কুমোরটুলির পুজো

কুমোরটুলীর পুজো

পুরনো কলকাতার বনেদি পুজো সবই হতো কোনো না কোনো জমিদারবাড়ির ঠাকুরদালানে। জাঁকজমকপূর্ণ বর্ণাঢ্য সেই সব পুজোয় বাবু জমিদারদের পারিবারিক রীতি-রেওয়াজের প্রাধান্যই থাকতো বেশি, সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার বিশেষ ছিল না। পুজোর নামগুলি খেয়াল করলেই তা বোঝা যায়! দত্তবাড়ির পুজো, লাহাদের পুজো, ছাতুবাবু-লাটুবাবুর পুজো সর্বত্রই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার দৃষ্টান্ত। কিন্তু এইসব ধাঁচা একেবারে ভেঙে প্রথম ‘বারোয়ারি’ পুজো শুরু হয় ভবানীপুরে বলরাম বসু ঘাট রোডে ১৯১০ সালে। সেই প্রথম বারোয়ারি পুজোর সূত্রপাত কলকাতায়, হুগলীর গুপ্তিপাড়ায় যদিও এর আগেই চালু হয়ে গেছে বারোয়ারি দুর্গাপুজো। তারপর চালু হল সার্বজনীন দুর্গাপুজো, জনসাধারণের মিলিত উদ্যোগে মা দুর্গা পূজিত হতে শুরু করলেন কলকাতায়। এমনই প্রাচীন কলকাতার প্রথম দিককার সার্বজনীন পুজোর নিদর্শন এই কুমোরটুলীর পুজো । এই পুজোতেই প্রথম দেবী প্রতিমা সাবেক একচালা থেকে পাঁচ চালা হয়। শুনলে আশ্চর্য হতে হয় এই কুমোরটুলীর দুর্গা পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নাম।

‘বারো ইয়ারি’ থেকে বারোয়ারি। বারো জন বন্ধু মিলে একটি পুজোর সব খরচ, দায়-দায়িত্ব সামলানোর রীতি চালু হয় প্রথম কলকাতায় ১৯১০ সালে। কিন্তু সেখানেই থেমে যায়নি যুগের বিবর্তন। একসময় যেখানে জমিদারবাড়ির পুজোয় ঢুকতে গেলে পেয়াদাদের চাবুকের বাড়ি খেতে হতো, সেখানে বিংশ শতাব্দীতে এসে সেই জনসাধারণই পুজোয় মুখ্য ভূমিকা পালন করতে শুরু করলো। বারোয়ারি পূজা থেকে হয়ে গেল সার্বজনীন পূজা। প্রত্যেকটি মানুষের সমান অবদানে পুজো হতে থাকলো। কুমোরটুলীর মৃৎশিল্পীরাও এই রীতিটিকে মেনে নিয়ে চালু করেছিলেন কুমোরটুলীর সার্বজনীন দুর্গাপুজো। একদিকে আহিরীটোলা আর অন্যদিকে শোভাবাজারের মাঝখানে এই কুমোরটুলীতেই সপ্তদশ শতকের শেষ দিক থেকে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা এসে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হলওয়েল সাহেব সে সময় কলকাতাকে নানা পেশার মানুষদের ভিত্তিতে সাজিয়ে তুলছিলেন। কলুটোলা, ছুতারপাড়া, আহিরীটোলা, কুমোরটুলী এ সবই ঐ সময় তৈরি হয়। দুর্গাপূজার মধ্যে প্রথমে বাগবাজার সার্বজনীনের পূজা শুরু হয়, তারপরেই শুরু হয় কুমোরটুলীর দুর্গাপূজা। এই পুজো নিয়ে কত জনশ্রুতি ছড়িয়ে আছে কলকাতার অলিতে-গলিতে। ১৯৩১ সালে প্রথম পথ চলা শুরু কুমোরটুলী সার্বজনীন দুর্গোৎসবের। এর আগে জমিদারবাড়িতে বা বারোয়ারি পুজোগুলিতে যেরকম একচালার সাবেক দেবী প্রতিমা নির্মিত হতো, এখানেও তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে এক্ষেত্রে কুমোরটুলী সার্বজনীনই প্রথম বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে, তাও নিছক পরিস্থিতির চাপে। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত এখানেও এক চালার দেবি প্রতিমাতেই পুজো করা হতো। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মৃৎশিল্পী গোপেশ্বর পাল এই কুমোরটুলীর প্রতিমা নির্মাণ করতেন। কিন্তু দুর্ঘটনাটা ঘটে যায় ১৯৩৮ সালে। ততদিনে সার্বজনীন পূজার আরেক চমক জুড়ে গিয়েছে। বাগবাজার সার্বজনীন পুজোর পাশাপাশি কুমোরটুলী সার্বজনীন পুজোতেও সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেছেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র স্বয়ং। ১৯৩৮ সালের পঞ্চমীর রাতে বিপজ্জনকভাবে আগুন লেগে গেল কুমোরটুলীর একচালা দেবী প্রতিমায়। মহা সমস্যায় পড়লেন সকলে। কীভাবে আবার দুর্গা প্রতিমা তৈরি করা সম্ভব? পরদিনই যে ষষ্ঠী, দেবীর বোধন। সাধারণত একচালার প্রতিমাতে চালা গড়ে মূর্তি তৈরি করতে দিন দুয়েক সময় লাগতো। কিন্তু সেই দুই দিন সময়ও যে হাতে নেই। অবশেষে মৃৎশিল্পী গোপেশ্বর পাল নেতাজীর শরণাপন্ন হলেন। এলগিন রোডের বাড়িতে আলোচনার মধ্যে নেতাজীই প্রথম বললেন একচালার বদলে আলাদা আলাদা মৃৎশিল্পী আলাদা আলাদা চালায় ভিন্ন ভিন্ন মূর্তি তৈরি করলে কম সময়ে কাজটা করে ফেলা সম্ভব। এই প্রথম আলাদা কাঠামোয় আলাদাভাবে গণেশ, সরস্বতী, লক্ষ্মী, কার্তিকের মূর্তি তৈরি করা হল। এক রাতের মধ্যে এভাবেই তৈরি হয়েছিল পাঁচ চালার দূর্গাপ্রতিমা। কিন্তু প্রতিমা নির্মাণ হয়ে গেলেও পণ্ডিতমহলে তো ছিছিকার পড়ে গেল। সচরাচর যে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তনই রক্ষণশীলরা মেনে নিতে পারেন না আর তাকে অতিক্রম করেই যুগে যুগে পরিবর্তন হয়েছে সমাজে। এখানেও হল তাই। নেতাজী নিজে যুক্তি দেন যে দেবী দুর্গার অসুরনিধনের যুদ্ধের সময় সন্তান-সন্ততিদের পাশে থাকাটা অযৌক্তিক। তাই আলাদা আলাদা চালায় আলাদা কাঠামোয় তাদের অবস্থানটিই যুক্তিযুক্ত। গোপেশ্বর পালের হাতে নেতাজীর অনুপ্রেরণায় সেই প্রথম কলকাতার সার্বজনীন পুজোয় পাঁচচালা প্রতিমার উদ্বোধন হয়। সেই থেকেই সারা কলকাতায় পাঁচচালার সার্বজনীন দেবী প্রতিমায় পুজোটাই চল হয়ে যায়। গোপেশ্বর পাল বহু বছর যাবৎ এই পুজোর প্রতিমা নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে রমেশচন্দ্র পাল এখানকার মূর্তি গড়েছেন। রমেশ পালের হাতে ঢাকা-বিক্রমপুরের আদলে মূর্তি গড়া হতো কুমোরটুলী সার্বজনীনে। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চার ভাই হরিবল্লভ, গোবিন্দ, নেপাল আর মোহন পালেরাও এখানে প্রতিমা নির্মাণে বিশেষ অবদান রেখেছেন। সার্বজনীন পুজো মানেই পাড়ায় পাড়ায় প্রতিযোগিতা ছিল তুঙ্গে, তাই কুমোরটুলীর দুর্গাপুজোতেও নিত্য-নতুন চমক দর্শকদের জন্য অপেক্ষা করে থাকতো। আজও এই রীতি অব্যাহত আছে। শোনা যায়, বাগবাজার সার্বজনীনের সঙ্গে প্রতিমা বিসর্জন নিয়ে প্রবল ঝামেলা হতো কুমোরটুলী সার্বজনীনের। একবার নাকি বাগবাজার সার্বজনীনের সঙ্গে সংঘাতে না যাবার কারণে প্রতিমা গঙ্গার ঘাটে ফেলে রেখেই চলে এসেছিলেন কুমোরটুলী সার্বজনীনের সদস্যরা। তবে একথার সত্যতা বিচার করা যায়নি। এরকম হাজারো জনশ্রুতি আর ইতিহাস নিয়ে আজও সমান ঐতিহ্য নিয়ে চলে আসছে কুমোরটুলী সার্বজনীনের দুর্গাপুজো। সাবেক সাজ গেছে, এসেছে নয়া রীতি ‘থিম’পুজো। আর তাতেও পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকে কুমোরটুলী সার্বজনীন।

আপনার মতামত জানান