হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

স্বমহিমায় রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের পূর্বে বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভান্ডার যাদেঁর অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ এবং কিঞ্চিৎ পরিণত হয়ে উঠেছিল, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (Hemchandra Bandyopadhay)। বাংলা কাব্যসাহিত্যের বীরযুগের অন্যতম প্রধান কবি তিনি। মহাকবি মাইকেল মধুসূদনের সমসময়ে দাঁড়িয়ে নিজের লেখনীর স্বাতন্ত্র্যেই মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। ব্রিটিশের অত্যাচার যখন চরমে এবং জাতীয়তাবাদের উত্থান যখন ঘটছে সারা ভারতবর্ষে, হেমচন্দ্রের কবিতাও সেই মুহূর্তে বঙ্গবাসী তথা সমগ্র দেশবাসীকে জাগরণের আহ্বান জানিয়েছিল। এমনকি এইরকম দেশাত্মবোধক এবং ব্রিটিশ বিরোধী কবিতা লেখার জন্য ইংরেজ শাসনের রোষানলেও পড়তে হয়েছিল তাঁর কবিতার প্রকাশককে। উল্লেখ্য যে, তাঁর ‘ভারত সঙ্গীত’ কবিতাটিকে একসময় বাংলার জাতীয় গান হিসেবেও বিবেচনা করা হয়েছিল। শেক্সপীয়রের লেখাও অনুবাদ করেছিলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। নারী এবং বিধবাদের উপর অত্যাচার, অনাচার নিয়েও তাঁর কলম সরব হয়ে উঠেছিল। চিরকাল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করতেন হেমচন্দ্র। তাঁর বিখ্যাত একটি রচনা হল ‘বৃত্রসংহার’ কাব্য।

১৮৩৮ সালের ১৭ এপ্রিল ব্রিটিশ শাসনাধীন হুগলী জেলার রাজবলহাটের কাছে গুলিটা গ্রামে মাতামহের বাড়িতে এক কুলীন বংশে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল হুগলীর উত্তরপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবা কৈলাসচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (Kailashchandra Bandyopadhyay) শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই হিসেবে থাকতেন। কৈলাসচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র, কিন্তু কৌলিন্যের মানদণ্ডে তিনি বিবাহ করেছিলেন কলকাতার আদালতের মোক্তার রাজচন্দ্র চক্রবর্তীর কন্যা আনন্দময়ীকে এবং বিবাহের পর থেকে তিনি শ্বশুরবাড়িতেই বসবাস করতে থাকেন। তেমন কোনো কাজ করতেন না কৈলাসচন্দ্র এবং বলা যায় শ্বশুর রাজচন্দ্রের উপরেই একপ্রকার নির্ভরশীল ছিলেন। কৈলাসচন্দ্র এবং আনন্দময়ীর ছয় সন্তানের (চার পুত্র এবং দুই কন্যা) মধ্যে হেমচন্দ্র ছিলেন সবার বড়। তাঁর অনুজ ঈশানচন্দ্রও ছিলেন একজন প্রথিতযশা কবি এবং আইনজীবী। ১৮৫৫ সালে হেমচন্দ্র ভবানীপুরের বাসিন্দা কালীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা কামিনী দেবীর (Kamini Devi) সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

প্রথম নয় বছর হেমচন্দ্র গুলিটা গ্রামের পাঠশালাতেই অধ্যয়ন করেছিলেন। তারপর মাতামহ রাজচন্দ্র চক্রবর্তী তাঁকে খিদিরপুরের বাসভবনে নিয়ে আসেন এবং তাঁরই সহায়তায় হেমচন্দ্র খিদিরপুর বাংলা স্কুলে ভর্তি হতে পেরেছিলেন পড়াশোনার জন্য। ছোট থেকেই ধীর, স্থির, শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন হেমচন্দ্র এবং পড়াশোনায় গভীর মনোযোগী ছাত্র ছিলেন তিনি। খিদিরপুরের স্কুলে বাংলা ও শুভঙ্করী শিখে যখন উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি, তখনই অকস্মাৎ রাজচন্দ্রের মৃত্যু হলে আর্থিক সঙ্কটে পড়ে তাঁর পরিবার। ফলে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় হেমচন্দ্রের। এই সময় সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ বিখ্যাত প্রসন্নকুমার ঠাকুরের সহায়তায় তাঁরই আশ্রয়ে থেকে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়েছিল হেমচন্দ্রের। ১৮৫৩ সালে এই প্রসন্নকুমার ঠাকুরই তাঁকে তৎকালীন কলকাতার প্রখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিন্দু কলেজের সিনিয়র স্কুল বিভাগের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। হেমচন্দ্র একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৮৫৫ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন তিনি এবং তার ফলে মাসিক দশ টাকা বৃত্তিও লাভ করেছিলেন। ১৮৫৭ সালে সিনিয়র স্কলারশিপের পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাসিক পঁচিশ টাকা বৃত্তি লাভ করেন এবারে। ১৮৫৭ সালেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেবছর প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি লাভ করেন তিনি। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। কিন্তু চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে বৃত্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় লেখাপড়ার খরচ যোগানো মুশকিল হয়ে পড়ে তাঁর পক্ষে। ফলত, পড়াশোনা বন্ধ করে চাকরি করতে ঢোকেন হেমচন্দ্র। যদিও পরবর্তীকালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে পেরেছিলেন তিনি।

স্নাতক হওয়ার আগে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৫৯ সালে মিলিটারি অডিটর জেনারেলের অফিসে ৩৫ টাকা বেতনের কেরানির চাকরি করেছিলেন অল্প সময়ের জন্য। সেবছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয়বারের বি.এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন তিনি এবং এতই মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি যে সেই পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। ১৮৫৯ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন হেমচন্দ্র এবং কলকাতা ট্রেনিং স্কুলে হেডমাস্টার পদে যোগদান করেন। তাঁর বেতন ছিল মাসিক ৫০ টাকা। খিদিরপুর থেকে প্রতিদিন যাতায়াতে অসুবিধা হত বলে এসময় কলকাতায় একটি মেসে থাকতে শুরু করেছিলেন তিনি। এরপর আইনশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৮৬০ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এল পরীক্ষা দেন তিনি, কিন্তু কৃতকার্য না হওয়ায় কেবল এল.এল ডিগ্রি লাভ করতে সক্ষম হন। সেটুকুই আপাতত সম্বল করে শিক্ষকতার কাজ ছেড়ে রমাপ্রসাদের উপদেশে মুন্সেফী পদের জন্য গভর্নমেন্টের নিকট আবেদন করেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তা মঞ্জুরও হয়ে যায়। একশ টাকা মাসিক বেতনে প্রথমে শ্রীরামপুরে এবং পরে হাবড়ায় মুনসেফ পদে কাজ করবার সুযোগ পান তিনি। সে চাকরি অল্পকাল করে ১৮৬১ সালের ১৯ মার্চ কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যোগ দেন তিনি। ১৮৬৬ সালে আবারও তিনি বি.এল-এর পরীক্ষায় বসেন এবং এবারের প্রচেষ্টায় সফল হন। ১৮৯০ সালে সরকারি উকিল হিসেবে তাঁকে নিযুক্ত করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ওকালতিতে এতই নামডাক হয়েছিল তাঁর যে, সরকারি উকিল সুবিখ্যাত অন্নদাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর গ্রহণ করলে তাঁর স্থানে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি সিনিয়র প্লীডারের পদে মনোনীত হয়েছিলেন।

আইন ব্যবসার পাশাপাশি কবিতা লেখার চর্চা চালিয়ে গিয়েছেন হেমচন্দ্র। আসলে স্বভাবে তিনি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ কবি। যে বছর কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন তিনি, সে বছরই অর্থাৎ ১৮৬১ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘চিন্তাতরঙ্গিনী’ প্রকাশিত হয়। সেসময় মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ও প্রকাশিত হয়েছিল। আচার্য্য কৃষ্ণকমলের চেষ্টায় ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ‘চিন্তাতরঙ্গিনী’ বিশ্ববিদ্যালয়ের এল.এ পরীক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। বাংলা মহাকাব্যের ধারায় তাঁর স্বদেশপ্রেমমূলক রচনাগুলি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ বলে বিবেচিত হয়। ১৮৬৪ সালে প্রকাশিত তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বীরবাহু কাব্য’-এ দেশপ্রেমের অঙ্কুর ফুটে উঠতে লক্ষ্য করা যায় এবং ছন্দও অনেকটা স্বচ্ছন্দ গতি লাভ করে। কবিতা লেখার পাশাপাশি হাইকোর্টে আইনচর্চা অব্যহত ছিল তাঁর। রমাপ্রসাদ রায় ছিলেন হেমচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু রমাপ্রসাদের অকস্মাৎ মৃত্যু ঘটলে একজন শ্বেতাঙ্গ উকিলের সহকারী হিসেবে কাজ করতে থাকেন হেমচন্দ্র। একদিন একটি মোকদ্দমায় শ্বেতাঙ্গ উকিল অনুপস্থিত থাকায় তাঁর স্থলে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মোকদ্দমা লড়েন এবং নিপুণ যুক্তির জালবিস্তার করে নিজের মন্তব্য বিচারকের সামনে উপস্থাপিত করে জয়লাভও করেন। এরপর থেকেই হাইকোর্টে তাঁর পসার বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই প্রতিপত্তির সময়ে হেমচন্দ্রের পিতৃবিয়োগ ঘটে। বাবাকে হারিয়ে অত্যন্ত অধীর হয়ে পড়েন তিনি এবং এসময় বিভিন্ন তীর্থে ভ্রমণ করতে থাকেন। গয়াতে পিতৃশ্রাদ্ধও সম্পন্ন করেন, কিন্তু এই ঘটনাটিকে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন কুসংস্কার বলে নিন্দা করে প্রকাশ্যভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। এরই প্রতিবাদে হেমচন্দ্র ‘ব্রাহমিজ থেয়িজম ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন এবং ১৮৬৯ সালে এটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছিল।

ভূদেব মুখোপাধ্যায় তখন ছিলেন ‘এডুকেশন গেজেট’ পত্রিকার সম্পাদক। সেই পত্রিকায় তখন প্রায় নিয়মিতই হেমচন্দ্রের কবিতা প্রকাশিত হত। হেমচন্দ্রের সবচেয়ে বিখ্যাত দুই দেশাত্মবোধক কবিতা ‘ভারত-বিলাপ’ এবং ‘ভারত সঙ্গীত’ ১৮৭০ সালে উক্ত পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়েছিল। এই ‘ভারত সঙ্গীত’ কবিতাটি সেসময় গোটা ভারতবাসীর হৃদয়কে তুমুলভাবে আলোড়িত করে তুলেছিল। ব্রিটিশের অত্যাচারের শৃঙ্খল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি এই রচনার মাধ্যমে। এই কবিতা এমনই মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করেছিল দেশবাসীর মনে যে, পত্রিকার সম্পাদক ভূদেব মুখোপাধ্যায়কে ইংরেজদের রোষানলে পড়তে হয়েছিল। যদিও ভূদেববাবু সন্তোষজনক কৈফিয়ত দিয়ে সরকারকে শান্ত করেছিলেন। কবিতাটিকে বাংলার জাতীয় গান হিসেবেও বিবেচনা করা হয়েছিল। তাঁর এমনই শক্তিশালী কয়েকটি খণ্ড কবিতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘কালচক্র’, ‘রিপন উৎসব’, ‘ভারতের নিদ্রাভঙ্গ’ ‘গঙ্গার উৎপত্তি’, ‘পদ্মের মৃণাল’, ‘ভারত কাহিনী’, ‘অশোকতরু’ ইত্যাদি। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নারীদের সমস্যা, বিধবা রমণীদের উপর অনাচার নিয়েও কবিতা রচনা করেছিলেন। রমণীদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে রচিত তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা হল ‘কুলীন কন্যাগণের আক্ষেপ’। সাপ্তাহিক এবং মাসিক পত্রে প্রকাশিত তাঁর বেশ কিছু খণ্ড কবিতা নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ পেয়েছিল ‘কবিতাবলী’ নামে মোট দুটি খণ্ডে। প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭০ সালে এবং দ্বিতীয়ভাগের প্রকাশকাল ১৮৮০। ১৮৭২ সালে যখন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়, তখন থেকেই হেমচন্দ্র ছিলেন সেই পত্রিকার লেখক। প্রায় চার বছর নিয়মিতভাবে তাঁর লেখা ‘বঙ্গদর্শন’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে মোট এগারোটি কবিতা এবং একটি প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছিল।

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং শ্রেষ্ঠ রচনাটি হল ‘বৃত্রসংহার’ কাব্য। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র টীকা রচনাকালে হেমচন্দ্রের বাসনা হয়েছিল তেমনই একখানা মহাকাব্যধর্মী সাহিত্য সৃষ্টি করবার। মহাভারতে বৃত্রসংহারের উপাখ্যান খুব সংক্ষেপেই বর্ণিত রয়েছে। সেই আখ্যানকে অবলম্বন করেই অবশেষে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করেছিলেন ‘বৃত্রসংহার’ কাব্য। এই মহাকাব্যের প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ সালে এবং দ্বিতীয় খণ্ড বের হয় ১৮৭৭ সালে। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, চরিত্র সৃষ্টিতে হেমচন্দ্র ভীষণভাবে মাইকেলকে অনুসরণ করেছিলেন।মেঘনাদবধ এবং বৃত্রসংহারের চরিত্রদের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলে গভীর সাদৃশ্য পাওয়া যাবে। মাইকেলের ব্যবহৃত অনেক শব্দও হুবহু অনুকরণ করেছিলেন তিনি। তাছাড়া মহাকাব্যের গাম্ভীর্য তিনি ধরে রাখতে পারেননি। কিন্তু তরুণ রবীন্দ্রনাথ বৃত্রসংহারের প্রশংসা করেছিলেন। আসলে একটা পৌরাণিক আবহের আড়ালে যুগে যুগে অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে ন্যায়ের বিজয়কেই হেমচন্দ্র তুলে ধরেছিলেন তাঁর কাব্যে।

হেমচন্দ্রের আরও কয়েকটি জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ হল ‘আশাকানন’ (১৮৭৬), ‘ছায়াময়ী’ (১৮৮০), ‘দশমহাবিদ্যা’ (১৮৮২)।  ‘ছায়াময়ী’ দান্তের ‘দিভিনা কোম্মেদিয়া’ অবলম্বনে রচিত একটি রূপককাব্য। ‘দশমহাবিদ্যা’ পৌরাণিক চণ্ডীতত্ত্বের একটি আধুনিক উপস্থাপনা। তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থটি হল ‘চিত্তবিকাশ’ (১৮৯৮)। দীর্ঘ বর্ণনামূলক রচনায় হেমচন্দ্র ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আবার ঈশ্বর গুপ্তের ভাবধারা অনুসরণ করে আবেগব্যাকুল বাংলা কবিতায় তীক্ষ্ণ রঙ্গব্যঙ্গের আমদানি করেছিলেন তিনি। রাজনৈতিক ভন্ডামির প্রতি তিনি হেনেছেন তীব্র কশাঘাত। তাঁর লেখায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি খুঁজে পাওয়া যায় ছত্রে ছত্রে। বাংলাকে তিনি এমন একটি ভূমি হিসেবে কল্পনা করেছিলেন যেখানে হিন্দু ও মুসলমান একসঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে। ভারতবর্ষকে সম্ভবত তিনিই প্রথম অখণ্ড, স্বাধীন ও সমন্বিত একটি ভূমি হিসেবে কল্পনা করেছিলেন।

হেমচন্দ্র শেক্সপীয়রের রচনাও অনুবাদ করেছিলেন। শেক্সপীয়রের ‘টেমপেস্ট’ নাটক অবলম্বনে তিনি রচনা করেছিলেন ‘নলিনী-বসন্ত’ (১৮৬৮), এবং ‘রোমিও-জুলিয়েট’কে বাংলায় ‘রোমিও-জুলিয়ত’ (১৮৯৫) নাম দিয়েই অনুবাদ করেন। শেষজীবনে হেমচন্দ্র দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অন্ধ হয়ে পড়েছিলেন এবং চরম দারিদ্র্যের সম্মুখীন হয়ে রাজানুগ্রহ স্বীকার করতে বাধ্য হন। সরকারের দেওয়া কয়েকটি মুদ্রাই ছিল শেষজীবনে তাঁর অবলম্বন।

অবশেষে ১৯০৩ সালের ২৪ মে খিদিরপুরে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।

তথ্যসূত্র


  1. 'বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান', শামসুজ্জামান খান, সেলিনা হোসেন, আজহার ইসলাম, নূরুল ইসলাম, অপরেশ কুমার ব্যানার্জী, আমিনুর রহমান সুলতান ও তপন বাগচী (সম্পা:), বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত তৃতীয় সংস্করণ, জুন ২০১১, পৃষ্ঠা ৬১৭
  2. 'ভারত-প্রতিভা' (প্রথম খণ্ড), সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (সম্পা:),  বসুমতী সাহিত্য মন্দির, ১৯১৩, পৃষ্ঠা ২৯৯-৩১২
  3. 'বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত',অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, ২০১২-১৩, পৃষ্ঠা ৩৪০-৩৪৫
  4. https://www.indianetzone.com/
  5. https://www.tutorialathome.in/

3 comments

আপনার মতামত জানান