
বাঁকুড়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পাহাড় হল শুশুনিয়া পাহাড়। এই পাহাড় পর্যটক বা পর্বতারোহী অন্যতম সেরা পছন্দের মধ্যে পড়ে। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম শিলালিপিটি এই পাহাড়েই অবস্থিত। এই শিলালিপি বা বিভিন্ন প্রাচীন জীবাশ্ম থাকার ফলে প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছেও এই জায়গার গুরুত্ব অপরিসীম। পাহাড়ের নিচে ঝরনার মুখে একটি প্রাচীন এক পাথরের নরসিংহ মূর্তি দেখা যায়। সেই ঝরনার উৎস নাকি আজও অজানা।
ইতিহাস ও বৈচিত্র্যের শহর হল পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, যার আনাচে কানাচে রয়েছে সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ছোঁয়া। এই বাঁকুড়া জেলারই অন্তর্গত একটি বিখ্যাত পাহাড় হল শুশুনিয়া পাহাড়। স্থানীয় মতে এই পাহাড়টি দূর থেকে দেখলে অনেকটা শুশুকের মতন তাই এই পাহাড়ের নাম শুশুনিয়া পাহাড়। এই পাহাড় পূর্বঘাট পর্বতমালার অংশ। এর উচ্চতা ১২০০ ফুট। সবুজে ঢাকা এই পাহাড়ে বিভিন্ন ধরণের ঔষধি গাছ পাওয়া যায়। পাহাড়ের ভেতরে ঘন জঙ্গলে দেখা মেলে বিভিন্ন ধরনের পশুপাখির। তবে সবুজের জন্য শুধু না, এই পাহাড় পুরাতাত্ত্বিক ও জীবাশ্মক্ষেত্র হিসাবেও প্রত্নতত্ত্ব মহলে বিশেষ পরিচিত। এখানে সিংহ, জিরাফ, হায়না ও অন্যান্য অনেক জীবজন্তুর জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। তাছাড়াও অনেক প্রস্তরযুগীয় প্রত্নসামগ্রীও পাওয়া গিয়েছে এই অঞ্চলে। এখানে পাওয়া গিয়েছে বিভিন্ন প্রস্তরযুগীয় অস্ত্রের হদিশ।

এই পাহাড়েই অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম শিলালিপিটি। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীনকালে রাজা চন্দ্রবর্মণ বা চন্দ্রবর্মা এখানে একটি দুর্গ নির্মান করেন। রাজা চন্দ্রবর্মণের রাজধানী ছিল তৎকালীন পুষ্করণা, যা বর্তমানে পোখরনা বা পাখান্না নামে পরিচিত। মনে করা হয়, সমুদ্রগুপ্ত চন্দ্রবর্মণকে পরাজিত করে এই অঞ্চলটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে চন্দ্রবর্মণ পাহাড়ের বুকে লিখে রাখেন তাঁর শিলালিপি। মনে করা হয় এটিই বাংলার প্রাচীন শিলালিপি।পুরাতত্ত্ব বিভাগ থেকে এই শিলালিপি সংরক্ষিতও করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। এই শুশুনিয়া লিপির দু’টি অংশ। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘সমুদ্রগুপ্তের প্রশস্তি ও শুশুনিয়া লিপির চন্দ্রবর্মা এবং দিল্লির স্তম্ভলিপির চন্দ্র যে অভিন্ন, সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নাই।’’ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ‘‘দ্য ওল্ডেস্ট ব্রাহ্মি ইনস্ক্রিপশন ইন বেঙ্গল। ’’

শাল,মহুয়া, অর্জুন আর পলাশ ঘেরা জঙ্গল আর পাহাড় ঘেরা গ্রাম নিয়ে বাঁকুড়ার শুশুনিয়া। প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য শুশুনিয়া পাহাড় বিখ্যাত। পাহাড়ের একপারে বড়ু চণ্ডীদাসের জন্মভিটে ছাতনা। আর অন্যদিকে আদিবাসী ঘেরা গ্রাম। যাঁদের জীবন ও জীবিকাজুড়ে রয়েছে এই পাহাড়।স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এই পাহাড়ের কোলে বাস করেন স্বয়ং ভোলা মহেশ্বর। এখানে তাঁর একটি মন্দিরও রয়েছে। ফিবছর শ্রাবণ মাসে এখানে বসে শ্রাবণী মেলা। মহাদেবের মাথায় জল ঢালতে শুশুনিয়ার ঝরণা থেকে জল সংগ্রহ করতে ছুটে আসেন অগনিত ভক্ত। এক মাস ব্যাপি চলে মেলা। পাহাড়ে ওঠার মুখে একটি ঝর্ণা আছে। সেই ঝরনার মুখে একটি প্রাচীন পাথরের নরসিংহ মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী এই ঝর্ণায় স্নান করলে আপনার শরীর-মন দুই ভালো হয়ে যাবে, আবার এই ঝরনার জল পান করলে আপনার হজম এর সমস্ত সমস্যা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু এই জল কোথা থেকে আসছে সেটা কেউ জানে না। তবে এই জল এখানে অত্যন্ত পবিত্র মনে করা হয়। পাহাড়ের পাদদেশেই ঝরনার কাছে রয়েছে নৃসিংহদেবের একটি খোলা মন্দির। তবে অনেক ইতিহাসবিদগণ এটিকে বীরস্তম্ভ বলেই মনে করেন।
ট্রেনে আসতে হলে ছাতনা স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে বাস বা অটো করে একেবারে শুশুনিয়া পাহাড়। গাড়ি করে গেলে কলকাতা থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে রানিগঞ্জের আগে পাঞ্জাবি মোড় পরবে।সেখান থেকে বাম দিক নিয়ে মেজিয়া ব্রিজ পেরিয়ে মেজিয়া কুস্থালিয়া রোড হয়ে সোজা শুশুনিয়া পাহাড়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে।

এখানে থাকার জন্য বেশ কিছু হোটেল রয়েছে। এখানে টেন্ট করে থাকার ব্যবস্থাও আছে। পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠেছে ইকো পার্ক। এখানেও থাকার ব্যবস্থা আছে। কলকাতা বা সংলগ্ন অঞ্চলের থেকে মানুষেরা থাকার জন্য এলেও বাকুড়া বা সংলগ্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে এটি পিকনিক স্পট হিসেবে বেশি জনপ্রিয়।
এখানের পরিবেশ শহরের কোলাহল বা রোজকার ব্যস্ত জীবন থেকে মুক্তি এনে দেবে। এখানের শান্ত পরিবেশে আরাম করুন এবং ইতিহাসমাখা কাহিনী শুনতে শুনতে হারিয়ে ফেলতে পারেন নিজেকে। পাহাড়ের পাদদেশে বন্ধুদের সাথে বা পরিবারের সাথে পিকনিক করতে পারেন। তবে পিকনিক করতে গিয়ে পরিবেশ যাতে না নোংরা হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। সম্ভব হলে অবশ্যই পাহাড়ে উঠতে পারেন। এই পাহাড়ের টানেই ছুটে আসেন দেশ-বিদেশের পর্যটকরা। পাহাড়ে ওঠার জন্য কোন বাঁধানো বা পাকা রাস্তা নেই, পাথরের ওপর ধাপে ধাপে পা ফেলে আপনাকে পাহাড়ে উঠতে হবে। খুব সাবধানে কারণ এখানে ছোট ছোট নুড়ির সংখ্যা খুব বেশি, যার ফলে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। তবে মনে রাখবেন বৃদ্ধ বা শারীরিকভাবে দুর্বল ব্যক্তিরা না উঠলেই ভালো। এখানে পর্বতারোহণ কেন্দ্রও আছে। এখানে রক ক্লাইম্বিংয়ের প্রশিক্ষণ হয়। প্রচুর মানুষ আসে ট্রেকিং এর জন্য।

পাহাড়ের তিনটি ধাপ। প্রথম পাহাড় ওঠার পর উপর থেকে চারিদিকে সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। সঙ্গে পরিমাণমত জল বিস্কুট রাখবেন। খুব বেশি নেওয়ার দরকার নেই, কারণ প্রথম পাহাড়ে ওঠার কিছুটা ধাপে ধাপেই এখানে জল বিস্কুটের অস্থায়ী দোকান। তারপর দ্বিতীয় পাহাড়ে যাওয়ার জন্য রাস্তা চলে গেছে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। আপনি ইচ্ছা করলে সারা দিনই এই পাহাড়ে ট্রেকিং করতে পারবেন। তবে বিকালের আগে অবশ্যই নেমে আসবেন। প্রচুর গাছপালা ফুল এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই পাহাড়কে সুন্দর করে তুলেছে।
কাছাকাছি একটি রক্ষাকালী মন্দির আছে। এছাড়া গাড়ি ভাড়া করে আপনি কাছে বিহারীনাথ পাহাড় ঘুরে আসতে পারেন। তাছাড়াও গড়পঞ্চকোট, বিরিঞ্চিনাথের মন্দির, বরন্তি এইসব জায়গাও ঘুরে আসতে পারেন।
গরমকালে এই অঞ্চলে অত্যধিক গরম থাকে, সেই সময়ে একদমই যাওয়া উচিত নয়। বহু সংখ্যক পর্যটক এই অঞ্চলে শীতকালে এসে থাকে এই অঞ্চলের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে। তাছাড়া কাছাকাছি অঞ্চলে যারা থাকে তাদের কাছে পিকনিকের জন্য শীতকালের আদর্শ জায়গা এটা। বর্ষাকালেও অনেকে আসে। সেইসময় তুলনামূলকভাবে পর্যটকদের কম ভিড় থাকে, সঙ্গে চারিদিকের ঘন সবুজ বর্ষাকালে শুশুনিয়া পাহাড় এলাকাকে আরো মোহময়ী করে তোলে। তবে সেই সময়ে পাহাড়ে ওঠা বিপজ্জনক হতে পারে। শুশুনিয়া পাহাড়ে আসার সেরা সময় হল নভেম্বর থেকে মার্চ।

এখানের পাথরের শিল্প বিখ্যাত। পাহাড়ের পাথর নিয়ে এই এলাকায় গড়ে উঠেছে বিখ্যাত প্রস্তরশিল্প। যে শিল্পের কদর শুধু বাংলা নয়, তার খ্যাতি ছড়িয়ে রয়েছে গোটা দেশে। রয়েছে রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রস্তরশিল্পীও। তাদের থেকে কেনাকাটা করতে পারেন। পাথর কেটে সুন্দর বিভিন্ন মূর্তিগুলো সত্যিই অসাধারণ। পাথরের বাসন, শিলনোড়া এসব কিনতে পারেন। এছাড়াও পাথরের খেলনা বা অন্যান্য জিনিসও আছে। শুশুনিয়া মানেই প্রস্তরশিল্পীদের হাতের কাজ। তাই কোন না কোন পাথরের জিনিস কিনে আনতে পারে। তাছাড়াও বাঁকুড়ার হস্তশিল্প তো বিশ্ববিখ্যাত। বাঁকুড়ার ঘোড়ার মূর্তি তো একপ্রকার বাংলার আইকন বলা যায়। সেগুলোও এখানে পাওয়া যায়। কিনতে পারেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা সন্ধ্যের পরে লজের বাইরে বেরোতে নিষেধ করে। তাদের কথা মেনে চলুন। শুশুনিয়া পাহাড়ে ওঠার সময় হনুমানদের থেকে সাবধান থাকবেন। পাহাড়ে ওঠার মুখেই সাধারণত তারা থাকে। তবে মানুষজনকে খুব বিরক্ত করে না এবং পাহাড়ের ওপরেও তাদের উৎপাত নেই বললেই চলে।
ট্রিপ টিপস
- কিভাবে যাবেন – ট্রেনে আসতে হলে আপনাকে ছাতনা স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে বাস বা অটো করে একেবারে শুশুনিয়া পাহাড়। গাড়ি করে গেলে কলকাতা থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে রানিগঞ্জের আগে পাঞ্জাবি মোড় পড়বে।সেখান থেকে বাম দিক নিয়ে মেজিয়া ব্রিজ পেরিয়ে মেজিয়া কুস্থালিয়া রোড হয়ে সোজা শুশুনিয়া পাহাড়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে।
- কোথায় থাকবেন – মারুত বাহা ইকোপার্ক,শুশুনিয়া ইয়থ হোস্টেল, শুশুনিয়া ফরেস্ট কটেজ, শুভম রিসোর্ট, কামালাকান্ত গেস্ট হাউস, গ্রিন লজ।
- কি দেখবেন – শুশুনিয়া পাহাড় এবং আশেপাশের জায়গা, পাহাড়ে প্রাচীন শিলালিপি। তাছাড়া গাড়ি করে গড়পঞ্চকোট, বিরিঞ্চিনাথের মন্দির, বড়ন্তি এইসব জায়গা ঘুরে আসুন। পাহাড়ের পাদদেশে পিকনিক স্পট রয়েছে।
- কখন যাবেন – গরমকালে এই অঞ্চলে অত্যধিক গরম থাকে, সেই সময়ে না যাওয়ায় ভালো । শুশুনিয়া পাহাড়ে আসার সেরা সময় হল নভেম্বর থেকে মার্চ।
- সতর্কতা –
- স্থানীয় বাসিন্দারা সন্ধ্যের পরে লজের বাইরে বেরোতে নিষেধ করে। তাদের কথা মেনে চলুন।
- বৃদ্ধ বা শারীরিকভাবে দুর্বল ব্যক্তিরা না উঠলেই ভালো।
- খুব সাবধানে আপনাকে পাহাড়ে উঠতে হবে কারণ এখানে ছোট ছোট নুড়ির সংখ্যা খুব বেশি, যার ফলে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে।
- পিকনিক করতে গিয়ে পরিবেশ যাতে না নোংরা হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
আমরা আন্তরিক দুঃখিত। একটু তাড়াতাড়িতে প্রকাশ করতে গিয়ে এই লেখাটিতে বেশ কিছু ভুল আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। আমরা সেগুলি সংশোধন করে নিয়েছি। কিছু লেখায় অসাবধানতাবশত ভুল হয়ে থাকে, তার জন্য আমারা ক্ষমাপ্রার্থী। তবে ধরিয়ে দিলে আমরা অবশ্যই ঠিক করে নেব।
আবার বলছি, দয়া করে শুদ্ধ বানান লেখার দিকটা দেখুন।