সববাংলায়

হো চি মিন

হো চি মিন( Ho Chi Minh) ছিলেন ভিয়েতনামের একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় তিনি আমৃত্যু ভিয়েতনামি কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। তিনি স্বাধীন ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং পরে রাষ্ট্রপতি হন। তিনি ‘ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব ভিয়েতনামের’ প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ছিলেন ভিয়েতনাম স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরোধা পুরুষ।

হো চি মিনের জীবনের প্রথম বছরগুলো  সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু জানা যায় না। তিনি প্রায় ৫০ থেকে ২০০ টি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। তাঁর জন্ম তারিখ, জন্মস্থান এবং অন্যান্য তথ্যগুলোর ব্যাপারে কমপক্ষে চারটি সরকারী জীবনীতে (official biography)পার্থক্য দেখা যায়। তবে ‘হো চি মিন’ বা ‘আঙ্কেল হো’ নামে তিনি বেশি পরিচিত।

১৮৯০ সালে ১৯ মে হো চি মিন তৎকালীন ফরাসি আশ্রিত রাজ্য আন্নামের নগেয়ান প্রদেশের হোয়াংটু গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও তাঁর শৈশব কাটে মামার বাড়ি কিম লিয়েন গ্রামে। তাঁর বাবা নগুয়েন সিন সাক ছিলেন ক্ষেতমজুর পরিবারের সন্তান। কিন্তু এই দাসত্বের জীবন সিন সাকের ভালো লাগত না। তাই পরবর্তীকালে পড়াশুনো করে একজন শিক্ষক হয়ে ওঠেন। হো চি মিনের মায়ের নাম ছিল হোয়াং আই লোয়ান। তিনিও যথেষ্ট পরিশ্রমী ছিলেন। হো চি মিনের যখন ১০ বছর বয়স তখন তাঁর বাবা গ্রাম ছেড়ে শিক্ষকতাকে পেশা করে  হুয়েং শহরে চলে আসেন। সংসার চালাতে গিয়ে হো চি মিনের বাবা এবং মা দুজনেই প্রচণ্ড পরিশ্রম করতেন। এক সময় অসুস্থ হয়ে তাঁর মা‌ মারা যান। এই ঘটনায় মানসিকভাবে তিনি প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিলেন। এই সময় তাঁকে আবার গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই গ্রামেই চলতে থাকে তাঁর প্রাথমিক পড়াশুনা।

১৯০৪ সালে তরুণ হো চি মিন দ্বিতীয়বার হুয়ে়ং শহরে এলেন। ১৯০৭ সালে তিনি  কৃতিত্বের সঙ্গে বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেন। এই সময় ভিয়েতনামের চারিদিকে চলছিল ফরাসি বিরোধী বিক্ষোভ। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি ফরাসিদের দেশের মাটি থেকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ করা। ভিয়েতনামীদের পরাধীনতা এবং ফরাসিদের ঔদ্ধত্য তাঁর বিপ্লবী চেতনাকে উজ্জীবিত করেছিল।হো চি মিন এই সময় এক গোপন বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি প্রচারপত্র বিলি করতেন এবং ভিয়েতনামের মানুষজনকে বোঝাতেন অত্যাচারী ফরাসিদের দেশ থেকে বিতাড়িত না করলে দেশে শান্তি আসবে না।ফলে ফরাসি গুপ্তচর বাহিনীর নজরে পড়ে যান তিনি। হো চি মিন ফরাসি গুপ্তচর বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে প্যারিস যাত্রা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি কিছুদিন ফ্রান্সে বসবাস করেন। ফ্রান্সে বসবাসকালে তিনি মার্কসবাদ ,লেনিনবাদের মতাদর্শে আকৃষ্ট হন। পরে বাস্তব অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝতে পারেন যে, শুধুমাত্র সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদই সমস্ত বিশ্বের নিপীড়িত জাতি এবং শ্রমজীবী জনগণকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতে পারে। তিনি সুদীর্ঘকাল এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন । কারণ এই সময় তিনি জাহাজের রসুইখানায় বাবুর্চির সহকারি হিসেবে কাজ করতেন।কাজের ফাঁকে ফাঁকে জাহাজের সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে মিশতেন যাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হতে পারেন। তিনি ফরাসি ,ইংলিশ, রাশিয়ান, ম্যান্ডারিন  এবং ভিয়েতনামি ভাষা জানতেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন ।এই সংবাদপত্রগুলি তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারে ব্যবহৃত হত।

আরও পড়ুন:  অক্ষয়কুমার বড়াল

১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির ও মিত্রবাহিনীর মধ্যে ‘ভার্সাই চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। এই সময় ভিয়েতনামের জনগণের পক্ষ থেকে ‘জাতিসমূহের অধিকার’ শিরোনামে ‘আট দফা দাবি’ পেশ করেন তিনি। তাঁর উপস্থাপিত মূল বিষয়গুলির মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি, ফরাসি ও ভিয়েতনামীদের মধ্যে সমান অধিকার, জবরদস্তিমূলক শ্রম বিলোপ, লবণ করের বিলোপ, জবরদস্তিমূলক মদ্যপান ব্যবস্থা বাতিল প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯২০ সালের ২৫ ডিসেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ দিনের প্যারিস সফরে যান।সেখানে ‘ফরাসি সোস্যালিস্ট পার্টি’র ১৮৩ তম অধিবেশনে ভিয়েতনামের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন ভিয়েতনামের ওপর ফরাসিদের অত্যাচারের কাহিনী। হো চি মিন বলেছিলেন, তাঁর জন্মভূমিতে যে ঘৃণ্য হিংস্রতা ও অবিচার হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই তিনি সেখানে উপস্থিত হয়েছেন ।ধণতন্ত্রিক দেশ হিসেবে ফরাসিরা তাদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করছে, চলছে অবাধ লুঠপাট, হত্যাকাণ্ড এমনকি বিষপ্রয়োগও। তিনি আরো বলেছিলেন, এই সীমিত সময়ের মধ্যে তাঁর পক্ষে এই অবর্ণনীয় অত্যাচারের ইতিহাস তুলে ধরা সম্ভব নয়। তিনি অনুভব করেছিলেন, ভিয়েতনামে যথেষ্ট পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ এবং মানবসম্পদ রয়েছে, কিন্তু একইসঙ্গে  প্রয়োজনীয় সংগঠন এবং দক্ষ সংগঠকের অভাবও রয়েছে।

হো চি মিন ১৯২৬ সালে জেং জুয়েমিকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পান। ১৯৩০ সালে বিপ্লবী কমিউনিষ্ট আন্দোলনের সূত্রপাত হয় । এই আন্দোলনের নেতা ছিলেন হো চি মিন। ১৯৩৫ সালে মস্কোতে সপ্তম কংগ্রেস বিশ্ব সম্মেলনে হো চি মিন ‘ইন্দো চাইনিজ কমিউনিস্ট  পার্টি’র‌ একজন বিশেষ অতিথি রূপে যোগদান করেন। এখানে তাঁর দলের  মূলনীতি অনুমোদিত হয়েছিল। ১৯৩৯ সালে তিনি ‘ভিয়েতনাম স্বাধীনতা লীগ’ নামে এক রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধের প্রভাব ইন্দোচিনে ভীষণভাবে পড়ে। ১৯৪০ সালে জার্মানির কাছে ফ্রান্সের পরাজয় ঘটলে সেই সুযোগে জাপান ইন্দোচীন দখল করে নেয়। যুদ্ধ চলাকালীন হো চি মিন কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠিত করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল ইন্দোচীনে ফরাসি ও জাপানিদের উৎখাত করে ভিয়েতনামীদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৪৫ সালে জাপানের পতন ঘটলে তিনি টংকিং -এর রাজধানী হ্যানয় দখল করে আনাম ও কোচিং চিনে তাঁর কর্তৃত্ব ,প্রতিষ্ঠা করেন। আনামের সম্রাট বাও‍- ডাই সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং হো-চি-মিন ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। ১৯৪৬ সালে ফ্রান্স পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে হো চি মিনের সঙ্গে আপোষ মীমাংসা করে। ফরাসি ইউনিয়নের অঙ্গ হিসেবে ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়া হয়। কিন্তু ফ্রান্সের যথার্থ অভিসন্ধি সম্বন্ধে ভিয়েতনামীরা সন্দিহান হয়ে ওঠে। এরই ফলশ্রুতিতে ভিয়েতনামের সঙ্গে ফ্রান্সের সংঘর্ষ আবার শুরু হয়ে যায়। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সে আশ্রিত বাও-ডাই সরকারকে স্বীকার করে নেয়। এই অবস্থায় চীনরাশিয়া ‘ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্র’কে স্বীকৃতি দেয়। ফ্রান্সের সঙ্গে ভিয়েতনামীদের যুদ্ধ বেঁধে যায়। ১৯৫৩ সালে ফরাসি শক্তির সম্পূর্ণরূপে পরাজয় ঘটে এবং সেই বছর জেনেভায় আন্তর্জাতিক বৈঠকে ইন্দোচীন সমস্যা আলোচিত হয় এবং ভিয়েতনামকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যথা -উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম। ভিয়েতনামকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। উত্তর ভিয়েতনামে হো চি মিনের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। এই প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন হো চি মিন। তবে তিনি কখনোই রাষ্ট্রপতির জন্য নির্দিষ্ট বাসভবনে বাস করেননি। রাষ্ট্রপতি ভবনের পেছনদিকে অবস্থিত একটি বাড়িতে তিনি থাকতেন, যেটি বর্তমানে ‘প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস হিস্টোরিক্যাল সাইট’ হিসেবে অভিহিত হয়।

আরও পড়ুন:  সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী

বিপ্লবী এই নেতা ভিয়েতনামকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে‌ স্বীকৃতি দেবার জন্য এবং দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন আন্দোলন করে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ  ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ। উত্তর ভিয়েতনামে হো চি মিন সরকার বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ ও জনগণের মধ্যে জমি বন্টন করে মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে ভিয়েতনাম আবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধ ‘দ্বিতীয় ইন্দো চায়না যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। ফরাসি শাসন থেকে মুক্ত হলেও নতুনভাবে আগ্রাসন নীতি চালায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এই সময় ভিয়েতনামের প্রেরণাশক্তি ছিলেন হো চি মিন। ১৯৬০ সালে দক্ষিণ ভিয়েনাতে হো চি মিনের সহায়তায় ‘জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট” বা ‘ভিয়েনা কং’ গড়ে ওঠে।মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি উত্তর ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন ছিলেন। ১৯৬২ সালে মার্কিন বিমান বাহিনী যৌথ আক্রমণ শুরু করে। ১৯৬৫ সালে পর থেকে ভিয়েনায় প্রত্যক্ষভাবে মার্কিন হস্তক্ষেপ বাড়তে থাকে এবং বহু নিরীহ মানুষ মারা যায়। এর প্রতিবাদে ভিয়েনা কং এবং উত্তর ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী একযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে।১৯৭৩ সালে আমেরিকা ভিয়েতনামের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। ১৯৭৬ সালে ‘ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ জন্ম নেয়।  দক্ষিণ ভিয়েতনামের পতনের পর সেখানকার পূর্বতন রাজধানী সাইগন এর  নাম পাল্টে ‘হো চি মিন সিটি’ রাখা হয় এই মহান রাষ্ট্রনায়কের সম্মানার্থে।

তবে হো চি মিন স্বাধীন ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনাম দেখে যেতে পারেননি। ১৯৬৯ সালে ২ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এই মহান নেতার মৃত্যু হয় ।মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

চৈতন্যদেবের অসামান্য জীবনী দেখুন

চৈতন্য জীবনী

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন