রোনাল্ড রস

রোনাল্ড রস

রোনাল্ড রস (Ronald Ross) ছিলেন একজন খ্যাতনামা ব্রিটিশ ডাক্তার যিনি  ম্যালেরিয়া নিয়ে তাঁর যুগান্তকারী গবেষণার জন্য ১৯০২ সালে নোবেল পুরস্কার পান৷ রোনাল্ড রস প্রথম ব্রিটিশ নোবেল জয়ী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ম্যালেরিয়া রোগের পরজীবী যে মশা বাহিত তা তিনিই প্রথম তাঁর গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন। 

ব্রিটিশ ভারতের আলমোড়া নামক একটি পার্বত্য এলাকায় ১৮৫৭ সালের ১৩ মে রোনাল্ড রসের ‘জন্ম হয়। তাঁর বাবা স্যার ক্যাম্পবেল ক্লে গ্র্যান্ট রস ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল৷তাঁর মায়ের নাম ছিল মাতিলদা শার্লট এলডারটন৷ 

রোনাল্ড রসের প্রাথমিকের পড়াশুনা শুরু হয় ইংল্যান্ডে গিয়ে। মাত্র আট বছর বয়সে তাঁকে ইংল্যান্ডের Isle of Wight-এ পাঠানো হয় তাঁর কাকা- কাকীর কাছে। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা রাইড(Ryde)-এ অবস্থিত একটি স্কুলে সম্পূর্ণ করেন। এরপর তিনি স্প্রিংহিল(Springhill) এর কাছে অবস্থিত একটি স্কুলে ভর্তি হন৷ কিশোর বয়স থেকেই তাঁর কবিতা, সঙ্গীত, সাহিত্য এবং অঙ্কের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল৷ তাঁর নিজের ইচ্ছে ছিল শিল্পী হওয়ার। কিন্তু তাঁর বাবা চেয়েছিলেন তিনি চিকিৎসক হন৷ বাবার ইচ্ছে পূরনের জন্য তিনি ১৮৭৪ সালে লন্ডনের St. Bartholomew’s Hospital Medical College এ ডাক্তারী পড়াশোনা শুরু করেন৷ ১৮৭৯ সালে রোনাল্ড রস রয়্যাল কলেজ অব সার্জন্স-এর সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন (এফ.আর.সি.এস)। কিন্তু প্রথমবার এল.এস.এ (Licentiate of the Society of Apothecaries) পরীক্ষা পাস হতে ব্যর্থ হলেও  শেষপর্যন্ত ১৮৮১ সালে তিনি এল.এস.এ ডিগ্রি অর্জন করেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

রোনাল্ড রসের কর্মজীবন শুরু হয় ১৮৮১ সালের  ২২ সেপ্টেম্বর সৈন্যবাহী একটি জাহাজে সার্জেন্ট হিসেবে। ১৮৮১ সাল থেকে ১৮৯৪ সালের মধ্যে রোনাল্ড রস বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছেন যেমন মাদ্রাজ, বার্মা, বেলুচিস্তান, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, ব্যাঙ্গালোর এবং সেকান্দ্রাবাদে ৷ ১৮৮৩ সালে তিনি ব্যাঙ্গালোরে গ্যারিসন সার্জেন(Garrison  Surgeon) পদে যোগ দেন৷ এখানেই তিনি লক্ষ্য করেন মশাকে জল থেকে দূরে রাখলে তার জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। 

১৮৯৪ সালে দ্বিতীয়বার রোনাল্ড রস  ইংল্যান্ড গেলে তাঁর পরিচয় ঘটে স্যার প্যাট্রিক ম্যাসনের সঙ্গে৷  ম্যাসন তাঁকে ১৮৮০ সালে আলফনস্ লেভারান আবিষ্কৃত মানবদেহে ম্যালেরিয়ার জীবাণুগুলির সঙ্গে পরিচয় করান। ম্যাসন সবসময়ে অনুভব করতেন ম্যালেরিয়া এবং মশা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার আদর্শ স্থান ভারতবর্ষ৷ ২০ মার্চ ১৮৯৫ সালে রোনাল্ড রস ভারতে ফিরে আসেন৷ বোম্বাইয়ের কাস্টম অফিস থেকে নিজের জিনিসপত্র আনার আগে তিনি বোম্বে সিভিল হাসপাতালে চলে যান ম্যালেরিয়ার রোগী দেখতে এবং তাদের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করতে৷ প্রায়,দুই বছর ধরে তিনি ম্যালেরিয়ার মশা সংক্রান্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। ব্যাঙ্গালোরে ম্যলেরিয়ার তেমন প্রকোপ ছিল না তাই প্রায় দুবছর ধরে  পরীক্ষা- নিরীক্ষা করেও ব্যর্থ হওয়ার পর ১৮৯৭ সালে তিনি ‘ বাদামী ‘ মশার লার্ভা সংগ্রহ করেন এবং পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান ৷ হুসেন খান নামের এক রোগীর উপর তিনি এই পরীক্ষা চালান৷ রোনাল্ড রস  পরীক্ষার মাধ্যমে বুঝতে পারেন, যে কোনো প্রজাতির মশাই ম্যালেরিয়া পরজীবীর বাহক হয় না৷ এই পরজীবীর বাহক একটি বিশেষ প্রজাতির মশা৷ এই  মশাগুলি রঙীন বা ছিট ছিট  ডানাযুক্ত (dappled-wings) হয়ে থাকে। ২০ আগস্ট রস মশার অন্ত্রে ম্যালেরিয়া পরজীবীর উপস্থিতির বিষয়ে নিশ্চিত হন।

পরবর্তীকালে মশার এই প্রজাতিই অ্যানোফিলিস(Anopheles) নামে পরিচিত হয়েছে। পরদিন অর্থাৎ ২১ আগস্ট তিনি এই মশার মধ্যে পরজীবির বৃদ্ধি লক্ষ করেন৷ মানুষের মধ্যে ম্যালেরিয়া পরজীবী সংক্রমণে অ্যানোফিলিস মশার ভূমিকা প্রমাণ করেনতিনি । ম্যালেরিয়ার জন্য যে স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা দায়ী, তা আবিষ্কার করেন রোনাল্ড রস। তাঁর এই আবিস্কার ২৭ আগস্ট ১৮৯৭ সালে দ্য ইন্ডিয়ান মেডিকেল গেজেট এবং ডিসেম্বর মাসে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয়। 

ম্যালেরিয়া রোগের পরীক্ষা তিনি পাখির ওপরও করেন।  ১৮৯৮ সালের জুলাই মাসের মধ্যে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে কিউলেক্স মশা পাখির দেহে হওয়া ম্যালেরিয়ার মধ্যবর্তী আশ্রয়দাতা (Host)হিসাবে কাজ করে। তিনি গবেষণায় বুঝতে পারেন ম্যালেরিয়া জল বা বায়ুবাহী কোন রোগ নয়, এটি একটি সংক্রামক ব্যাধি যা একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে মশার মাধ্যমে সংক্রামিত হয়। 

১৮৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রোনাল্ড রসকে বোম্বাইতে স্থানান্তর করা হয়, সেখান থেকে পরে তাঁকে রাজপুতানায় (বর্তমান রাজস্থান) ম্যালেরিয়া মুক্ত এলাকা খেরোয়ায় পাঠানো হয়। সেখানে কাজের অভাব দেখে তিনি হতাশ হয়ে শেষে চাকরি থেকে পদত্যাগ করার হুমকি দেন৷ এমন অবস্থায় ১৭ ফেব্রুয়ারী ১৮৯৮ সালে সরকার থেকে তাঁকে বিশেষ কাজে কলকাতায় পাঠানো হয়। সেখানে গিয়ে তিনি পি.জি. হাসপাতালে (Presidency General Hospital) যোগদান করেন। তিনি মহানদ গ্রামে একটি বাড়ি এবং তার সঙ্গে একটি পরীক্ষাগার তৈরী করেন৷ সেখানে থেকে তিনি গ্রামাঞ্চল থেকে মশা সংগ্রহ করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন। তাঁর পরীক্ষাগারে সহায়ক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন কিশোরী মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ৮ জুলাই তিনি আবিষ্কার করেন মশার লালাগ্রন্থিই ম্যালেরিয়া পরজীবির বাসস্থান। 

১৮৯৯ সালে রোনাল্ড রস ‘ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিস ‘ থেকে পদত্যাগ করে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। নতুন প্রতিষ্ঠিত লিভারপুল স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন (Liverpool School of Tropical Medicine) এ তিনি লেকচারার পদে নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি ট্রপিক্যাল মেডিসিনে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন।

তাঁর প্রথম কাজ ছিল পশ্চিম আফ্রিকার ম্যালেরিয়া বিরোধী প্রকল্পগুলি তদন্ত করা এবং ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের পরিকল্পনা গড়ে তোলা৷ ১৯০১ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন এবং ১৯০৯ সালে তাঁকে রয়াল মেডেল প্রদান করা হয়। ১৯০২ সালে নোবেল পুরষ্কার অর্জন ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯১২ সালের পর থেকে তিনি একই সঙ্গে কিংস কলেজ হসপিটালের ট্রপিক্যাল রোগের ফিজিশিয়ান এবং লিভারপুলের ট্রপিক্যাল স্যানিটেশনের অধ্যাপকের দ্বৈত দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রোনাল্ড রসকে ভারতীয় সেনাদের কাছে ট্রপিক্যাল ডিজিজ (Tropical Disease) এর ব্যপারে মূল পরামর্শদাতা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়৷  রোনাল্ড রসের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯২৬ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস ট্রপিক্যাল ডিজিজ এর জন্য লন্ডনে Ross Institute and Hospital তৈরী করেন৷ 

রোনাল্ড রস ম্যালেরিয়া বিষয়ে বহু নিবন্ধ লিখেছিলেন, Report on Cholera, General Sanitation, and the Sanitary Department and Regulations,  Report on the Cultivation of Proteosoma Labbé, in Grey Mosquitoes (1898), Report on the Nature of Kala-azar (1899), Malarial Fever: Its Cause, Prevention and Treatment, ইত্যাদি। কেবল তাই নয় রোনাল্ড রসের সাহিত্যচর্চাও মনে রাখার মতন৷ তাঁর লেখা কবিতা সংকলনের বইয়ের নাম Selected Poems (1928) এবং In Exile (1931)। তাঁর লেখা বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল The Child of Ocean (1899 and 1932), The Revels of Orsera, The Spirit of Storm, Fables and Satires (1930), Lyra Modulatu (1931), and five mathematical works (1929–1931). 

প্রতিবছর ২০ আগস্ট তাঁর ম্যালেরিয়া পরজীবীর বাহক হিসেবে মশার ভূমিকা আবিষ্কারের দিনটিকে London School of Hygiene & Tropical Medicine ‘বিশ্ব মশা দিবস‘ নামে পালন করে থাকে৷ 

তাঁর লেখা জীবনী ‘ Memoirs ‘ ১৯২৩ সালে James Tait Black Memorial Prize পুরস্কারে ভূষিত হয়। 

ম্যালেরিয়া নিয়ে কাজের জন্য রোনাল্ড রসকে ভারতবর্ষে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। ম্যালেরিয়া একসময় মারাত্মক মহামারীর আকার নিয়েছিল।প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের প্রাণ এই রোগে চলে যেত। তাঁকে সম্মান দিয়ে ভারতের বিভিন্ন শহর ও নগরগুলির বেশ কিছু রাস্তা তাঁর নামে নামকরণ করা রয়েছে। তাঁর স্মরণে হায়দ্রাবাদে Sir Ronald Ross Institute of Tropical and Communicable Diseases’ নামে  একটি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। 

১৯৩২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর রোনাল্ড রসের মৃত্যু হয়৷ 

3 comments

আপনার মতামত জানান