হোমাই ব্যারাওয়াল্লা

হোমাই ব্যারাওয়াল্লা

হোমাই ব্যারাওয়াল্লা (Homai Vyarawalla) হলেন ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা চিত্রসাংবাদিক (Photo Journalist)। তাঁর ক্যামেরা দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে ব্রিটিশ উপনিবেশ পরাধীন ভারতবর্ষের থেকে স্বাধীন ভারতে উত্তরণের নানা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ও তাঁর রূপকারদের সাদাকালো ফ্রেমে সযত্নে বন্দী করে রেখেছে। ১৯৩০এর দশকের শেষ দিকে তিনি আলোকচিত্র শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং ১৯৭০ সালে তিনি তাঁর জীবনের শেষ ছবিটি তোলেন। তিনি নিজের তোলা ছবিগুলি ‘ডালডা১৩’ ছদ্মনাম ব্যবহার করে নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করতেন। ২০০৬ সালে বিবিসি তাঁরই গৃহীত বহু দুর্লভ আলোকচিত্র ব্যবহার করে ব্যাক্তিগত ও কর্মজীবনের একটি সময়ানুক্রমিক ইতিবৃত্ত ‘ইন্ডিয়া ইন ফোকাস:ক্যামেরা ক্রনিক্যালস অফ হোমাই ব্যারাওয়াল্লা’ (India In Focus: Camera Chronicles of Homai Vyarawalla) নামক গ্রন্থ প্রকাশ করে তাঁকে সম্মান প্রদান করেছে। ২০১১ সালে কালজয়ী এই চিত্র সাংবাদিক পদ্মবিভূষণে সম্মানিত হন।

১৯১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর গুজরাটের নভসারিতে এক পার্সি পরিবারে হোমাই হাতিরামের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম দোসসাভাই হাতিরাম (Dossabhai Hathiram) এবং মায়ের নাম সুনাভাই হাতিরাম (Soonabhai Hathiram)। পেশাগত জীবনে হোমাইয়ের বাবা একটি ভ্রাম্যমান নাট্যগোষ্ঠীর (Travelling theatre group) অভিনেতা ছিলেন। তাই গুজরাটে জন্ম হলেও হোমাইয়ের শৈশব কেটেছিল ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে।

পরাধীন ভারতের কুসংস্কার ও অশিক্ষার অন্ধকারে আচ্ছন্ন সমাজের অংশ হাতিরাম দম্পতি উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না। পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রতিকূলতাও তাঁদের নিত্যসঙ্গী ছিল। তবু হোমাইয়ের পড়াশোনাতে তাঁদের উৎসাহ, উদ্যমই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। তারদেও এলাকার গ্রান্ট রোড হাই স্কুল থেকে তিনি তাঁর শ্রেণীতে একমাত্র ছাত্রী হিসেবে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাশ করলেন। এরপর সপরিবারে তৎকালীন বোম্বে শহরে বসবাস শুরু করলে হোমাই অর্থনীতিতে ডিগ্রীলাভ করার জন্য সেখানকার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। এরপর তিনি তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থাতে নারীদের জন্য প্রথাগতভাবে প্রচলিত বিষয়ের বাইরে বেরিয়ে জে.জে স্কুল অব আর্টস এ আলোকচিত্র (Photography) বিষয়ে পড়াশোনা করেন।

১৩ বছর বয়সে তাঁর আলাপ হয় মানেকশ ব্যারাওয়াল্লার সঙ্গে। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই ক্যামেরাকে ভালোবেসে ফেললেন হোমাই। পরবর্তীকালে ১৯৪১ সালে মানেকশ জামশেঠজী ব্যারাওয়াল্লার (Manekshaw Jamshetji Vyarawalla) সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন হোমাই। তিনি পেশায় টাইমস অব ইন্ডিয়ার আলোকচিত্রশিল্পী ও হিসাবরক্ষক (Photographer and Accountant) ছিলেন। তাঁদের একমাত্র পুত্রের নাম ফারুক।

কলেজে পড়াকালীন একটি পিকনিকের ছবি তোলার অ্যাসাইনমেন্ট পান হোমাই, ছবিগুলি একটি স্থানীয় সংবাদপত্র দ্য বম্বে ক্রনিকল্-এ(The Bombay Chronicle) ছাপা হয়। সেই শুরু। এরপর তিনি ফ্রিলান্সে নানা অ্যাসাইনমেন্ট নেওয়া শুরু করলেন। ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকার পাতায় ‘লাইফ ইন মুম্বাই’ শীর্ষক ছবিগুলি প্রকাশ পাওয়ার পর তিনি গণমাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। ইতিমধ্যে পারিপার্শ্বিক নানা ধরনের ছবির সঙ্গে সঙ্গে সদ্য সূচিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের চিত্রও বন্দী হল তাঁর ক্যামেরায়। ব্রিটিশ ও পার্সি নারীরা ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসার চিত্রগুলি তার মূর্ত প্রতীক। সামাজিক দিক থেকে নারীদের তৎকালীন অবস্থান অনুযায়ী চিত্র গ্রহণ বা চিত্রসাংবাদিকতা ছিল পুরুষের একচেটিয়া পেশা। তাই ছবির স্বার্থে এতদিন নিজের সমস্ত ছবি হোমাই তাঁর স্বামীর নামে প্রকাশ করতেন।১৯৪২ সালে তাঁরা দিল্লীর ‘ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসে’র চাকরি নিয়ে দিল্লী পৌঁছালে হোমাই ভীরাওয়াল্লার কর্মজীবন নতুন মাত্রা পায়। দিল্লীতে হোমাই রাজনৈতিক নেতানেত্রীসহ বহু বিশিষ্ট জনের চিত্রগ্রহণ করেন – কখনো কাছ থেকে তাঁদের অবসরের স্বতস্ফূর্ততা আবার কখনো গুরুগম্ভীর কর্মব্যস্ততা সবই ধরা পড়েছে তাঁর লেন্সে। তাঁর আলোকচিত্রে একদিকে চীনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জৌ এনলাই (Zhou Enlai), ভিয়েতনামের নেতা হো চি মিন (Ho Chi Minh), ইংল্যান্ডের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ (Queen Elizabeth II), আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির (John F Kennedy) মতো বরেণ্য অতিথিরা ছিলেন। অন্যদিকে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান, মহাত্মা গান্ধী থেকে জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধীর মতো ভারতবর্ষের প্রবাদপ্রতিম ব্যাক্তিত্ব সকলকেই সাদাকালো ফ্রেমে বন্দী করে রেখেছেন হোমাই। ব্যাক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছেন এঁদের মধ্যে তিনি জহরলাল নেহেরুর ছবি তুলতেই সবথেকে বেশী পছন্দ করতেন। ১৯৫৬ সালে সিকিমের নাথুলা দিয়ে ১৪তম দলাই লামার প্রথম ভারতে আসার ঐতিহাসিক চিত্র ছিল তাঁর ক্যামেরাতে।নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অধিকাংশ আলোকচিত্রে হোমাই ভীরাওয়াল্লাকে তাঁর ছদ্মনাম ‘ডালডা ১৩’ (Dalda13) ব্যবহার করতে দেখা গেছে। তাঁর এই বিচিত্র ছদ্মনামটির প্রথমাংশে লুকিয়ে ছিল তাঁর কেনা প্রথম গাড়ির নম্বর প্লেটে থাকা ‘ডিএলডি ১৩’ (DLD13)। এছাড়া ১৩ সংখ্যাটিকে পয়মন্ত হিসেবে বিবেচনা করে নির্বাচনের আড়ালে ছিল দুটি মজার তত্ত্ব। ১) হোমাইয়ের জন্মসাল ১৯১৩ এবং ২) তাঁর স্বামী মানেকশও এর সঙ্গে প্রথম আলাপের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৩ বছর।

১৯৬৯ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর ১৯৭০ সালে হোমাই ব্যারাওয়াল্লা নিজের কর্মজীবন থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। কর্মজীবনে তাঁর একটিমাত্র আক্ষেপ ছিল গান্ধীজীর জীবনের শেষ অংকে উপস্থিত থাকতে না পারা। যেহেতু সেদিন ঘটনাস্থলে কোন চিত্রসাংবাদিকই ছিলেন না, তাই সময়মতো স্ত্রীকে সেখানে হোমাই নিতে না পারার আফশোস ছিল মানিকশও এরও। অবসর নেওয়ার পর হোমাই দিল্লীর বাস তুলে দিয়ে পিলানিতে তাঁর কর্মরত ছেলের কাছে চলে যান। শেষে ১৯৮৯ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছেলের মৃত্যুর পর তিনি জন্মস্থান গুজরাটে ফিরে ভাদোদরাতে একটি নতুন বাসভবনে একান্তে বসবাস করতেন।জীবনের শেষ দুটি দশক তিনি গাছপালা ও বাগান পরিচর্যা করে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। এছাড়া কর্মব্যস্ত জীবনে তাঁর নারী সাহচর্য লাভের সুযোগ ছিল সীমিত এবং ক্ষুদ্র পরিসরে তাঁদের সংসার ও বস্তু কেন্দ্রীক, পরনিন্দা-পরচর্চামুখর জীবন থেকে দূরে সরে থাকতেন হোমাই। শেষ জীবনে তিনি আরো অনেক মহিলার সংস্পর্শে এলে তাঁর ধারণার পরিবর্তন হয় এবং বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

হোমাই ব্যারাওয়াল্লা তথা ‘ডালডা ১৩’ তাঁর দীর্ঘ চল্লিশ বছরের কর্মজীবনে কখনো সাধারণ মানুষের জীবনের, কখনো বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব পীড়িত দেশের আবার কখনো দেশ-বিদেশের নামিদামি ব্যক্তিত্বদের অজস্র মুহুর্তদের মৌন সাক্ষীর ভূমিকা পালন করে গেছেন। একটি নিপীড়িত, পরাধীন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্জন ও তার পরবর্তী ঘটনাক্রমকে ছবিতে ধরে রাখার কঠিন কাজটির জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট লর্ড মাউন্টব্যাটেনের রিসেপশন থেকে লালকেল্লাতে পতাকা উত্তোলন পর্যন্ত রূপকথার সাক্ষী দেয় তাঁর ছবি। এছাড়া স্বাধীনতার পরে মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহেরুর শেষকৃত্যের ছবিগুলি তাঁর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে অন্যতম রূপে বিবেচনা করা যায়।

১৯৯৮ সালে ‘আউটস্ট্যান্ডিং উওম্যান মিডিয়া পার্সন’ (Outstanding Woman Media Person) হিসেবে হোমাই ব্যারাওয়াল্লা ‘চামেলী দেবী জৈন পুরস্কার’ লাভ করেন।২০১১সালে হোমাই ভারত সরকার কর্তৃক দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান পদ্মবিভূষণে ভূষিত হন। এছাড়াও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক দ্বারা ‘ন্যাশনাল ফটো অ্যাওয়ার্ড ফর লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট’-এ (National Photo Award for Lifetime Achievement) সম্মানিত হন। ‘ব্রিটিশ আর্টস কাউন্সিল’ ১৯৯৬ সালে হোমাইয়ের জীবন অবলম্বন করে ‘ডালডা ১৩’ (Dalda 13) নামক একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে এবং ২০০৬ সালে ‘ইন্ডিয়া ইন ফোকাস:ক্যামেরা ক্রনিক্যালস অফ হোমাই ভীরাওয়াল্লা’ (India In Focus: Camera Chronicles of Homai Vyarawalla) নামক গ্রন্থ প্রকাশ করে তাঁকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। দিল্লীর ‘দ্য আলকাজি ফাউন্ডেশন ফর দ্য আর্টস’ কর্তৃপক্ষ (The Alkazi Foundation for the Arts, Delhi) তাঁর গৃহীত আলোকচিত্রগুলি তাদের ‘চিরকালীন সংগ্রহ’ (Permanent Collection) হিসেবে সংরক্ষণ করে তাঁকে সম্মান প্রদান করেছে। ৯ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে হোমাই ভীরাওয়াল্লার ১০৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গুগল ডুডল ফিচার করে ‘ফার্স্ট লেডি অব দ্য লেন্স’ (First Lady Of the Lense) হিসেবে তাঁকে সম্মান জানায়।

২০১২ সালের জানুয়ারীতে গুজরাটের ভাদোদরাতে নিজের শেষ জীবনের বাসভবনে খাট থেকে পড়ে গিয়ে ঊরুসন্ধির হাড় ভেঙে যায় হোমাইয়ের। প্রতিবেশীদের সহায়তায় হাসপাতালে পৌঁছান ও কিছুদিন চিকিৎসাধীন থাকেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কিছুদিন পর ১৫ জানুয়ারি ফুসফুসের রোগে (Interstitial Lungs Disease) আক্রান্ত হয়ে ৯৮ বছর বয়সে হাসপাতালেই হোমাই ব্যারাওয়াল্লার মৃত্যু হয়।

3 comments

আপনার মতামত জানান