জয়নুল আবেদীন

জয়নুল আবেদীন

জয়নুল আবেদীন (Zainul Abedin) বাংলাদেশের আধুনিক ও সমসাময়িক শিল্প আন্দোলনের অগ্রগামী একজন চিত্রকর। তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালা, সংগ্রাম, ঝড়, কাক, বিদ্রোহী ইত্যাদি। ১৯৬৯ সালে গ্রামবাংলার উৎসব নিয়ে জয়নুল আবেদীন আঁকেন তাঁর বিখ্যাত ৬৫ ফুট দীর্ঘ ছবি ‘নবান্ন’। এছাড়াও বাংলাদেশের মাতৃভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধেও যথেষ্ট অবদান রেখেছেন জয়নুল। বাংলাদেশের চিত্রকলায় অবদান, দূরদর্শী শিল্পসত্তা , চিত্রশিল্প বিষয়ক শিক্ষার প্রসারে আমৃত্যু প্রচেষ্টার জন্য বাংলাদেশে তিনি ‘শিল্পাচার্য’ (Great Teacher of the Arts) অভিধা লাভ করেছেন। 

১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার কেন্দুয়ায় জয়নুল আবেদীনের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম তমিজউদ্দিন আহমদ এবং  মায়ের নাম জয়নাবুন্নেছা। তাঁর বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। নয় ভাইবোনের মধ্যে জয়নুল আবেদীন ছিলেন সবার বড়। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন। বাড়ির পাশেই প্রবাহমান ব্রহ্মপুত্র নদ তাঁর চিত্রকর্মে ঘুরে ফিরে এসেছে আজীবন। ১৯৪৬ সালে জয়নুল ঢাকা নিবাসী তৈয়বউদ্দিন আহমদের কন্যা জাহানারা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি তিন পুত্রের জনক।

জয়নুল আবেদীনের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল স্থানীয় মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালয় থেকে। পড়াশোনার পাশাপাশি ছবি আঁকা বাল্যকাল থেকেই তাঁর সঙ্গী। এইসময়ে ‘দ্যা বম্বে ক্রনিকল’ আর্ট প্রতিযোগিতায় (The Bombay Chronicle Art Competition) প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। এরপর থেকেই তাঁর অঙ্কন তাঁর পরিচয় হয়ে উঠতে শুরু করে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাঁর আঁকা আরও ছবি ভারতবর্ষে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাঁকে কলকাতার আর্ট কলেজে (তৎকালীন গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস) ভর্তি হওয়ার জন্য উৎসাহ দান করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে শুধুমাত্র কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখবেন বলে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মা ছেলের আগ্রহ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতার আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে সাহায্য করেন। জয়নুল আবেদীন ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে পড়েন। ১৯৩৮ সালে ড্রইং অ্যান্ড পেন্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থানাধিকারী প্রথম ইসলামাবলম্বী ছাত্র হিসেবে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

পাঁচ বছর কলকাতার আর্ট স্কুলে ইউরোপীয় ও ব্রিটিশ চিত্রকলা শেখার পর ঐ প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকতা শুরু করেন জয়নুল। এরপর ক্রমে ইউরোপীয় চিত্রকলার সীমাবদ্ধতায় বিরক্ত হয়ে ওঠেন তিনি। লন্ডনের ‘স্লেড স্কুল অব ফাইন আর্টস'(Slade School of Fine Arts) থেকে দুইবছর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন জয়নুল। তিনি তাঁর ‘বেঙ্গলি স্টাইল'(Bengali style) নামক নতুন ধারার ছবিতে লোকশিল্প বা আঞ্চলিক শিল্পের জ্যামিতিক নকশাকে তুলে ধরেন। তাঁর কিছু কিছু ছবিতে বিমূর্ত শিল্পের ছোঁয়া পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া প্রাথমিক রঙের ব্যবহারের ফলে ছবিগুলি অনন্য বিশেষত্ব লাভ করেছিল। তবে কিছুদিন পর নিজের এই ধারার ছবিতে তিনি লোকশিল্পের মূল নির্যাসের খামতি অনুভব করলেন। তখন তিনি প্রকৃতির কাছে গ্রাম্য পরিবেশে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের অংশ হয়ে গিয়ে আঞ্চলিকতার ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করেন। ফলে তাঁর পরবর্তী ছবিগুলিতে আধুনিকতার সঙ্গে আঞ্চলিক সংস্কৃতির বাস্তবিকতার মিশেলে নতুন প্রাণসঞ্চারিত হয়। কলকাতার ‘অখিল ভারতীয় প্রগতিশীল লেখক সংঘ’ দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। এছাড়া মানুষের দুঃখ দুর্দশা গভীর ছাপ ফেলেছিল তাঁর মননে। কখনো বাংলার ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১৯৪৩ সালে) ‘দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা’ হয়ে ফুটে উঠেছে তাঁর তুলির টানে। কখনো প্যালেস্তাইনে সিরিয়া ও জর্ডনবাসীদের ক্যাম্প ঘুরে এসে উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণার খণ্ডচিত্র  ধরে রেখেছেন ছবিতে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত মানুষের আর্তির প্রকাশ পেয়েছে ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ‘ভোলা’ নামক ঘূর্ণিঝড়ের চিত্রে। অনুমান করা হয় তাঁর চিত্রকর্ম তিন হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরে তাঁর সৃষ্ট আটশোরও বেশী ছবির সংগ্রহ রয়েছে। এছাড়া জয়নুল আবেদীন আর্ট গ্যালারীতে তাঁর অঙ্কিত বেশ কিছু চিত্র রয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর জয়নুল পূর্ব পাকিস্তানে একটি চিত্রকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভব করেন। ১৯৪৮ সালে বন্ধুদের সহযোগিতায় পুরনো ঢাকার জনসন রোডের ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের একটি জীর্ণ কক্ষে একটি আর্ট ইন্সটিটিউট স্থাপন করেন তিনি।  মাত্র ১৮ জন ছাত্রকে নিয়ে সূচিত প্রতিষ্ঠানটির প্রথম শিক্ষক ছিলেন জয়নুল নিজেই। বারবার ঠিকানা পাল্টে প্রতিষ্ঠানটি শাহবাগে স্থান পায় এবং ১৯৬৩ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়’ নামে একটি প্রথম শ্রেণীর সরকারি কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।  ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছিলেন জয়নুল। এইসময়ে প্রতিষ্ঠানটি পূর্ব পাকিস্তানের সেরা চারু ও কারুকলা শিক্ষার কেন্দ্ররূপে গণ্য হত। এই প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানী শিল্পী মনসুর রাহী এবং বাংলাদেশের শিল্পী মনিরুল ইসলাম ও মহম্মদ কিবরিয়া তাঁর ছাত্র ছিলেন। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জয়ের পর এই প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়’।

১৯৫০ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে অবহেলিত শিল্প নিদর্শন সংগ্রহ করতে শুরু করেন যেগুলি ভবিষ্যতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগ্রহশালার উপাদান হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাঁকে বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলার জনক রূপে বিবেচনা করেছেন। নিজের শিল্পকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে  তিনি অংশ নেন বাংলা ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৬৯-এ অঙ্কিত দীর্ঘ স্ক্রল ‘নবান্ন’, ১৯৭১-এ ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’  তার  সাক্ষ্যবহন করে। এছাড়াও তাঁর চিত্রকর্মের মধ্যে অন্যতম ১৯৫৭-এ ‘নৌকা’, ১৯৫৯-এর ‘সংগ্রাম’ ‘ম্যাডোনা’, ‘সাঁওতাল রমনী’, ‘কাক’; ১৯৭৪-এর ‘মনপুরা-৭০’ ইত্যাদি। 

পূর্ববঙ্গের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন জয়নুল আবেদীন। জয়নুল আবেদীনের উদ্যোগে ১৯৪৮ এ স্থাপিত গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউটটিই ১৯৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত ‘বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়’ তে রূপান্তরিত হয়। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ময়মনসিংহ জেলায় পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে শাহীব কার্তার পার্ক এলাকায় তিনি একটি আর্ট গ্যালারী বা শিল্প সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা শুরু করেন, যা ১৫ এপ্রিল ১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃক পরিচালিত উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এটির উন্নতি করা হয় এবং একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়। প্রয়াত শিল্পীর স্মৃতির সম্মানে যাদুঘরের নামকরন করা হয় ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালা’। এই সংগ্রহশালাটির সঙ্গে আবেদীনের ইচ্ছা অনুসারে পরবর্তীকালে একটি শিল্প বিদ্যালয় (Art School)  তৈরী করা হয়। পাশাপাশি যাদুঘর সংলগ্ন ছাত্রনিবাস এবং একটি অনুষ্ঠানমঞ্চও নির্মাণ করা হয়েছে।১৯৭৫ সালে তাঁর প্রচেষ্টায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে লোকশিল্প জাদুঘরও নির্মিত হয়েছে।

ব্রহ্মপুত্র নদ ছিল তাঁর ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। জলরং দিয়ে আঁকা ব্রহ্মপুত্র নদের ছবিগুলির জন্য ১৯৩৮ সালে চিত্র প্রদর্শনীতে জয়নুল আবেদীন নিখিল ভারত স্বর্ণপদক(Governor’s Gold Medal) লাভ করেন। তিনি ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সবথেকে বড় খেতাব ‘হেলাল-ই-ইমতিয়াজ’, ১৯৬৮ সালে ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্রদের তরফ থেকে ‘শিল্পার্চায’ উপাধি এবং ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে জাতীয় অধ্যাপকের সম্মান লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি.লিট ডিগ্রী (Honourary Doctor of Letters) প্রদান করে।ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন কর্তৃক ৯ জুলাই, ২০০৯ সালে বুধ গ্রহের একটি জ্বালামুখ (crater) তাঁর স্মরণে নামকরণ করা হয়। বিশ্বের প্রাচীনতম ও সর্ববৃহৎ ব্রিটিশ নিলামকারী প্রতিষ্ঠান বনহামসে তাঁর স্কেচ বিক্রয় হয়। প্রতি ডিসেম্বরে তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উৎসব হয় ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালায় তাঁর ছবি বিষয়ে আলোচনা সভা ও শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ২০১৯ সালে তাঁর ১০৫তম জন্মদিনে গুগল ডুডল ফিচার করে সম্মান প্রদর্শন করে।

ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে ঢাকায় জয়নুল আবেদীনের মৃত্যু হয়।

3 comments

আপনার মতামত জানান