অগ্নিযুগের বাংলায় দিকে দিকে সশস্ত্র গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির উত্থান ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। একদিকে নাগাড়ে বোমা বিস্ফোরণের জোয়ার দেখা দিয়েছিল আর অন্যদিকে চলছিল ব্রিটিশ নিধন যজ্ঞ। আলিপুর বোমা মামলা, মুজফ্ফরপুর বোমা মামলা কিংবা দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলা ভারতের বিপ্লববাদের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই বিরাট বিক্ষুব্ধ ইতিহাসের সবথেকে কম আলোচিত অধ্যায় হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলা (Howrah-Shibpur Conspiracy Case)। কলকাতা শহরের বেশ কিছু গুপ্ত আখড়ায় বোমা তৈরি করতেন বিপ্লবীরা আর সেই বোমা সমগ্র বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো একাধারে। অকুতোভয় বিপ্লবীদের থেকে বোমা বানানোর কৌশল শিখতে আসছিলেন অনেকে। ফলে সব মিলিয়ে পুরো বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল বোমা কারখানা। বাংলার গুপ্ত সমিতিগুলির মধ্যে অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর দল প্রভৃতি বিপুলভাবে গেরিলা আক্রমণে ব্রিটিশদের কোণঠাসা করে ফেলছিল ক্রমশ। বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে চলছিল একের পর এক রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা, বিচারে কারো ফাঁসি বা কারো কালাপানি পেরিয়ে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা। হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলাটিও এই ধারার ব্যতিক্রম নয়।
১৯১০ সালের ১০ জানুয়ারি কলকাতা উচ্চ আদালতে হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলার বিচারপর্ব শুরু হয়। মোট ৪৭ জন ভারতীয় বিপ্লবীর বিরুদ্ধে রুজু হওয়ার এই মামলার অন্তিম রায় ঘোষিত হয়েছিল ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। অভিযুক্ত বিপ্লবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘা যতীন, বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রমুখ।
এই মামলার পটভূমি শুরু হয়েছিল আলিপুর বোমা মামলার সময়কাল থেকে। আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা কলকাতা উচ্চ আদালতে রুজু হয় ১৯০৮ সালের ১৭ মে তারিখে এবং এই মামলার বিচারে অভিযুক্ত অরবিন্দ ঘোষ আর নগেন্দ্রনাথ গুপ্তকে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয় এবং বারীন ঘোষ আর উল্লাসকর দত্তের ফাঁসির প্রাথমিক আদেশ মকুব করে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়। এই সময়েই জেলের মধ্যে রাজসাক্ষী নরেন গোস্বামীকে গুলি করে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত এবং সত্যেন বসু। নরেন গোঁসাই গুরুতরভাবে আহত হয়ে পালিয়ে গেলেও, জেলের রক্ষীদের হাতে ধরা পড়েন কানাইলাল এবং সত্যেন বসু। বিচারে তাঁদের ফাঁসি হয়েছিল। এই মামলার ফলে বাংলার বুকে যুগান্তর দল এবং অনুশীলন সমিতির কার্যকলাপ ও বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে প্রচুর তথ্য প্রকাশ্যে চলে আসে। ফলে ব্রিটিশ পুলিশ সচকিত হয়ে যায় এবং ময়না তদন্ত করা শুরু করে। এই সময়েই রাজসাক্ষী নরেন গোঁসাই হত্যা, কলকাতা উচ্চ আদালতের উকিল আশুতোষ বিশ্বাস হত্যার তদন্ত করছিলেন বেঙ্গল পুলিশের ডেপুটি সুপারিনটেণ্ডেন্ট ইন্সপেক্টর শামসুল আলম। এছাড়াও ক্ষুদিরাম বসুকে গ্রেপ্তার করেছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর নন্দলাল ব্যানার্জী, বিপ্লবীরা তাঁকেও গোপনে হত্যা করলে শামসুল আলমের উপরেই এই তদন্তের ভার অর্পিত হয়। আসলে আলিপুর বোমার মামলার সঙ্গে জড়িত এই দুই জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হত্যা করা বিপ্লবীদের কাছে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। সার্পেন্টাইন লেনে বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র পাল গুলি করে হত্যা করেছিলেন নন্দলাল ব্যানার্জিকে আর চারুচন্দ্র বসু হত্যা করেছিলেন উকিল আশুতোষ বিশ্বাসকে। অনুশীলন সমিতি যে গোপনে ব্রিটিশ পুলিশের কর্মী ও অফিসারদের হত্যার পরিকল্পনা করেছিল এবং সমগ্র বাংলা জুড়ে সন্ত্রাসের কার্যকলাপ বিস্তৃত করে তুলেছিল সেই সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য তদন্তের মাধ্যমে প্রকাশ্যে আনতে থাকেন ইন্সপেক্টর শামসুল আলম। বাংলার বিপ্লবীরা তাঁকে নিয়ে বিদ্রুপাত্মক গান বাঁধেন। আলিপুর বোমার মামলার রায় ঘোষিত হলে বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘা যতীন অত্যাচারী শামসুল আলমকে হত্যার ভার অর্পণ করেছিলেন আরেক বিখ্যাত বিপ্লবী বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্তকে। ১৯১০ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রকাশ্য দিবালোকে কলকাতা উচ্চ আদালতের বারান্দায় একেবারে সামনে থেকে গুলি করে শামসুল আলমকে হত্যা করেন বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত। সেখানেই থামেন না তিনি, গুলি করতে করতে আদালত চত্বর থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও রিভলবারের গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় আদালতের রক্ষীদের কাছে ধরা পড়েন তিনি। তাঁকে জেরা করা শুরু করে পুলিশ, কিন্তু জেরায় প্রবল অত্যাচার সহ্য করেও কোনো তথ্য ফাঁস করেননি তিনি। ইন্সপেক্টর শামসুল আলমের এই হত্যার ঘটনা নিয়েই শুরু হয় হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলা। মামলার প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত।
মামলা চলাকালীন সময়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো উকিল নেননি বীরেন দত্তগুপ্ত। বিচারপতি লরেন্স জেকিন্স নিজের দায়িত্বে অপরাধীর হয়ে নিশীথ সেনকে উকিল হিসেবে নিযুক্ত করলেও বীরেন্দ্রনাথ দত্ত গুপ্ত তাঁকে একটি কথাও বলেননি। তাঁর আশঙ্কা ছিল এই উকিলের মাধ্যমে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সব তথ্য ব্রিটিশ সরকার সহজেই জেনে ফেলতে পারবে। মামলার বিচারে বাঘা যতীন সহ আরো ৪৬ জনকে অভিযুক্ত করা হলেও তাঁদের বিরুধদে প্রমাণ সংগ্রহ করা সহজসাধ্য ছিল না। এই সময় মামলার কিনারা করতে পুলিশ ও ব্রিটিশ সরকার একটি ষড়যন্ত্র করে। বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্তকে একটি কাগজ ধরিয়ে তার মাধ্যমে পুলিশ তাঁকে বলে যে, শামসুল আলমের হত্যা আসলে পুলিশেরই পূর্ব-পরিকল্পিত ছিল এবং শামসুল আলমকে বীরেন গুপ্ত হত্যাই করেননি। এর সঙ্গে তাঁকে এও বলা হয়, সতীশ সরকার নামে একজন বিপ্লবী শামসুল আলমকে হত্যা করেছেন। বিপ্লবীদের এক গোপন ইস্তাহারের মতো একটি নিবন্ধ ব্রিটিশ পুলিশ বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্তকে দেখায় যাতে লেখা ছিল বীরেন্দ্রনাথ ছিলেন পুলিশের চর। এই সমগ্র চক্রান্তের মধ্য দিয়ে কিছুতেই দেশবাসীর সঙ্গে মিথ্যাচার করতে চাননি বীরেন্দ্রনাথ। এদিকে অন্যান্য অভিযুক্তদের ১৯১০ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তার করে। অন্যান্য অভিযুক্তদের বিচার শুরু হয় ১৯১০ সালের ৪ মার্চ থেকে এবং বিচারের দ্বিতীয় পর্বের শুনানি ঘোষিত হয়েছিল জুলাই মাসে।
পুলিশ ইন্সপেক্টর শামসুল আলমকে হত্যার অপরাধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২১এ ধারা অনুযায়ী হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলায় আলিপুর প্রেসিডেন্সি জেলে বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্তের ফাঁসি হয় ১৯১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। তাঁর ফাঁসির আগের দিন বীরেন্দ্রনাথ নিজ মুখে স্বীকার করেন যে তিনিই শামসুল আলমকে হত্যা করেছেন। এই মামলায় অভিযুক্ত অন্যান্য বিপ্লবীদের বিচার শুরু হওয়ার আগেই তাঁর ফাঁসি হয়ে যাওয়ায় ব্রিটিশ সরকার অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করতে পারেনি। ফলে ৪৭ জন বন্দি বিপ্লবীর মধ্য থেকে ৩৩ জন বিপ্লবীকে ব্রিটিশ সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
One comment