গড়পঞ্চকোট

গড়পঞ্চকোট ভ্রমণ

গড়পঞ্চকোটের পথে। ছবি- কৃষ্ণাশিষ রায়
গড়পঞ্চকোটের পথে। ছবি- কৃষ্ণাশিষ রায়

প্রকৃতির রূপ দেখে চোখ জুড়োনোর জন্য গড়পঞ্চকোট হল আদর্শ জায়গা। লম্বা ছুটি না পেলেও ক্ষতি নেই। দিন দুইই যথেষ্ট। তার মাঝেই দেখে আসতে পারা যায় যে কিভাবে নিসর্গ আর ইতিহাস একসঙ্গে বাস করে গড়পঞ্চকোটে।

পুরুলিয়া জেলার উত্তর-পূর্বাংশে নিতুড়িয়া থানা এলাকায় পাঞ্চেত পাহাড়ের পাদদেশে গড়পঞ্চকোট অবস্থিত। কলকাতা থেকে এর দুরত্ব প্রায় ২৫০ কিমি এবং ঝাড়খণ্ড ও বর্ধমানের সীমানা ঘেঁষে থাকা অঞ্চলে এটি অবস্থিত।

গড়পঞ্চকোট এককালে পঞ্চকোট রাজাদের রাজধানী ছিল। ‘গড়’ মানে দুর্গ, ‘পঞ্চ’ মানে পাঁচ এবং ‘কোট’ মানে গোষ্ঠী। পঞ্চকোটের প্রথম রাজা ছিলেন দামোদর শেখর। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে পুরুলিয়ার ঝালদা অঞ্চলের পাঁচ আদিবাসী গোষ্ঠীর সর্দারদের সাহায্যে এখানে তিনি রাজত্ব গড়ে তোলেন। সেই থেকেই এই জায়গার নাম গড়পঞ্চকোট। এই রাজার উত্তরসূরীরাই ছোট বড় মিলে প্রায় চল্লিশটি মন্দির তৈরি করেছিলেন। তবে তার মধ্যে দুই একটিরই কেবল ভগ্নাবশেষ পাওয়া যায়। যেমন একটি মন্দির যা পঞ্চতন্ত্র বা পঞ্চরত্ন মন্দির নামে পরিচিত। বর্তমানে মন্দিরে কোনও দেবদেবীর মূর্তি নেই। মন্দিরটি পর্যটনের প্রসারে সাজিয়ে তুলিয়েছে রাজ্য তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের পূরাতত্ত্ব বিভাগ। আবার কিছু ঐতিহাসিকের মতে ধনী বণিকদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল এই মন্দিরগুলো। তবে মন্দির যেইই তৈরি করে থাকুক না কেন, সেগুলো ধ্বংস হয় মারাঠা বর্গীদের আক্রমণে। বাংলায় এসে এই গড়পঞ্চকোটে তারা হামলা এবং লুটপাঠ চালায়। জনশ্রুতি, শেষ রাজার ১৭ জন রানি সম্মান বাঁচাতে আত্মহত্যা করেছিলেন। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে একটি প্রকাণ্ড রাজবাড়িতে রাজার সতেরো রানীর মহলা ছিল বর্গীদের আক্রমণে রানীরা পাশে থাকা একটি কুয়োতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

প্রকৃতির সুন্দর ছবি । ছবি- কৃষ্ণাশিষ রায়
প্রকৃতির সুন্দর ছবি । ছবি- কৃষ্ণাশিষ রায়

প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী এক সময় মাইকেল মধুসূদন পুরুলিয়ার আদ্রার কাছে কাশীপুর রাজবাড়ির সেরেস্তায় চাকরি করতেন। একটা বেলগাছের তলায় বসেই নাকি সনেট লিখেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তবে কোন সনেট তা জানা যায়নি।

গড়পঞ্চকোট জুড়ে রয়েছে সবুজের সমাহার। ২১০০ ফুট উঁচু পঞ্চকোট পাহাড়ের তলদেশে গোটা এলাকা ঘন জঙ্গলে ঢাকা। শাল, পিয়াল, মহুল, হরিতকি থেকে নানারকম বনৌষধি গাছগাছড়ায় সমৃদ্ধ এই পাহাড়। ১৮ বর্গ কিমি বিস্তৃত এই এলাকায় প্রায় দুশোর বেশি গুল্ম রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে সর্পগন্ধা, অর্জুন, অনন্তমূলের মতো ভেষজ ওষুধ তৈরির গাছ। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী সুদূর দাক্ষিণাত্য থেকে এখানে আসতেন আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞরা। অজস্র প্রজাপতি এমনভাবে উড়তে থাকে যে পাহাড় পথে এগোলেই মনে হবে রংয়ের বর্ণমালা। বাহারি সব প্রজাপতি। জঙ্গলে রয়েছে হরেক রকম পাখি। তবে পাখি এবং প্রজাপতির পাশাপাশি গড়পঞ্চকোটের জঙ্গলে প্রচুর ময়াল ও পাইথনও রয়েছে। জঙ্গলের মধ্যে দেখা মেলে হায়নার। পাহাড়ে থাকা ‘গড়’ বা দুর্গের সন্ধান বর্তমানে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে এদিক ওদিক বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকা দূর্গের টুকরো টুকরো চিহ্ন এখনও রয়েছে পাহাড়ের গায়ে সবুজের খাঁজে খাঁজে। চোখে পড়বে গড়ের ধ্বংসাবশেষ, ভাঙাচোরা পুরনো বাড়ি। পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালে খননে টেরাকোটা, জোড়বাংলো, পাঁচ চুড়োর ৯টি মন্দির, গোপন কুটুরি, সুড়ঙ্গ ছাড়াও নানান অতীত আবিষ্কৃত হয়েছে।

কাছে একটি সাঁওতালি গ্রাম আছে। তাদের অকৃত্তিম আতিথেয়তা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। খাওয়ার পর্ব শেষ করে দুপুরে একটু গড়িয়ে নিয়ে স্নিগ্ধ বিকেলের দিকে বেরিয়ে পড়ুন চারপাশের শোভা উপভোগ করতে।

ঘন সবুজের মাঝে গড়পঞ্চকোট গড় । ছবি- কৃষ্ণাশিষ রায়
ঘন সবুজের মাঝে গড়পঞ্চকোট গড় । ছবি- কৃষ্ণাশিষ রায়

ট্রেনে আসতে চাইলে গড়পঞ্চকোটের নিকটবর্তী স্টেশন হলো বর্ধমানের বরাকর। বরাকর থেকে গড়পঞ্চকোটের দূরত্ব ১৯ কিমি। বরাকর স্টেশন থেকে অটো ভাড়া করে আসা যায় গড়পঞ্চকোটে। আগে থেকে গাড়ি বুক করে রাখলে তাতেও বরাকর স্টেশন থেকে গড়পঞ্চকোটে আসা যায়। গাড়িতে আসতে চাইলে বর্ধমানের আসানসোল থেকে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে গড়পঞ্চকোট ৪৫ মিনিট। বরাকর-বেগুনিয়া মোড় থেকে বামদিকে ঢুকে যাচ্ছে দিশেরগড় রোড। এই রাস্তা ধরে পৌঁছতে হবে গড়পঞ্চকোটে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে সবুজ বনানী চিরে চলে গেছে পিচ রাস্তা। বাঁ দিকে পঞ্চকোট পাহাড় ক্রমশ মাথা তুলেছে। ডান দিকে ধানক্ষেত। রেল পথে  সেখান থেকে সরাসরি গড়পঞ্চকোটে যাওয়ার গাড়ি পেয়ে যাবেন।

গড়পঞ্চকোটে থাকার মধ্যে আছে কিছু সরকারি বাংলো, লজ ও গুটি কয়েক প্রাইভেট লজ। রাজ্য সরকারের ফরেস্ট বাংলোটি রয়েছে পঞ্চকোট পাহাড়ের যে পিঠে গড় রয়েছে ঠিক তার উল্টো পিঠে। পরিবেশের মতো মানানসই কটেজগুলির ভেতরের এবং বাইরের সাজ।

কাছ থেকে গড়পঞ্চকোট গড় । ছবি- কৃষ্ণাশিষ রায়
কাছ থেকে গড়পঞ্চকোট গড় । ছবি- কৃষ্ণাশিষ রায়

পঞ্চকোট পাহাড়ে থাকা গড়পঞ্চকোট দূর্গের কোনও চিহ্ন এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু গড়পঞ্চকোটের গেট, জোড় বাংলা, ওয়াচ টাওয়ার, রানি মহল এইসব ঘুরে দেখলে এখনও এক উজ্জ্বল ইতিহাস মনে স্থান পাবে। টুরিস্ট লজ গুলির থেকে ‘গড়’ এর দূরত্ব মিনিট তিরিশেক হবে। পঞ্চকোটে যাওয়ার পথেই কাছাকাছি রয়েছে পাঞ্চেত জলাধার। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে সেখানে পশ্চিমবঙ্গ পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের অফিস থেকে মোটামুটি দেড় কিমি দূরে জলাধারটি রয়েছে। সেখানে যেতে হলে কাছের একটি সাঁওতালি গ্রামের উপর দিয়ে যেতে হবে। সহজ সরল গ্রাম্য জীবন। কোথাও বাচ্চারা লাল মাটিতে বসে মার্বেল খেলছে কোথাও বা বুড়োর দল হুঁকো টানছে। তারই মাঝে যেতে যেতে একটি ছোট আলুর চপ ভাজার দোকান চোখে পড়তে পারে।  তবে সন্ধ্যে ঘনিয়ে রাত নামার আগে যাতে লজে ফিরতে পারেন সেই বুঝে সেখান থেকে ফেরার পথ ধরাই ভালো। কেননা রাস্তায় কোনো বৈদ্যুতিক আলো নেই। রাতে লজে ফিরে রাতের খাওয়া সেরে যদি পারেন ছাদে উঠে চারিপাশটায় দেখুন। এক অন্য অভিজ্ঞতা হবেই।

গড়পঞ্চকোটের ১০ থেকে ১২ কিমি-এর মধ্যে রয়েছে পশ্চিম বর্ধমানের সীমানা লাগোয়া বিখ্যাত কল্যাণেশ্বরী মন্দির। মন্দিরে পুজো দিতে পারেন এবং পাশের মাইথনে ঘুরে আসতে পারেন। মাইথনে এসে নৌকাবিহারও করতেই পারেন। আর গড়পঞ্চকোট থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে ঝাড়খণ্ডের ধানবাদে স্নেক পার্কেও ঘুরে আসতে পারেন। এছাড়াও পাঞ্চেত বাঁধ, বিরিঞ্চিনাথের মন্দির, জয়চন্ডী পাহাড়, বরন্তিতে মুরারডি লেক ঘুরে আসা যায়।

গরমকালে এই অঞ্চলে অত্যধিক গরম থাকে, সেই সময়ে না যাওয়ায় ভালো। বর্ষাকালে এখানে সাপখোপ বেরতে পারে। কিন্তু আপনি যদি খুব রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ হন তাহলে বর্ষাকালে এলে এখানের প্রকৃতির অপরূপ শোভা দেখতে পাবেন। তবে সেই সময় জঙ্গলে প্রচুর সাপ, বিষাক্ত পোকামাকড় বার হয়। গড়পঞ্চকোটে আসার সবচেয়ে ভালো সময় হল শীতকাল।

সরকারি বাংলোতেই থাকুন বা বেসরকারি লজে, সেখানকার রান্নার ঠাকুরদের হাতে তৈরী দেশী মুরগির ঝোল যে কোনো খাদ্য রসিকের স্বপ্ন। কটেজের কর্তৃপক্ষর সঙ্গে কথা বলে বিকেল বা সন্ধ্যের দিকে লোকনৃত্য দেখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যারা একটু অ্যাডভেঞ্চার ভালবাসেন তাদের জন্য  রয়েছে পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের ব্যবস্থা।


ট্রিপ টিপস

  • কিভাবে যাবেন –  সড়ক পথ – কলকাতা থেকে ভলভো বাস এ করে আসানসোল | সেখান থেকে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে বরাকর হয়ে গড়পঞ্চকোট । বরাকর-বেগুনিয়া মোড় থেকে বামদিকে ঢুকে যাচ্ছে দিশেরগড় রোড। এই রাস্তা ধরে পৌঁছতে হবে গড়পঞ্চকোটে। রেল পথ – রেল পথে গড়পঞ্চকোটের নিকটবর্তী স্টেশন হলো বরাকর। সেখান থেকে সরাসরি গড়পঞ্চকোটে যাওয়ার গাড়ি পেয়ে যাবেন ।
  • কোথায় থাকবেন – সরকারি ও বেসরকারি লজ দুইই পাবেন গড়পঞ্চকোটে । উল্লেখযোগ্য সরকারি লজ গুলি হল WBFDC গড়পঞ্চকোট নেচার রিসোর্ট, PHE গেস্ট হাউস, পাঞ্চেত রেসিডেন্সি, গড়পঞ্চকোট ইকো টুরিজম।
  • কি দেখবেন – গড়পঞ্চকোটের গড়, পাঞ্চেত বাঁধ, বিরিঞ্চিনাথের মন্দির, জয়চন্ডী পাহাড়, বরন্তি মুরারডি লেক, কল্যাণেশ্বরী মন্দির।
  • কখন যাবেন – গরমকালে এই অঞ্চলে অত্যধিক গরম থাকে, সেই সময়ে না যাওয়ায় ভালো । বহু সংখ্যক টুরিস্ট এই অঞ্চলে শীতকালে এসে থাকে এই অঞ্চলের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে ।
  • সতর্কতা – 
    • স্থানীয় বাসিন্দারা সন্ধ্যের পরে লজের বাইরে বেরোতে নিষেধ করে কারণ এই অঞ্চলে রাতের পর নানা প্রকার দুর্বৃত্তকারীদের উৎপাত আছে বলে শোনা যায়।
    • একা একা জঙ্গলের ভিতরে যাবেন না। বিশেষ করে বর্ষাকালে জঙ্গলের ভিতরে যাবেন না। সাপের ভয় আছে।

তথ্যসূত্র


  1. নিজস্ব প্রতিনিধি
  2. https://ebela.in/entertainment/
  3. https://www.anandabazar.com/
  4. https://www.sangbadpratidin.in
  5. https://www.bongodorshon.com

8 comments

  1. সমস্ত তথ্য যাচাই করে আমরা লেখাটি আপডেট করেছি। আমাদের পাশে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

  2. ভূল তথ্য দিয়ে মানুষ কে বিভ্রান্ত করবেন না। গড় পঞ্চকোট এর ১.৫ কিমি এর মধ্যে রূপনারায়ণ নদী নেই। নেই রূপনারায়ণ নদীর জলাধার। সামনে রয়েছে দামোদর নদ এর এবং তার উপর ডিভিসি এর তত্ত্বাবধানে গঠিত পঞ্চেত জলাধার। সাঁওতাল ঘেঁষা রান্নার স্বাদ !! একটু বেশি হয়ে গেলো না?? পাহাড়ের উচ্চতা ৬৪৩ মি; ৬৪৬ মিটার নয়।

    1. ধন্যবাদ বিট্টু মণ্ডল মহাশয়। আমরা তথ্যগুলো যাচাই করছি। আপনি এই ভ্রমণ বিষয়ে আরও তথ্য থাকলে তা উপযুক্ত তথ্যসূত্র সমেত আমাদের মেইল করুন এই ঠিকানায় – editor@sobbanglay.com

আপনার মতামত জানান