সতীপীঠ পঞ্চসাগর

সতীপীঠ পঞ্চসাগর

পঞ্চসাগর মন্দিরটি উত্তরপ্রদেশের বারাণসীর কাছেই অবস্থিত। এটি একান্ন সতীপীঠের একটি পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর নিচের পাটির দাঁত পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী বারাহী এবং ভৈরব হলেন মহারুদ্র। সতীপীঠ পঞ্চসাগর বারাহী দেবীর মন্দির নামেও পরিচিত।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের বাপের বাড়িতেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছাতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব এই দেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন। মহাদেবের তান্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখণ্ডগুলিই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। সেই রকম একটি পীঠ হলো সতীপীঠ পঞ্চসাগর। বলা হয় সতীর নিচের পাটির দাঁত মাটিতে পড়েই জন্ম হয়েছে এই সতীপীঠ পঞ্চসাগরের।

পঞ্চসাগর মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী সত্যিই অসাধারণ। যে পাথর দিয়ে এই সতীপীঠ নির্মিত হয়েছে, সূর্যের আলো পড়লেই তা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মন্দিরের পাশেই জলাশয়ে মন্দিরের ছায়া পড়লে এক স্বর্গীয় দৃশ্য রচনা হয়। বৈষ্ণব, শৈব এমনকি শাক্তধর্মের মানুষও এই মন্দিরে উপাসনা করতে আসেন। ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত মাত্র ২ ঘন্টাই এই মন্দিরটি খোলা থাকে, বাকি সারাদিন মন্দির বন্ধ থাকে। মনে করা হয় দেবী বারাহী রাত্রে সমগ্র বারাণসীকে রক্ষা করেন।  

মৎস্যপুরাণে বলা হয়েছে যে মহাদেব শিবই নিশাচর এক দৈত্যকে হত্যার জন্য বিষ্ণুর বরাহ অবতারকে পরিবর্তিত করে দেবী বারাহীকে সৃষ্টি করেছিলেন। হিন্দু ধর্মে যে সাত-আটজন মাতৃদেবীর কল্পনা করা হয়, তার মধ্যে দেবী বারাহী অন্যতম। বারাহী আসলে বরাহ অবতারের নারীশক্তি। শূকরের মতোই তাঁর চেহারা, তাঁর এক হাতে রয়েছে চক্র এবং অন্য হাতে তলোয়ার। মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবী বারাহীকে একজন আশীর্বাদদাত্রী এবং পৃথিবীর উত্তর দিকের শাসনকর্ত্রী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে একটি শ্লোকে পৃথিবীর একেক দিকের রক্ষাকর্তা হিসেবে একেক মাতৃকার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। দেবী বারাহীকে অনেক জায়গায় মহিষবাহনা হিসেবেও দেখানো হয়েছে। রক্তবীজের কাহিনিতে দেখা যায় যে, একটি মৃতদেহের উপর বসে শূকরের বেশ ধরে দাঁত দিয়ে বারাহী দেবী শত্রু নিধনের চেষ্টা করছেন। অনেকে আবার মনে করেন বৌদ্ধ দেবতা বজ্রবারাহী এবং মারীচির মিশ্রণেই নাকি হিন্দুদের এই বারাহী দেবীর সৃষ্টি হয়েছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের ক্ষেত্রে দেবী মাহাত্ম্যের বর্ণনা পাওয়া যায়।

প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকেন। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। সতীপীঠ পঞ্চসাগরে দেবী হলেন বারাহী এবং ভৈরব এখানে মহারুদ্র নামে পূজিত হন।

পঞ্চসাগর সতীপীঠে মহাসমারোহে রথযাত্রা পালন করা হয়। তাছাড়া দুর্গাপূজা, নবরাত্রি, বিজয়া দশমী ইত্যাদি এবং কালাভাম নামের এক বিশেষ উৎসব পালিত হয় এখানে। প্রায় প্রতিদিনই স্থানীয় মানুষ এবং দর্শনার্থীরা ফল, দুধ, ঘরে তৈরি মিষ্টি দেবীকে উৎসর্গ করেন এবং সকাল-সন্ধ্যায় পুরোহিত মন্ত্রপাঠ ও যথোপচারে দেবী বারাহীর পূজা করে থাকেন।  

আপনার মতামত জানান