রথাবিরোধী আকর্ষণীয় পদ্ধতি ক্রমেই শিক্ষক হিসেবে তাঁকে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তোলে। তাঁর শিক্ষাদানের স্থান কেবলমাত্র কলেজেই সীমাবদ্ধ ছিল না, নিজের বাড়িতে কিংবা কলেজ চত্বরেও তিনি ছাত্রদের সঙ্গে নানান বিষয়ে আলোচনা করতেন। এই ছাত্রদের অনেকেই তাঁর সমবয়সী কিংবা কেউ কেউ তাঁর থেকে বয়সে বড়ও ছিল। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, মাধব চন্দ্র মল্লিক, রামতনু লাহিড়ী, প্যারীচাঁদ মিত্র, অমৃতলাল মিত্র, রাধানাথ শিকদার প্রমুখ যাঁরা পরবর্তীকালে বাংলায় মুক্তচিন্তা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের তৎকালীন হিন্দু সমাজের নানান কুসংস্কার ও চিন্তার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন ।
১৮২৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দুটি কবিতার বই ‘দ্য ফকির অফ জঙ্ঘীরা’ (The Fakeer of Jungheera) এবং ‘টু ইন্ডিয়া- মাই নেটিভ ল্যান্ড’ (To India – My Native Land)। ‘দ্য ফকির অব জঙ্ঘীরা’ হল ডিরোজিওর লেখা শ্রেষ্ঠ কবিতা। গভীর জীবনবোধ সম্পন্ন এই কবিতা ডিরোজিওকে সাহিত্য মহলে আরও পরিচিত করে তোলে। এই কবিতায় একজন পরিণত কবি হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন।
ডিরোজিও তাঁর শিষ্যদের নিয়ে ১৮২৮ সালে গড়ে তোলেন ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন তিনি নিজেই। এই সংগঠনের মুখপত্র হিসেবে তিনি ‘পার্থেনন’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন যা তৎকালীন হিন্দু সমাজের বিরোধিতায় অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আরও দুটো পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি প্রবল বিরোধিতার চাপে। পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করলেও আলোচনাসভা বন্ধ করেননি তিনি। এই সংগঠনের সভায় প্রচুর জনসমাগম হতে শুরু করে। এই সময়ে এরকম আরও কিছু সংগঠনের জন্ম হয় এবং প্রত্যেকটিতেই ডিরোজিও সদস্যপদ গ্রহণ করেন। ডিরোজিও’র দলের সুনাম এবং দুর্নাম দুইই হতে থাকে ।এই দলের নাম হয়ে ওঠে ‘ইয়ংবেঙ্গল’ বা ‘নব্য বঙ্গ’। প্রাচীন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের সঙ্গে ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যদের তুমুল বিরোধ বাধে। ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যদের অনেকেরই ব্যক্তিগত জীবনে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে স্থায়ী বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ জানায়। রাজা রাধাকান্ত দেব, চন্দ্রকুমার ঠাকু্র প্রমুখ রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের মুখ্য ব্যক্তিরা তাঁর বরখাস্তের দাবি জানান। অবশেষে ১৮৩১ সালের ২৫ এপ্রিল ডিরোজিও কলেজ কর্তৃপক্ষের হাতে তাঁর পদত্যাগ পত্র পৌঁছে দেন। রক্ষণশীল সমাজ এতে আরও মুশকিলে পড়ে। প্রিয় শিক্ষককে কলেজ থেকে তাড়ানোর ঘটনা ছাত্ররা মেনে নিতে পারেনি। ফলে তাঁদের চিন্তা এবং কার্যকলাপ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এই মতাদর্শের ঢেউ শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও পৌঁছে যায়। ডিরোজিওর সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হতে থাকে।
ডিরোজিও এই সময় ‘দি ইস্ট ইন্ডিয়ান’ নামে একটি ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্র সম্পাদনা করতে শুরু করেন। এই পত্রিকায় তাঁর শিষ্যরা সাংবাদিক হিসেবে তাঁদের বিভিন্ন প্রগতিবাদী ধারণাগুলি প্রচার করতে থাকে। ১৮৩১ সালের মে মাসে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দি এনকোয়ারার’ নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। এর পরের মাসে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও রসিককৃষ্ণ মল্লিক ‘জ্ঞানান্বেষণ’ নামে একটি বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ করতে শুরু করেন। ডিরোজিওর নির্দেশনায় এসব পত্রিকার মাধ্যমে ইয়ংবেঙ্গল সদস্যরা হিন্দু রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালায়। ১৮৪৪ সাল পর্যন্ত ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল। ইয়ংবেঙ্গল কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকাগুলির মধ্যে সম্ভবত ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ ছিল শেষ প্রকাশিত পত্রিকা। ১৮৪২ সাল থেকে প্রকাশিত হয় এই প্রতিবাদী মাসিক পত্রিকাটি। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা ছাড়াও নারীশিক্ষা ও হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ সংক্রান্ত আলোচনা স্থান পায় এই পত্রিকাতে। প্রথম বাংলা উপন্যাসের খসড়া ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল এই পত্রিকাতেই। উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণে ইয়ং বেঙ্গল এবং ডিরোজিওর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। এদেশে পাশ্চাত্য চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রচলনের পেছনে ইয়ংবেঙ্গল সরাসরি জড়িত ছিল। গণ পাঠাগার স্থাপনের বিষয়টিরও উদ্যোক্তা ছিলেন ডিরোজিও এবং তাঁর শিষ্যরা।পরবর্তীকালে ডিরোজিওর অনুগামীরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ডিরোজিও’র ভাবধারায় অনুপ্রাণিত তাঁর শিষ্যরা ‘ডিরোজিয়ান’ নামে খ্যাত ছিল।
কলেজ ছাড়ার পর ডিরোজিও ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে পড়াতে শুরু করেন। এই সময় তিনি কলেরায় আক্রান্ত হন। সে যুগে কলেরা’র কোনও চিকিৎসা ছিল না, এদিকে অর্থকষ্টেও ভুগছিলেন তিনি। তাই তাঁর চিকিৎসার ভার নেন তাঁর প্রিয় শিষ্যরা।
অবশেষে ১৮৩১ সালের ২৬ ডিসেম্বর মাত্র ২২ বছর বয়সে কলেরায় ডিরোজিও’র মৃত্যু হয় ।
2 comments