বিহারীলাল চক্রবর্তী

বিহারীলাল চক্রবর্তী

বাংলা গীতিকাব্যের ধারার প্রথম পথিক বিহারীলাল চক্রবর্তী (Biharilal Chakraborty)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘ভোরের পাখি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেনের পরে বাংলা আখ্যানকাব্যের ধারাকে রুদ্ধ করে তন্ময় কবি বিহারীলাল গীতিকাব্যের মধুর রসের নতুন গতিপথ সঞ্চার করেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই বাংলা কবিতা বস্তু-তন্ময়তা থেকে আত্ম-তন্ময়তায় পর্যবসিত হয়। ইংরেজি সাহিত্যে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস’-এর মত বিহারীলালের কবিতাও বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগ সূচিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথের কাব্যগুরু হিসেবে তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ‘সারদামঙ্গল’ কাব্যের জন্য বিহারীলাল চক্রবর্তী আজও সমানভাবে স্মরণীয়। তাছাড়া তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘স্বপ্নদর্শন’, ‘বঙ্গসুন্দরী’, ‘সঙ্গীত শতক’, ‘নিসর্গ সন্দর্শন’, ‘সাধের আসন’, ‘প্রেম প্রবাহিনী’ ইত্যাদি।

১৮৩৫ সালের ২১ মে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে কলকাতার জোড়াবাগানে বিহারীলাল চক্রবর্তীর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম দীননাথ চক্রবর্তী। চার বছর বয়সেই বিহারীলাল তাঁর মাকে হারান। ছোটবেলা থেকেই কবিগান ও পাঁচালী ভালবাসতেন বিহারীলাল। পরবর্তীকালে গান লেখার মধ্য দিয়েই কাব্যসাধনার জগতে প্রথম হাতেখড়ি হয় তাঁর। পরবর্তীকালে উনিশ বছর বয়সে অভয়া দেবীর সঙ্গে বিহারীলালের বিবাহ হয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই অভয়া দেবীর মৃত্যু হয়।

স্কুল, কলেজে বেশি পড়াশোনা করেননি তিনি। বরং নিজের বাড়িতেই শৈশবকালে সংস্কৃত ভাষা শেখেন বিহারীলাল চক্রবর্তী এবং পরে সংস্কৃত কলেজে পড়াকালীন ‘মুগ্ধবোধ’ অধ্যয়ন করেন তিনি। তাছাড়া বাড়িতেই ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্য পড়ার সুযোগ ঘটেছিল তাঁর। সংস্কৃত কলেজে মোট তিন বছর পড়াশোনা করেছিলেন তিনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

খুব ছোট বয়স থেকেই কবিতা লিখতেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। পরবর্তীকালে ‘পূর্ণিমা’, ‘সাহিত্য-সংক্রান্তি’, ‘অবোধবন্ধু’ ইত্যাদি সাময়িক পত্রিকাতে তাঁর লেখা সেইসব কবিতাগুলি প্রকাশিত হত। বন্ধু কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের সৌজন্যে তিনি ইংরেজি কাব্য সাহিত্যের শেলি, কীটস প্রমুখ কবিদের সাহিত্যকীর্তি সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন এবং ইংরেজ কবিদের লেখনীর রস অনুধাবনে সমর্থ হন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ ছিল যা পরে আত্মীয়তার সম্পর্কেও পর্যবসিত হয়। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সঙ্গীত শতক’ কাব্যগ্রন্থ পাঠ করে মুগ্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করেন। এমনকি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও বিহারীলালের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন যে সেই সময় তাঁর কৈশোরকালে বাড়িতে বিহারীলাল চক্রবর্তীর কদর ছিল সমধিক। তাঁর নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীও বিহারীলালের কবিতার সমূহ প্রশংসা করতেন। বলা হয়, বৌঠানের মুখে বিহারীলালের কবিতার প্রশংসা শুনেই কিশোর রবীন্দ্রনাথ কবিতা রচনায় স্বতঃপ্রণোদিত হন। পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও বিহারীলাল চক্রবর্তী আত্মীয়তার বন্ধনে যুক্ত হন। রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাধনার গুরু ছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে মাধুরীলতার সঙ্গে বিহারীলালের পুত্র শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর বিবাহও হয়েছিল। ‘সারদামঙ্গল’ ও ‘সাধের আসন’ বিহারীলালের কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যমণিস্বরূপ। তবে এই দুটি কাব্য তাঁর কবি জীবনের একেবারে শেষ দিকের রচনা। রচনাকালের ক্রমানুসারে একেবারে প্রাথমিক পর্বে রচিত তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ হল ‘বন্ধু-বিয়োগ’ এবং ‘প্রেম-প্রবাহিনী’। যদিও তারও আগে বিহারীলাল লিখেছেন ‘স্বপ্নদর্শন’ (১৮৫৮), ‘সঙ্গীত শতক’ (১৮৬২) এবং ‘বঙ্গসুন্দরী’ (১৮৭০)। স্বপ্নদর্শন আদপে একটি গদ্য রচনা যা মোট ১৮টি অনুচ্ছেদে বিভক্ত। ‘বঙ্গসুন্দরী’ কাব্যে কবি বিহারীলাল আটজন বঙ্গনারীর বর্ণনা দিয়েছেন যারা কখনও কান্তামূর্তি, আবার কখনও জননীমূর্তি ধারণ করেন। এই কাব্যের মোট দশটি সর্গ যার প্রথম সর্গ ‘উপহার’-এ একজন প্রকৃত রোমান্টিক কবির মতই অতৃপ্ত কবির আর্তনাদ ধ্বনিত হয় যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘রোমান্টিক অ্যাগোনি’ (Romantic Agony)। এই কাব্যের মধ্যে সমালোচকেরা ফরাসি দার্শনিক কান্টের প্রভাব খুঁজে পেয়েছেন। ‘নিসর্গ সন্দর্শন’ কাব্যে বিহারীলালের প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতার প্রকাশ দেখা যায়, প্রকৃতি-রমণীর সঙ্গে প্রণয়ের কথা তিনি এই কাব্যে স্বীকার করেছেন। এই কাব্যের ‘সমুদ্র দর্শন’, ‘নভোমণ্ডল’, ‘ঝটিকা-সম্ভোগ’ ইত্যাদি কবিতায় তাঁর এই প্রকৃতি-প্রীতির পরিচয় মেলে। ‘ঝটিকা সম্ভোগ’ কবিতার শেষ তিনটি সর্গে এক অপরূপ ঝড়ের বর্ণনা দিয়েছেন কবি। ১২৭৪ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে বাংলার উপর দিয়ে যে প্রবল ঘূর্ণিঝড় বয়ে গিয়েছিল, তারই কাব্যিক বিবরণ পাওয়া যায় এই অংশে যা ‘নিসর্গ সন্দর্শন’ কাব্যের অন্যতম সম্পদ। আবার ‘সঙ্গীত শতক’ কাব্যেও বিহারীলাল চক্রবর্তী তাঁর নিসর্গচেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। মোট ১০১টি গানের সংকলন হল ‘সঙ্গীত শতক’ যার মধ্যে বেশিরভাগ গানই আয়তনে অনেকটাই দীর্ঘ। তাঁর কাব্যে সঙ্গীতময়তা ও আত্মভাবের উদ্বোধন এক অনিবার্য বৈশিষ্ট্য। ১৮৭০ সালে প্রকাশ পায় বিহারীলাল চক্রবর্তীর লেখা ‘বন্ধু বিয়োগ’ কাব্যটি যেখানে মোট চারটি সর্গে কবির অন্তরঙ্গ তিন বন্ধু পূর্ণচন্দ্র, কৈলাস ও বিজয় এবং মর্মসহচরী সরলাদেবীর উদ্দেশে ছন্দোবদ্ধভাবে স্মৃতি তর্পণ করেছেন কবি। স্ত্রী-বিয়োগের যন্ত্রণা, বন্ধুর সঙ্গে নিবিড় অন্তরঙ্গ মুহূর্তের উচ্ছ্বাস ফুটে উঠেছে এই কাব্যে। একই বছর প্রকাশিত হয়ে পাঁচ সর্গে বিন্যস্ত কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেম-প্রবাহিনী’। ‘Fraility, thy name is woman’ শেক্সপীয়রের এই উক্তির মধ্য দিয়ে এই কাব্যের প্রথম সর্গের সূচনা হয়েছে। প্রথম প্রেমের অনুরাগ ও উচ্ছ্বাস, মাদকতাহীন ক্রমপরিণতি এবং নানাবিধ দুঃখ-ভারাতুর অভিজ্ঞতার বর্ণনা এই কাব্যের প্রধান বিষয়।

বিহারীলাল চক্রবর্তী বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর ‘সারদামঙ্গল’ কাব্যের জন্য। এই কাব্যের পাঁচটি সর্গে সারদার সঙ্গে কবির বিরহ-মিলনের চিত্র এঁকেছেন কবি। এই কাব্যে কবির রোমান্টিক দৃষ্টি, লিরিক্যাল ভাবোচ্ছ্বাস আর মরমিয়া চেতনার সুনিপুণ মেলবন্ধন ঘটেছে। দেবী সারদার ত্রিকালের ত্রিবিধ মূর্তিকে উপলব্ধি করে ‘ত্রিবিধ বিরহে উন্মত্তবৎ’ অবস্থায় এই কাব্য রচনা করেছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। কাব্যের ভূমিকায় বিহারীলাল বলেছেন যে, কোনও এক মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমীর রাত্রে তিনি একা বাগেশ্রী রাগিনীতে গান গাইতে গাইতে এই ত্রিবিধ মূর্তিকে উপলব্ধি করেন। ত্রিকাল অর্থাৎ সভ্যতার উষালগ্ন, বাল্মীকির কাল এবং কালিদাসের কাল। দেবী সারদা এই কাব্যে কখনও কবির প্রিয়া, কখনও বরাভয়দাত্রী জননী, কখনও স্নেহলোভা কন্যা, কখনও আবার এই জগতের সৌন্দর্যের উৎস, কবির কাব্য-প্রেরণা। সারদা একদিকে কবির মানস-মরালী আবার অন্যদিকে বিশ্ব-সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কাব্যে কবি কখনও সারদার বরাভয়মূর্তি দেখেন, কখনও দেখেন সংহারমূর্তি, কখনও আবার বিষাদিনী সারদার দুঃখে বিহারীলাল অশ্রুপাত করেন কিংবা কখনও সংশয়ে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন কবি। সকল সৃষ্টি ও সকল ধ্বংসের মূল এই দেবী সারদা। বিহারীলালের ‘সারদামঙ্গল’ পাঠ করে মুগ্ধ হয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী কবিকে নিজে হাতে বোনা একটি আসন উপহার দেন যাতে সারদামঙ্গলের একটি অংশ উৎকলিত ছিল। কাদম্বরী দেবীর অকাল প্রয়াণের পর তাঁর স্মরণেই বিহারীলাল চক্রবর্তী রচনা করেন ‘সাধের আসন’ (১৮৮৯) কাব্যটি।

তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘মায়াদেবী’ (১৮৮২), ‘শরতকাল’ (১৮৯২), ‘ধূমকেতু’ (১৮৮২), ‘দেবরাণী’ (১৮৮২), ‘বাউল বিংশতি’ (১৮৮৭) এবং ‘নিসর্গ সঙ্গীত’ (১৮৮১)। তাঁর বেশিরভাগ রচনাই ‘জন্মভূমি’, ‘আর্যদর্শন’, ‘ভারতী’, ‘কল্পনা’, ‘মালঞ্চ’, ‘প্রদীপ’, ‘বান্ধব’ ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘সাহিত্য সাধক চরিতমালা’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা বিহারীলাল চক্রবর্তীর দুটি চিঠি সন্নিবিষ্ট করেছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম বিশুদ্ধ গীতিকবিতার ধারাকে নতুন খাতে প্রবাহিত করেন।

১৮৯৪ সালের ২৪ মে বিহারীলাল চক্রবর্তীর মৃত্যু হয়।       

তথ্যসূত্র


  1. অঞ্জলি বসু ও সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত (সম্পা:), 'সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান', সাহিত্য সংসদ, মে ১৯৬১, পৃষ্ঠা ৩৫৬
  2. তারাপদ মুখোপাধ্যায়, 'আধুনিক বাংলা কাব্য', মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি.', বৈশাখ ১৪২১, পৃষ্ঠা ৯১-১০৮
  3. https://en.wikipedia.org/
  4. https://www.dailyinqilab.com/

 

4 comments

আপনার মতামত জানান