এম.কে নারায়ণন

এম.কে নারায়ণন

ভারতীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাসে নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য একটি নাম মায়ানকোডু কেলাথ নারায়ণন (Mayankodu Kelath Narayanan)। তিনি মূলত এম.কে নারায়ণন নামেই বিশেষ পরিচিত। নারায়ণন একজন ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস অফিসার ছিলেন। ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা বিষয়ের বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবেও  দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। দীর্ঘদিন ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর প্রধান পরিচালকের পদ অলঙ্কৃত করেছেন নারায়ণন। পরবর্তীকালে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।  প্রশাসনিক কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের পদে আসীন হন নারায়ণন। তাঁর অসাধারণ প্রশাসনিক দক্ষতাকে সম্মান জানিয়ে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেছে।

১৯৩৪ সালের ১০ মার্চ ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের কেরালা রাজ্যের পলাক্কাড জেলার অন্তর্গত ওটাপালমে কেলাথ পরিবারে এম.কে নারায়ণনের জন্ম হয়।

এম.কে নারায়ণন প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন দিল্লি এবং সিমলায়। তারপর চলে আসেন মাদ্রাজে। সেখানে তিনি মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে নিজের বিদ্যালয় স্তরের পড়াশুনা সম্পন্ন করেন। এরপর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ভর্তি হন চেন্নাইয়ের লয়োলা কলেজে। সেই কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেন ও সর্বোচ্চ নম্বর সহ পাস করেন। 

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৫৫ সালে এম.কে নারায়ণন যোগ দেন ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে। প্রথমে তৎকালীন মাদ্রাজ রাজ্যের সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার হিসেবে অল্প কিছু সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। কাজের মধ্য দিয়ে নিজের অসাধারণ কর্মদক্ষতার পরিচয় দিতে শুরু করেন বারংবার। ফলে বছর চারেকের মধ্যেই ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোতে ডেপুটেশনে যাওয়ার সুযোগ পান নারায়ণন। এটি তাঁর কেরিয়ারের এক অন্যতম বাঁক। এরপর থেকে কর্মজীবনের অধিকাংশ সময়ই তিনি অতিবাহিত করেছিলেন ভারত সরকারের অধীনে, প্রধানত ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোয়। সেখানে অভ্যন্তরীণ এবং জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত নানা বিষয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর একজন তরুণ সহকারী পরিচালক হিসেবে নারায়ণন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদটির বিভাজনের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদটিকে দ্বিখন্ডিত করা উচিত নয়।

এম.কে নারায়ণন তাঁর সমগ্র কর্মজীবনে মোট দুইবার ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্রথমবার ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৯২ সালে অবসর নেওয়ার আগে ১৯৯১ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি৷ এছাড়াও গোয়েন্দা কমিটির যৌথ চেয়ারম্যান পদেও আসীন ছিলেন এম.কে নারায়ণন ।

১৯৯২ সাল থেকে পরবর্তী বারো বছর পুলিশ পরিষেবা থেকে দূরেই ছিলেন এম.কে নারায়ণন। এইসময় মাঝেমাঝে সংবাদপত্রে কয়েকটি কলাম লিখেছেন কেবল। ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের পরে গোয়েন্দা সংস্থার পুনর্গঠনের অন্যতম প্রধান স্থপতি ছিলেন তিনি। মাল্টি-এজেন্সি সেন্টার, আন্তঃরাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সহায়তা দল এবং গোয়েন্দা সমন্বয়কারী দলের ধারণার নেপথ্যে ছিলেন নারায়ণন। তিনি গোয়েন্দা সংস্থার সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং জাতীয় প্রযুক্তিগত গবেষণা সংস্থা তৈরির নেপথ্যেও তিনি তাঁর বিশেষ অবদান রেখেছিলেন।

১৯৯১ সালের প্রথমদিকে যখন চন্দ্রশেখর কংগ্রেসের সমর্থনে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন নারায়ণন শ্রীলঙ্কায় এলটিটিই-এর সঙ্গে ডিএমকের ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে কেন্দ্রকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এরপর কেন্দ্র করুণানিধির নেতৃত্বাধীন সরকারকে বরখাস্ত করলে তার কয়েক মাসের মধ্যেই সন্দেহভাজন এলটিটিই-এর সদস্যরা রাজীব গান্ধীকে হত্যা করে। এই আকস্মিক ঘটনা নারায়ণনকে হতবাক করে দিয়েছিল। রাজীব গান্ধী হত্যাকান্ডের কোনোরকম পূর্বাভাস নির্ধারণে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো ব্যর্থ হওয়ায় তাঁকে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হতে হয়। রাজীব গান্ধী হত্যার তদন্তকারী জৈন কমিশনের সামনে জবানবন্দিও দিয়েছিলেন নারায়ণন। ঠিক এর পরের বছরই অবসর গ্রহণ করেন তিনি।

কংগ্রেস সরকারে আসার পর এম.কে নারায়ণনকে পুনর্বহাল করা হয়। প্রথমে তাঁকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদের প্রস্তাব দেওয়া হয়।  কিন্তু অসুস্থ মায়ের দেখভালের দায়িত্বের কারণে তিনি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন৷ এরপর তিনি ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। 

প্রাথমিকভাবে ভারত-মার্কিন বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি সহ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সাথে নারায়ণনের অনেক নীতিগত বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল বলে জানা যায়। তিনি ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে কিউবার হাভানায় জারি করা মনমোহন-মুশারফ যৌথ বিবৃতিটির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। নারায়ণনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থাকাকালীনই ২০০৮ সালে ২৬/১১-এর মুম্বাই হামলা সংঘটিত হয়, যা ভারতের নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতারই এক স্মারক। এই ঘটনার পর নারায়ণন নিজের ব্যর্থতাকে একপ্রকার স্বীকার করে নিয়েই পদত্যাগ করবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁকে তাঁর পদে বহাল রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। নারায়ণন ২০০৮ সালের ইন্দো-মার্কিন বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তির আলোচনাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। এছাড়াও এই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে থাকাকালীন তিনি চিন-ভারত সম্পর্ক বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তথ্য অনুযায়ী জর্জ বুশ ভারত সফরে এসে নারায়ণনের জন্যই পারমানবিক চুক্তিতে রাজী হয়েছিলেন। 

নিরাপত্তার বিষয়টি  ছাড়াও শ্রীলঙ্কা সম্পর্কেও তিনি একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। ব্রাজিল, ফ্রান্স, জাপান, শ্রীলঙ্কা, জার্মানি, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বেশ কয়েকটি দেশের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা বিষয়ক ব্যাপারে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।

২০১০ সাল পর্যন্ত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন নারায়ণন। তারপর ২০১০ সালের ২৪ জানুয়ারি গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর জায়গায় পশ্চিমবঙ্গের উনবিংশতম রাজ্যপাল হিসেবে মনোনীত করা হয় তাঁকে। প্রায় চারবছর এই গুরুদায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছিলেন তিনি। তাঁর আমলেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে নারায়ণনের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল ভালো-মন্দ মেশানো। রাজ্য সরকারের  অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজের মূল্যবান মতামত প্রদান করেছিলেন তিনি। তাঁর রাজ্যপাল থাকাকালীন সময়ে সিবিআই, ভিভিআইপি হেলিকপ্টার চুক্তিতে ঘুষের অভিযোগের তদন্তের ক্ষেত্রে সাক্ষী হিসেবে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।  অবশেষে ২০১৪ সালের ৩০ জুন রাজ্যপালের দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এম.কে নারায়ণন। কেবল পশ্চিমবঙ্গই নয়, সিকিমেরও অন্তর্বর্তীকালীন রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। 

পুলিশ পরিষেবা থেকে যে বছর অবসর গ্রহণ করেন নারায়ণন, সেই বছরই, অর্থাৎ ১৯৯২ সালে ভারত সরকার চতুর্থ-সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’তে ভূষিত করেছিল তাঁকে। আবার ২০১১ সালে গুসি শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় নারায়ণনকে।

আপনার মতামত জানান