ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু

ঘটোৎকচ

মহাভারতের আদিপর্বে ৫৫তম অধ্যায়ে সর্বপ্রথম ঘটোৎকচ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন পান্ডুপুত্র ভীম এবং রাক্ষসী হিড়িম্বার সন্তান।

জতুগৃহ থেকে লুকিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর পাঁচ জন পান্ডব তাঁদের মা কুন্তীকে নিয়ে এক ঘন বনের মধ্যে এসে পড়েন। সেই বনে হিড়িম্ব নামে এক রাক্ষস তার বোন হিড়িম্বাকে নিয়ে বাস করত। পান্ডবদের হত্যা করে তাঁদের মাংস খাওয়ার লোভে হিড়িম্ব তাঁদের আক্রমণ করে এবং ভীমের সঙ্গে তার ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হয়।

কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর ভীমের হাতে হিড়িম্বের মৃত্যু হয়। ভীম তখন হিড়িম্বাকে দেখে তাকেও হত্যা করতে উদ্যত হলে হিড়িম্বা কুন্তী দেবীকে বললেন, “মা! আমাকে বাঁচান। আমার কোনো দোষ নেই। আমি আপনার এই ছেলেটিকে ভালোবেসে ফেলেছি আর আমি আশা করেছিলাম যে তিনি আমাকে বিয়ে করবেন।” এই বলে হিড়িম্বা কাঁদতে লাগলেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

একথা শুনে কুন্তী দেবীর মনে দয়া হয় এবং তিনি ও যুধিষ্ঠির হিড়িম্বাকে বিয়ে করার জন্য ভীমকে অনুরোধ করেন। দাদা ও মায়ের অনুরোধ ফেলতে না পেরে ভীম হিড়িম্বাকে বিয়ে করলেন। বিয়ের পর কয়েকদিন ভীম ও হিড়িম্বা একসঙ্গে বিভিন্ন সুন্দর জায়গায় বিহার করতে লাগলেন। এইভাবে কিছুদিন কাটার পর হিড়িম্বা গর্ভবতী হলেন। রাক্ষসীরা গর্ভবতী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সন্তান প্রসব করে। হিড়িম্বাও গর্ভধারণের সঙ্গে সঙ্গে এক মহাবলশালী পুত্রসন্তান প্রসব করলেন। তার মুখ আকারে বিশাল, কানগুলি গাধার কানের মত বড়, ঠোঁট তাম্রবর্ণ, দাঁতগুলি ধারালো, নাক লম্বা এবং বুক খুব চওড়া। শিশুটি জন্ম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যৌবনপ্রাপ্ত ও সর্ব শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে মা-বাবাকে প্রণাম করে তাঁদের পায়ের ধুলো মাথায় নিল। তার মাথা হাতির শুঁড়ের মত চকচকে ও কেশহীন ছিল বলে ভীম তার নাম রাখলেন ‘ঘটোৎকচ’ (‘ঘট’ অর্থে হাতির শুঁড় ও ‘উৎকোচ’ অর্থে কেশহীন)। ঘটোৎকচ বাবা-মায়ের সঙ্গে পান্ডবদের কাছে এসে কুন্তী দেবী ও বাকি চারজন পান্ডবকে প্রণাম করে হাতজোড় করে বললেন, “আপনারা যখন আমাকে ডাকবেন, আমি তখনই আপনাদের সেবা করার জন্য চলে আসব।” এই বলে ঘটোৎকচ তাঁর মা হিড়িম্বার সঙ্গে উত্তরদিকে চলে গেলেন।

এরপর আবার ঘটোৎকচকে দেখতে পাওয়া যায় বনপর্বের ১৪৪তম অধ্যায়ে। অর্জুন যখন দেবতাদের শত্রু ‘নিবাত কবচ’ নামের দানবদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য দেবরাজ ইন্দ্রের আমন্ত্রণে স্বর্গে যান, পান্ডবরা তখন কাম্যক বনে বাস করছিলেন। বেশ কিছুদিন পর স্বর্গ থেকে অর্জুনের খবর নিয়ে লোমশ মুনি পান্ডবদের কাছে আসেন। অর্জুনের কথা মত পান্ডবরা মুনির সঙ্গে বিভিন্ন তীর্থ দেখার জন্য বার হলেন।

ভারতের প্রায় সবকটি তীর্থ দেখা হয়ে যাওয়ার পর পান্ডবরা এসে পৌঁছালেন কৈলাস পর্বতের কাছে গন্ধমাদন পর্বতে। সেই জায়গা ছিল ভীষণ ভয়ানক। কারণ পাহাড়ের উপর দিয়ে চলা খুব কঠিন, আর তা ছাড়া অনেক ভয়ঙ্কর রাক্ষস ও দানবেরা সেই জায়গা দিয়ে চলাফেরা করে। লোমশ মুনির সঙ্গে পান্ডবরা খুব সাবধানে সেই পর্বতের উপর উঠলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ভয়ানক ঝড় উঠল। হাওয়ার বেগ সহ্য করতে না পেরে পান্ডবরা কেউ পর্বতের গুহায় ঢুকে পড়লেন, কেউ বা উইঢিপি আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করতে লাগলেন। ভীম দ্রৌপদীর হাত ধরে একটি গাছকে জড়িয়ে ধরে কোনোমতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর ঝড় থেমে গেল। কিন্তু পথের এত পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে দ্রৌপদী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। তাঁর আর নিজের পায়ে চলার ক্ষমতা রইল না। পান্ডবরা পড়লেন মহা বিপদে। নকুল ও সহদেব দ্রৌপদীর মুখে জলের ছিটে দিতে লাগলেন এবং যুধিষ্ঠির গাছের পাতা দিয়ে তাঁকে হাওয়া করতে লাগলেন। ভীম ও অর্জুন দ্রৌপদীর হাত ও পা ঘষে ঘষে তাঁর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। একটু পর জ্ঞান ফিরে এলেও তাঁর পায়ে হেঁটে যাওয়ার ক্ষমতা ফিরে এলো না। ইন্দ্রপ্রস্থের সম্রাজ্ঞী দ্রৌপদীকে রাস্তার ধুলোয় পড়ে থাকতে দেখে মনের দুঃখে যুধিষ্ঠির কাঁদতে লাগলেন। ভীম তখন যুধিষ্ঠিরকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “দাদা! আমি একাই আপনাদের সবাইকে ও দ্রৌপদীকে বয়ে নিয়ে যেতে পারব। আপনি চিন্তা করবেন না। অথবা আপনি যদি অনুমতি করেন তবে আমি ঘটোৎকচকে ডাকি। সে আমাদের এই জায়গা থেকে নিয়ে যাবে।”

যুধিষ্ঠির সম্মতি দিলে ভীম ঘটোৎকচকে স্মরণ করলেন। মুহূর্তের মধ্যেই ঘটোৎকচ হাজার হাজার রাক্ষসকে সঙ্গে নিয়ে সেই জায়গায় এসে উপস্থিত হলেন। তিনি ভীমকে ও বাকি পান্ডবদের প্রণাম করে বললেন, “বাবা! আমাকে কেন ডেকেছেন? আমাকে এখন কী করতে হবে আদেশ করুন!” ভীম ঘটোৎকচকে আলিঙ্গন করে বললেন, “বাছা! তোমার মা পথের পরিশ্রমে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি হাঁটতে পারছেন না। তুমি তাঁকে বয়ে নিয়ে চল। এতে তোমার মঙ্গল হবে।” ঘটোৎকচ তখনই দ্রৌপদীকে প্রণাম করে তাঁকে কাঁধে তুলে নিলেন। তাঁর সঙ্গের বাকি রাক্ষসেরা পান্ডবদের কাঁধে নিল। রাক্ষসেরা পান্ডবদের অনেক দুর্গম ও ভয়ানক জায়গা পার করে ‘বদরিকাশ্রম’ নামে তীর্থে পৌঁছিয়ে দিল। ঘটোৎকচ হাতজোড় করে বিদায় চাইলে পান্ডবরাও অনেক আশীর্বাদ করে তাঁকে বিদায় দিলেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ঘটোৎকচ অসাধারণ বীরত্ব দেখিয়েছিলেন। তাঁর হাতে কৌরবপক্ষের অলায়ুধ, অলম্বল প্রভৃতি অনেক রাক্ষস এবং বহু সৈন্য মারা যায়। চৌদ্দতম দিনের রাত্রিতে কর্ণ ভয়ানক যুদ্ধ শুরু করায় তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে শ্রীকৃষ্ণ ঘটোৎকচকে পাঠালেন। কর্ণ ও ঘটোৎকচের মধ্যে তখন ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হল। দুই জনেই একে অপরের দিকে ভয়ানক অস্ত্র ছুঁড়তে শুরু করলেন। দেখতে দেখতে দুজনের শরীরই রক্তে লাল হয়ে গেল, তাঁদের কাঁসার বর্ম ভেঙে গেল। কর্ণ ঘটোৎকচের ঘোড়াগুলিকে মেরে তাঁর রথ ভেঙে দিলে ঘটোৎকচ মায়া প্রয়োগ করে তালগাছের মত লম্বা ভীষণ চেহারা ধারণ করলেন। কর্ণ তাই দেখে একের পর এক বাণ মারতে লাগলেন আর ঘটোৎকচ হাঁ করে সব অস্ত্র গিলে নিতে লাগলেন। হঠাৎ তিনি বুড়ো আঙুলের মতো ছোট হয়ে যেতে লাগলেন, আবার হঠাৎ করে পর্বতের মত বিশাল রূপে কর্ণের সামনে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর মায়ায় আকাশের মেঘ থেকে ক্রমাগত বাজ, উল্কা, শক্তি, প্রাস, মুষল, কুড়াল, তোমর, খড়্গ, পট্টিশ, পরিঘ, গদা, শূল, পাথর প্রভৃতি কৌরবসৈন্যদের উপর পড়তে লাগল। কর্ণের তখন আর ঘটোৎকচকে থামানোর শক্তি রইল না। এর মধ্যে ঘটোৎকচ শতঘ্নী মেরে কর্ণের রথের ঘোড়াগুলিকে মেরে ফেলল।

প্রাণের ভয়ে কৌরবরা তখন ইন্দ্রের দেওয়া ‘এক-পুরুষ-ঘাতিনী’ শক্তি দিয়ে ঘটোৎকচকে বধ করার জন্য কর্ণকে বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন। এই শক্তি দিয়ে কেবল একটি পুরুষকেই বধ করা যায়, কর্ণ অর্জুনকে হত্যা করার জন্য এই শক্তি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটোৎকচকে হারানোর আর অন্য কোনো উপায় দেখতে না পেয়ে বাধ্য হয়ে কর্ণ মন্ত্র পড়ে সেই শক্তিকে ডাকলেন।

কর্ণের ডাকে সেই ভয়ানক শক্তি তখনই এসে উপস্থিত হল। ঘটোৎকচ তা দেখে পর্বতের মতো বিশাল শরীর ধারণ করে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে লাগল। কিন্তু সেই শক্তি জ্বলন্ত উল্কার মত এক নিমেষে ঘটোৎকচের বুক ফুঁড়ে আকাশের দিকে চলে গেল। প্রাণহীন ঘটোৎকচের দেহে মাটিতে পড়বার সময় তাঁর বিশাল দেহের চাপে কৌরবপক্ষের এক অক্ষৌহিণী সৈন্য মারা যায়।

ঘটোৎকচের মৃত্যুতে পান্ডবরা ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণ সিংহনাদ করে রথের উপরেই নাচতে শুরু করায় অর্জুন বিরক্ত হয়ে এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় কৃষ্ণ বলেছিলেন, “কর্ণ এই এক-পুরুষ-ঘাতিনী শক্তি তোমাকে হত্যা করবার জন্য রেখে দিয়েছিল। তাই আমি কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ঘটোৎকচকে পাঠিয়েছিলাম। ঘটোৎকচকে হত্যা করে ওই শক্তি ইন্দ্রের কাছে ফিরে গেছে। এখন আর কর্ণকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এবার তোমার হাতেই কর্ণের মৃত্যু হবে।”

তথ্যসূত্র


  1. ‘মহাভারত’,কালীপ্রসন্ন সিংহ, আদিপর্ব, অধ্যায় ১৫৫, পৃষ্ঠা ২১৪-২১৫ বনপর্ব, অধ্যায় ১৪৪, পৃষ্ঠা ৫৯০০-৫৯২
  2. ‘ছেলেদের মহাভারত’, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় মুদ্রণ, দ্রোণপর্ব, পৃষ্ঠা ১৬০-১৬২, বনপর্ব, পৃষ্ঠা ৮২-৮৩, আদিপর্ব, পৃষ্ঠা ৩৩-৩৫

আপনার মতামত জানান