রানি রাসমণি

রানি রাসমণি

আঠারো শতকের বাংলায় দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন রানি রাসমণি (Rani Rashmoni)। ব্যবসায়ী প্রীতরাম দাসের পুত্রবধূ হিসেবে তাঁর অবর্তমানে কলকাতা এবং হালিশহর উভয় জায়গাতেই দক্ষ হাতে ব্যবসার কাজ সামলেছেন তিনি। একইসঙ্গে প্রজাদের দুরবস্থার কথাও ভাবতেন রাসমণি। সেকালে তিনিই ছিলেন একমাত্র কঠোর চরিত্রের বাঙালি মহিলা যিনি ব্রিটিশ সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁর প্রতিবাদের ফলেই গঙ্গায় মাছ ধরার জন্য জেলেদের উপর থেকে অতিরিক্ত করের বোঝা মকুব হয় যে রীতি এখনও সমানভাবে চলছে। কৈবর্ত সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে কালীমন্দির স্থাপন করার উদ্যোগে সমাজের ব্রাহ্মণদের প্রবল প্রতিরোধ উপেক্ষা করে অবিচল রাসমণি দক্ষিণেশ্বর মন্দির স্থাপন করেছিলেন। মকিমপুরে নীলকরদের প্রবল অত্যাচার থেকে বাঁচাতে ব্রিটিশ সাহেবদের বিরুদ্ধে লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়ে নীলচাষ রদ করিয়েছিলেন তিনি। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁর জীবনকে দেবী কালীর কাছে সমর্পিত করে তোলে। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কালীর আরাধনায় রত ছিলেন লোকমাতা রানি রাসমণি।

১৭৯৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কলকাতার অদূরে হালিশহরের কাছে কোনা গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে রানি রাসমণির জন্ম হয়। তাঁর বাবা হরেকৃষ্ণ দাস ছিলেন পেশায় কৃষিজীবী এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল রামপ্রিয়া দাস। অত্যন্ত দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম হওয়ায় ছোটোবেলা থেকেই ঘর-গেরস্থালির সব রকম কাজই করতে হতো রাসমণিকে। বাল্যকালেই তাঁর মা তাঁকে ডাকনামে ‘রানি’ বলে ডাকতেন। কৃষিকাজে ব্যস্ত বাবাকে মাঠে গিয়ে খাবার দিয়ে আসতেন রাসমণি।

দরিদ্র পরিবারের মধ্যেও রাসমণির বাবা হরেকৃষ্ণ দাসের প্রবল আগ্রহে তাঁর কাছেই রাসমণির প্রাথমিক শিক্ষালাভ হয়। সন্ধ্যা হলেই বাড়িতে গীতাপাঠ, মহাভারত পাঠের আসর বসতো আর সেই আসরে হরেকৃষ্ণ দাস উপস্থিত থাকতেন মেয়ে রাসমনিকে নিয়ে। ফলে ছোটো থেকেই বহু পুরাণের গল্প তাঁর অধিগত হয়ে যায়। এমনকি এর মধ্যে দিয়ে রাসমণির মনে ধর্মভাবও ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। ১৮০৪ সাল নাগাদ ব্যবসার কাজের সূত্রে ত্রিবেণীর পথে নৌকাসফরে থাকাকালীন কলকাতার জানবাজারের জমিদারবাড়ির সন্তান রাজচন্দ্র দাস অপরূপ লাবণ্যময়ী রাসমণিকে দেখে প্রেমাসক্ত হন। জাতিতে শূদ্র কন্যা রাসমণিকে প্রগতিশীল রাজচন্দ্র বাড়ির সকলের অমতে বিবাহ করেন এবং মর্যাদার সঙ্গে কলকাতার জানবাজারের প্রাসাদে ঠাঁই দেন। সেসময় রাজচন্দ্র দাসের বয়স ছিল একুশ আর অন্যদিকে রাসমণি কৈশোরেই উত্তীর্ণ হননি, বিবাহকালে মাত্র এগারো বছর বয়স ছিল তাঁর। কিছুদিনের ব্যবধানে তাঁদের চার কন্যাসন্তান জন্ম নেয় – পদ্মমণি, কুমারী, করুণাময়ী এবং জগদম্বা। রাজচন্দ্র ও রাসমণির প্রথমে একটি পুত্রসন্তান জন্মালেও সে কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়। এদিকে শ্বশুরমশাই প্রীতরাম দাসের মৃত্যুর ফলে ১৮১৭ সাল নাগাদ তাঁর জমিদারির বিশাল সম্পত্তির মালিকানা বর্তায় রাজচন্দ্র দাসের উপর। রাজচন্দ্র দাস স্বভাবত দয়ালু ও সেবাপরায়ণ ছিলেন, ব্যবসার পাশাপাশি সমাজকল্যাণমূলক নানা কাজে তাঁর বিশেষ অবদান ছিল। এই সময়ই ধীরে ধীরে রাজচন্দ্রের সঙ্গে মত বিনিময় করতে করতে জানবাজারের জমিদারবাড়ির সকলের কাছে ‘রানিমা’ পরিচয় পান রাসমণি। পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে তিনিই আঠারো শতকে প্রথম পুরুষদের সঙ্গে একযোগে শলা-পরামর্শ করতেন বা কোনো সিদ্ধান্ত নিতেন যা সত্যই এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। ১৮২৩ সাল নাগাদ কলকাতায় এক ভয়াবহ বন্যার ফলে জানবাজারের বাড়ি থেকে গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। একমাত্র রাসমণির অনুরোধে এবং রাজচন্দ্র দাসের উদ্যোগে সেসময় বাবু রোড নির্মিত হয়। এখনকার যে বাবুঘাট সেটিও রানি রাসমণির উদ্যোগেই বানানো হয়। বাবু রোড এখন রানি রাসমণি রোড নামে পরিচিত। ১৮৩০ সালে স্বামী রাজচন্দ্রের অকালমৃত্যু ঘটলে সব দায়-দায়িত্ব, জমিদারির ভার এসে পড়ে রানির উপর, দিশাহারা হয়ে যান তিনি। আর ঠিক এই সময়েই রানির পরিবারের অনেকেই একাকী অসহায় রানির সুযোগ নিয়ে জমিদারি ও ব্যবসার ভাগ দখল নিতে চাইছিলেন, কিন্তু দক্ষ হাতে রানি তাদের দূরে রাখেন। জমিদারি দেখভালের কাজ শুরু করেন তিনি। পরবর্তীকালে তাঁর বিশ্বস্ত জামাই মথুরামোহন বিশ্বাস তাঁকে এ কাজে অনেকটাই সহায়তা করেছিলেন। প্রথমে রানির কন্যা করুণাময়ীর সঙ্গে মথুরামোহনের বিবাহ হলেও তার কিছুদিনের মধ্যেই করুণাময়ীর মৃত্যু ঘটে এবং পরবর্তীকালে রানির অনুরোধে মথুরামোহন বিবাহ করেন জগদম্বাকে। রানি রাসমণিকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন। শোনা যায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর একবার রাজচন্দ্র দাসের থেকে ২ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশযাত্রা করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে রাজচন্দ্র দাস মারা গেলে রানির কাছে এসে রানির জমিদারির ম্যানেজার হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। রানি এই অবস্থায় দোটানায় পড়েছিলেন কারণ দ্বারকানাথের থেকে ঋণও ফেরত নেওয়া দরকার ছিল, আবার ম্যানেজারির দায়িত্ব তিনি কিছুতেই দ্বারকানাথকে দিতে চাননি। অত্যন্ত তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে রানি রাসমণি দ্বারকানাথের থেকে ঋণের মূল্যের জমি লিখিয়ে নেন এবং দলিল হাতে পাওয়ার পর অত্যন্ত বিনীতভাবে তাঁকে জানান যে জামাই মথুরামোহনকেই রানি ম্যানেজারির ভার দিতে চান। এর অনেক পরে ১৮৫৯ সালে অধুনা বাংলাদেশের মকিমপুরে নীলকরদের অত্যাচারে জর্জরিত প্রজাদের দেখে সাহায্যের জন্য এগিয়ে গিয়েছিলেন রাসমণি। ইংরেজ নীলকর স্যার ডোনাল্ডের বিরুদ্ধে পঞ্চাশ জনের লাঠিয়াল বাহিনী পাঠালেন রানি রাসমণি। স্যার ডোনাল্ডের সৈন্যদের বিরুদ্ধে সমস্ত কৃষক এবং লাঠিয়াল একজোট হয়ে তাদের তাড়িয়ে দেন পরগণা থেকে। নীলকরদের বিরুদ্ধে সেটাই প্রথম বিদ্রোহের সূত্রপাত।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

রাজা রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা রদের উদ্যোগে অনেক সাহায্য করেছিলেন রানি রাসমণি। তিনি নিজেও বাল্যবিবাহ মেনে নিতে পারতেন না। কম বয়সী কন্যার সঙ্গে প্রৌঢ়ের বিবাহের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। আর তাই তিনি নিজের কন্যা পদ্মমণির সঙ্গে এক কিশোরের বিবাহ দেন যার সঙ্গে মাত্র দুই বছরের ব্যবধান ছিল পদ্মমণির। সমাজকল্যাণমূলক কাজের মধ্যে রানি রাসমণি নিজের উদ্যোগে আহিরিটোলা ঘাট, বাবুঘাট নির্মাণ করেন এবং নিমতলা ঘাটে একটি ছাউনি বানিয়ে দেন। জগন্নাথ দেবের স্মরণার্থীদের উদ্দেশ্যে সুবর্ণরেখা নদী থেকে সরাসরি পুরী পর্যন্ত একটি দীর্ঘ রাস্তা তৈরি করে দেন রাসমণি। বাংলায় সেসময় নেমে আসা প্রবল দূর্ভিক্ষের প্রতিরোধে বেঙ্গল ফেমাইন রিলিফ ফাণ্ডে বহু অর্থসাহায্য করেছেন তিনি। বেলেঘাটা ক্যানেল বা মধুমতী কানেক্টর তৈরির মতো হিতকর কাজের পাশাপাশি তাঁর সবথেকে বড়ো অবদান হল দক্ষিণেশ্বর মন্দির নির্মাণ। জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্য প্রথা সেকালের বাংলায় এতই প্রবল ছিল যে একজন শূদ্র নারী হয়ে মা কালীর মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় সমাজের ব্রাহ্মণদের তরফ থেকে বিরাট প্রতিবন্ধকতা আসে। ব্রাহ্মণরা কেউই চাননি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করুন রাসমণি। ধর্মপ্রাণা হলেও নিম্নবর্ণের এক মহিলার মন্দির প্রতিষ্ঠা এক বৈপ্লবিক আন্দোলনের সামিল। ইতিহাসে জানা যায় দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠার আগে একবার বারাণসীতে তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সময় রাত্রে স্বপ্নাদেশ পান আর সেই কারণেই কলকাতা থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে এই দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন তিনি। তবে খুব সহজেই এই জমি পাওয়া যায়নি। মথুরবাবুর উদ্যোগে বহু সন্ধানের পর ১৮৪৭ সালে দক্ষিণেশ্বর মন্দির নির্মাণের উপযুক্ত স্থান পাওয়া যায় যা সেকালে উইলিয়াম হেস্টি সাহেবের নিজস্ব জমি ছিল। প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকায় কেনা হয় সেই কুড়ি একরের জমি। দীর্ঘ আট বছর ধরে এই মন্দির নির্মাণের কাজ চলে এবং ১৮৫৫ সালের ৩১ মে মন্দির-নির্মাণকার্য শেষ হয় যাতে আনুমানিক প্রায় সাড়ে নয় লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল। শুধু এতেই সমস্যা মেটেনি। মন্দির তৈরি হওয়ার পরে কোনো ব্রাহ্মণই এখানে পৌরোহিত্য করতে চাননি। সেই সময় রামকুমার চট্টোপাধ্যায় এই দায়িত্ব নেন। পৌরোহিত্যের দক্ষিণা বাবদ দেয় অর্থসংস্থানের জন্য দিনাজপুরে রানির জমিদারির রাজস্ব থেকে অর্থ ধার্য করেছিলেন রাসমণি। পরে রামকুমারের ভাই গদাধর এখানে পৌরোহিত্য করেন যিনি পরে শ্রীরামকৃষ্ণ রূপে পরিচিত হবেন। উনিশ শতকের সময়পর্বে হিন্দু পুনর্জাগরণ এবং আধ্যাত্মিক সংস্কার আন্দোলনের মুখ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়েছিল এই দক্ষিণেশ্বর মন্দির এবং রানি রাসমণির অবদান এখানে সবথেকে বেশি। শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে জমিদারি-ব্যবসা ইত্যাদি বৈষয়িক ভাবনা থেকে দূরে যান রাসমণি। কালীর আরাধনাই তাঁর জীবনের মূল অঙ্গ হয়ে ওঠে।

রানি রাসমণির জন্মের ২০০ বছর পূর্তিতে রাসমণির একটি মর্মর মূর্তি স্থাপিত হয় কলকাতার কার্জন পার্কে। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের ভিতরেও তাঁর একটি মূর্তি ও স্মৃতিসৌধ রয়েছে।

১৮৬১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ৬৮ বছর বয়সে রানি রাসমণির মৃত্যু হয়।

6 comments

আপনার মতামত জানান