বাংলা গানের স্বর্ণযুগের এক অন্যতম বিখ্যাত শিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় (Pratima Bandopadhyay)। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের শিষ্য প্রকাশকালী ঘোষের কাছে তাঁর গানের হাতেখড়ি হয়। খুব ছোটোবেলা থেকেই রেকর্ড বেরোয় তাঁর গানের। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্ত, রাজেন সরকার, সুধীরলাল চক্রবর্তী, সলিল চৌধুরী প্রমুখ বিখ্যাত সব সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে গান গেয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের গানের ধারায় এক চিরস্মরণীয় আসন করে নিয়েছেন তিনি। অতুলপ্রসাদ, রামপ্রসাদ, নজরুল, লোকগীতি, রাগাশ্রয়ী কিংবা ভক্তিরসাত্মক গান সমস্ত ধারাতেই প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নিজস্বতার ছাপ রেখেছেন এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। তাঁর গাওয়া ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ’ কিংবা ‘একটা গান লিখো আমার জন্য’ ইত্যাদি গানগুলি আজও সঙ্গীতপ্রিয় বাঙালির কানে বাজে।
১৯৩৪ সালের ২১ ডিসেম্বর কলকাতার ভবানীপুরে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম প্রতিমা চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বাবা মণিভূষণ চট্টোপাধ্যায় কক্স অ্যাণ্ড কিংস নামের একটি প্রাইভেট কোম্পানির চাকুরিজীবি ছিলেন এবং তাঁর পাশাপাশি একজন সুগায়ক হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি ছিল। ওস্তাদ বদল খানের শিষ্য হিসেবে খুব ভালো ঠুংরি ও দাদরা গাইতে পারতেন মণিভূষণ এবং গানের সঙ্গে সঙ্গে ফুটবল খেলাতেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি থেকে তাঁর গানের রেকর্ডও বেরিয়েছিল বলে জানা যায়। তাঁর মায়ের নাম ছিল কমলা দেবী, তিনিও সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন এবং খুব ভালো কীর্তন গাইতে পারতেন। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের বিক্রমপুরের বাহেরক গ্রামে। তাঁর জন্মের আগেই বাংলাদেশ ছেড়ে তাঁর বাবা-মা কলকাতার টালিগঞ্জে এসে ওঠেন এবং কিছুদিনের মধ্যে ভবানীপুরের একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। সেখানেই প্রতিমার জন্ম এবং বড়ো হয়ে ওঠা। প্রতিমার শৈশবেই তাঁর বাবা মণিভূষণের মৃত্যু হয়। বাল্যকালে তাঁর ডাকনাম ছিল রুনি। বাবা মারা যাওয়ার পরে অনেক কষ্টে একটি হারমোনিয়াম কিনে কমলাদেবী তাঁর কন্যা প্রতিমাকে গান শিখতে উৎসাহিত করেছিলেন। পাঁচ বছর বয়সে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের শিষ্য প্রকাশকালী ঘোষালের কাছে গান শিখতে শুরু করেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কাছে প্রতিমা শেখেন কিছু ভজন, কিছু রাগাশ্রয়ী গান আর ষোলো মাত্রার মোট ছাব্বিশটি তান। সাত-আট বছর বয়সে বিক্রমপুরে দেশের বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় সুধীরলাল চক্রবর্তীর যিনি নিজের উদ্যোগে ঢাকা রেডিওর শিশু বিভাগে প্রতিমাকে গান গাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। আবার কলকাতায় গিরীন চক্রবর্তীর সৌজন্যেও কিশোরীবেলাতেই বিভিন্ন জায়গায় গান গাওয়ার সুযোগ হয়ে যায় প্রতিমার। ১৯৪৫ সালে মাত্র এগারো বছর বয়সে সুকৃতি সেনের কথা ও সুরে ‘কুমারী প্রতিমা চ্যাটার্জী’ নামে তাঁর প্রথম রেকর্ড প্রকাশ পায় যেখানে তাঁর গাওয়া ‘প্রিয় খুলে রেখো বাতায়ন’, ‘মালাখানি দিয়ে আমারে ভোলাতে চাও’ ইত্যাদি গানগুলি খুব জনপ্রিয় হয়। ১৯৪৭ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহ হয় প্রতিমার। সেই থেকে প্রতিমা চট্টোপাধ্যায় পরিচিত হন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে ভবানীপুরের ভাড়াবাড়ি থেকে তিনি চলে আসেন টালিগঞ্জের সাহানগরে। তাঁর একমাত্র কন্যার নাম রাইকিশোরী।
বিবাহের পরে দক্ষিণ কলকাতার মিলনচক্র ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে প্রতিমার গান শুনে বিখ্যাত সুরকার ও গায়ক সুধীরলাল চক্রবর্তী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় কে দিয়ে একটি ছবিতে গান গাওয়ান। ১৯৫১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সেই ছবির নাম ‘সুনন্দার বিয়ে’ এবং এই ছবিতে প্রতিমার গলায় শোনা গিয়েছিল প্রথম ‘উছল তটিনী আমি সুদূরের চাঁদ’ গানটি। ১৯৫৪ সালে ‘ঢুলি’ ছবিতে রাজেন সরকারের সুরে প্রতিমার গাওয়া সব গানই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আর ধীরে ধীরে নিজের সুরেলা কণ্ঠের জাদুতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যদের পাশে একই আসনে জায়গা করেন নেন তিনি। এই ছবিটিকে সেকালের মিউজিক্যাল হিট ছবি বলা যায় কারণ রাজেন সরকারের সুরে এই ছবির গানের হাজার হাজার রেকর্ড সেই সময় বিক্রি হয়েছিল। উত্তম-সুচিত্রা জুটির বিখ্যাত ‘শাপমোচন’ ছবিতে আরেকটি রাগাশ্রিত গান গেয়েছিলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ত্রিবেণী তীর্থ পথে কে গাহিল গান’। চলচ্চিত্র পরিচালক তপন সিন্হার পরিচালনায় ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছবিতে ওস্তাদ আমীর খানের সঙ্গে দ্বৈত কন্ঠে গান গাওয়ার সুযোগ পান প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ছবিতে রবীন্দ্রনাথের ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে’ গানের অনুকরণে নির্মিত ‘ক্যায়সে কাটে রজনী ইয়ে সজনী’ গানটিতে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় গলা মিলিয়েছিলেন ওস্তাদ আমীর খানের সঙ্গে। ১৯৫৪ সালে পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের পরিচালনা যদুভট্ট ছবিতে ‘বাবুল মোরা’ গানটি গেয়ে বিএফজে পুরস্কারে সমানিত হন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই গান এক চিরস্মরণীয় স্মৃতি গড়ে তুলেছিল আপামর বাঙালি দর্শক-শ্রোতার মনে। ১৯৬০ সালে ‘নতুন ফসল’ ছবিতে রাইচাঁদ বড়াল ও ওস্তাদ বিলায়েত খানের পরিচালনায় প্রতিমা গেয়েছিলেন ‘যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভেজাবো না’ গানটি। এবার পরপর চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার সুযোগ আসতে থাকে তাঁর জীবনে। তাঁর সুরেলা কণ্ঠের গায়কী বাঙালি দর্শক-শ্রোতার কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শোনা যায় টালিগঞ্জের সাহানগরের বাড়িতে নাকি দিন রাত রেওয়াজে ডুবে থাকতেন প্রতিমা। তবে শুধুই রাগাশ্রয়ী গান নয়, ভক্তিগীতির জগতেও তিনি ছিলেন অনন্য। তাছাড়া অতুলপ্রসাদ, নজরুল, রামপ্রসাদ, নোকগীতি গানের সমস্ত ধারাতে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের জাত চিনিয়েছেন সকল সঙ্গীতমোদী বাঙালিকে। ১৯৫৭ সালে ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’ ছবিতে রাইচাঁদ বড়ালের সুরে ‘মাধব বহুত মিনতি’ নামের একটি কীর্তন গান গেয়েছিলেন তিনি, তারপরে ১৯৬২ সালে ‘মায়ার সংসার’ ছবিতে রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘আমার প্রভাত মধুর হল’ গানটিও তাঁরই গাওয়া। ১৯৬৮ সালে বিখ্যাত ‘চৌরঙ্গী’ ছবিতে ‘এই কথাটি মনে রেখ’ এই রবীন্দ্রসঙ্গীতটি তাঁর কণ্ঠে যেন এক অন্য মাত্রা পেল। এর আগে ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ ছবিতে যদিও তিনি একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’। ‘ছুটি’ (১৯৬৭), ‘চৌরঙ্গী’ (১৯৬৮) এবং ‘পরিণীতা’ (১৯৬৯) ছবিতে গান গাওয়ার জন্য পরপর তিনবার বিএফজে পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। এইচএমভি সংস্থার বাঁধাধরা সঙ্গীতশিল্পীর মর্যাদা পেয়েছেন তিনি। আর এই সংস্থা থেকেই যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কবিতা অবলম্বনে বাংলাকাব্যসঙ্গীতের একটি রেকর্ডে প্রতিমাকে দিয়ে গান গাওয়ানোর পরিকল্পনা হয় আর এই রেকর্ডে সুধীন দাশগুপ্তের সুরে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে গাওয়া ‘বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ’ গানটি আজও সকলের হৃদয় নিঙড়ে এক যন্ত্রণাকে টেনে আনে।
বাংলা গানের আরেক দিকপাল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে বহু গান গেয়েছেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ব্যক্তিগত জীবনেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন প্রতিমার কাছে পিতৃতুল্য। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতে তিনিই কেবল বাঙালিদের মধ্যে সা থেকে সা পর্যন্ত বাঁশির সুরের মতো এক সুরে কণ্ঠ বিকৃত না করে বলতে পারতেন। সেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘সাহারা’ ছবিতে মীনাকুমারীর লিপে ‘তেরি ইয়াদ কে সাহারে কাটতে হ্যায় দিন’ গানটি গেয়েছিলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সংসার ফেলে বম্বে গিয়ে গান গাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি। তাই বম্বের চলচ্চিত্র জগতে তাঁর গানের জাদু সেভাবে ছড়াতে পারেনি। অনেক সঙ্গীত সমালোচক বলেছেন যে তাঁর কণ্ঠে সুর থাকলেও আবেগ কম। এমনকি এই মন্তব্য নিয়ে একটি কাহিনীও প্রচলিত ছিল। ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ ছবিতে পরিচালক দেবকী কুমার বসু প্রতিমাকে দিয়ে একটি শোকের গান, দরদের গান গাওয়াতে চেয়েছিলেন। নিমাই ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বিষ্ণুপ্রিয়ার কণ্ঠে থাকবে সেই গান। কিন্তু কিছুতেই প্রতিমার গান পছন্দ না হওয়ায় চড় মেরেছিলেন দেবকী কুমার বসু আর তখন কাঁদতে কাঁদতে সেই গান গেয়েছিলেন প্রতিমা যা ছবির মুহূর্তের সঙ্গে একেবারে মিলে গিয়েছিল। সাধারণত দেখা যেত গান গাওয়ার সময় তাঁর মুখে খুব একটা অভিব্যক্তি ফুটে উঠত না, তাঁর গায়নভঙ্গী ছিল সম্পূর্ণ নিস্পৃহ। ১৯৫৩ সালে ‘আমার সোনা চাঁদের কণা’ গানটি প্রণব রায়ের সুরে গেয়েছিলেন প্রতিমা, তারপর কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘুম আয়রে’ কবিতাতেও সুর দিয়ে প্রতিমা এমন ছেলে ভোলানো সুরে গেয়েছিলেন যা আজও বাঙালি শুনে বাৎসল্য অনুভব করে। সুধীন দাশগুপ্তের সুরে ‘সাতরঙা এক পাখি’ কিংবা ‘একটা গান লিখ আমার জন্য’ গান দুটি প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
সেভাবে জলসা বা ফাংশানে খুব একটা গাইতে দেখা যেত না তাঁকে। এমনিতে শান্ত-লাজুক স্বভাবের হলেও সঙ্গীত জগতের সকলের সঙ্গেই মেলামেশা করতেন। কোনোরকম তারকাসুলভ আচরণ তাঁর চরিত্রে কখনোই দেখা যায়নি। ১৯৮৬ সালে তাঁর স্বামী মারা যাবার পর থেকে মানসিকভাবে একটু দুর্বল হয়ে পড়েন প্রতিমা। তবু গানের চর্চা ছাড়েননি তিনি। মানসিক অসুস্থতাও খানিক বাসা বেঁধেছিল। ১৯৯৬ সালে কলকাতার রবীন্দ্র সদনে আয়োজিত এক সঙ্গীত উৎসবে নির্মলা মিশ্র তাঁকে জোর করে হাত ধরে মঞ্চে তুলতেই করতালিতে ফেটে পড়েছিল প্রেক্ষাগৃহ আর গান গাওয়া শুরু হতেই চিরকালীন সেই বাঁশির মত সুরেলা কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ করেছিলেন তিনি সকলকে।
২০০৪ সালের ২৯ জুলাই প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় এর মৃত্যু হয়।
One comment