বিমল ঘোষ (মৌমাছি)

বিমল ঘোষ

বাংলা সাহিত্যের এক উল্লেখযোগ্য শিশু সাহিত্যিক বিমল ঘোষ (Bimal Ghosh)। আপামর বাঙালি পাঠকদের কাছে তিনি মূলত ‘মৌমাছি’ ছদ্মনামেই বেশি পরিচিত। তাঁরই উদ্যোগে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র একটি ছোটদের দপ্তর হিসেবে চালু হয় ‘আনন্দমেলা’ বিভাগটি। ‘আকাশবাণী কলকাতা’র সঙ্গেও দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন তিনি। শিশুদের জন্য বহু গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখেছেন তিনি। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি ‘মণিমালা’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। ‘চেঙাবেঙা’, ‘কামাল পরদেশী’, ‘ইউরোপের অগ্নিকোণে’ ইত্যাদি বিখ্যাত সব বইয়ের লেখক স্বনামধন্য বিমল ঘোষ।

১৯১০ সালের ১৮ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বড়জোড়া ব্লকের অন্তর্গত বেলিয়াতোড়ে বিমল ঘোষের জন্ম হয়। তাঁর বাবা অনাদিপ্রসন্ন ঘোষ ছিলেন ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস’ সংস্থার কেমিস্ট এবং একইসঙ্গে তিনি জাতীয়তাবাদী আদর্শেও দীক্ষিত ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল ব্রজবালা দেবী।

কলকাতার নারকেলডাঙা জর্জ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন বিমল ঘোষ এবং তারপর গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে মুদ্রণ ও বিজ্ঞাপন বিষয়ে পড়াশোনা করেন তিনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ছাত্র থাকাকালীনই সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন বিমল ঘোষ। তারপরে ‘অ্যাডভান্স’ নামক একটি পত্রিকার বিজ্ঞাপন বিভাগে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। কিছুদিন এই সংস্থায় কাজ করার পর তিনি যোগ দেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। ১৯৪০ সালে তাঁরই উদ্যোগে আনন্দবাজার পত্রিকার ছোটদের বিভাগ হিসেবে চালু হয় ‘আনন্দমেলা’। প্রতি সোমবার আনন্দবাজারে এই ছোটদের বিভাগটি প্রকাশিত হত। গল্প, ছড়া, কবিতা, ছোটদের আঁকা ছবি, হাস্যকৌতুক, ধাঁধা ইত্যাদির পাশাপাশি আবশ্যিকভাবে প্রকাশিত হত ‘মৌমাছির চিঠি’। এই চিঠিতে বিমল ঘোষ ছোটদের জন্য নানাবিধ পরামর্শ ও উপদেশ দিতেন যা শিশু-কিশোরদের খুবই আকৃষ্ট করত। এই সময় থেকেই তিনি ‘মৌমাছি’ ছদ্মনামে লেখা শুরু করেন। এই আনন্দমেলার মাধ্যমেই শিশু ও কিশোরদের উপযোগী একটি সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি যার নাম দেন ‘মণিমেলা’। শুধু বাংলা নয়, বাংলার বাইরেও এই সংগঠনটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিহারের পাটনায় এর খ্যাতির কথাও শোনা যায়, এমনকি ভারতের বাইরেও ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছিল ‘মণিমেলা’র শাখা সংগঠন। তাঁর নিজের জন্মস্থান বেলিয়াতোড়েও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘মণিমেলা’ সংগঠনটি। ষোল বছরের নীচে সমস্ত শিশু-কিশোররা এই সংগঠনে যোগ দিতে পারত, তাদেরকেই মূলত ‘মণি’ বা রত্ন বলা হত। এই সংগঠনের প্রধান পরিচালক পরিচিত হতেন ‘মধ্যমণি’ নামে আর সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত বয়স্ক শুভানুধ্যায়ীদের বিমল ঘোষ নাম দিয়েছিলেন ‘মণিরক্ষক’ বা ‘মণিরক্ষিকা’ হিসেবে। বাঁকিপুরে ৫০-৬০ জন শিশু-কিশোরদের নিয়ে প্রথম একটি নাট্যাভিনয়ের মধ্য দিয়ে স্থাপিত হয়েছিল বাঁকিপুর মণিমেলা। তাছাড়া গর্দানিবাগে, মিঠাপুরেও তৈরি হয়েছিল এই সংগঠনটি।

ছোটদের জন্য অজস্র গল্প, উপন্যাস, নাটক,ছড়া লিখেছেন বিমল ঘোষ। ১৯৫৩ সালের ২৫ থেকে ৩০ জুলাই রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে তৃতীয় বিশ্বযুব কংগ্রেসে বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। এর আগে ১৯৪৫ সালে পৃথিবীর নানা দেশের গণতান্ত্রিক কিশোর ও যুব সংগঠনগুলিকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ডেমোক্রেটিক ইউথের আন্তর্জাতিক কমিটি। সেই সময় বিমল ঘোষের ‘মণিমেলা’ সংগঠনটিকেও আহ্বান জানানো হয়েছিল। বুখারেস্টে বক্তৃতা দিতে যাওয়ার সময় তাঁর বন্ধু রাধাকিশোর ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকার তৎকালীন ডিরেক্টর অশোককুমার সরকার, পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় মন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন প্রমুখরা খুবই সাহায্য করেছিলেন বিমল ঘোষকে। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল ড. হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়ও তাঁর সঙ্গে একটি প্রশংসাসূচক পরিচয়-পত্র লিখে পাঠিয়েছিলেন। বুখারেস্টে থাকার সময় পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড, ভিয়েনা ইত্যাদি জায়গা ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। একইসঙ্গে ওখান থেকেই বহু চিঠি লিখতেন বিমল ঘোষ, কিন্তু তার অধিকাংশই ভারতে পৌঁছায়নি। একমাত্র ভিয়েনা থেকে লেখা তাঁর একটিমাত্র চিঠি আনন্দবাজার পত্রিকার ‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ১৯৫৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তারিখে ছাপা হয়েছিল ‘কম্যুনিজমের স্বর্গে’ শিরোনামে। এই নিবন্ধ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্টরা বিমল ঘোষকে মার্কিন দালাল বলে ক্ষোভ উগড়ে দেন। কিন্তু আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষ এর প্রেক্ষিতে বিমল ঘোষের পূর্ব ইউরোপের দিনপঞ্জী ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৯৫৪ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত তাঁর এই পূর্ব ইউরোপের ভ্রমণকাহিনী রবিবাসরীয় বিভাগে ছাপা হয়েছিল। সেই সময় জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশে মার্কিন রুশ শক্তির পারস্পরিক ঠাণ্ডা লড়াইয়ের ফলে পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের বাসিন্দাদের দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করেছিলেন বিমল ঘোষ। পরবর্তীকালে তাঁর এই লেখাগুলি একত্রিত হয়ে ‘ইউরোপের অগ্নিকোণে’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এছাড়া ‘আকাশবাণী কলকাতা’ সংস্থার সঙ্গেও দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন তিনি।

এছাড়াও তাঁর অন্যতম বিখ্যাত রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে ‘কামাল পরদেশী’, ‘চেঙাবেঙা’ ইত্যাদি। ‘চেঙাবেঙা’ বইয়ের জন্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বিমল ঘোষ। তাঁর একটি অন্যতম জনপ্রিয় নাটক হল ‘মায়াময়ূর’।

১৯৮২ সালের ৭ মার্চ বিমল ঘোষের মৃত্যু হয়।

তথ্যসূত্র


  1. বিমল ঘোষ, 'ইউরোপের অগ্নিকোণে', মিত্র ও ঘোষ পাবলিশিং প্রা: লি:, ১৯৪৬, গোড়ার কথা
  2. https://www.anandabazar.com/
  3. https://www.anandabazar.com/
  4. https://www.chharpatra.com/

আপনার মতামত জানান