
জয়চন্ডী পাহাড়ের সাথে সকল বাঙালির কমবেশি পরিচিতি আছে। সৌজন্যে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত হীরক রাজার দেশ। পাহাড়ের ওপরে জয়চন্ডী দেবীর মন্দির। পাহাড়ের ওপর থেকে প্রকৃতির অপূর্ব রূপ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে বহুবছর আগে ডাকাতরা এই পথ ব্যবহার করত।
পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর মহকুমার সদর শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জয়চন্ডী পাহাড়। এই পাহাড় ছোট নাগপুর মালভূমির অংশ। পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় ৮০০ ফুট। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বড়ো বড়ো পাথর বা বোল্ডার। তারই মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে প্রধান তিনটি পাহাড়। জয়চন্ডী, দক্ষিনাকালী বা কালী পাহাড়, এবং যুগঢাল। এর মধ্যে জয়চন্ডী পাহাড়েই ওঠার রাস্তা রয়েছে।
এখানেই ১৯৭৮ সালে সত্যজিৎ রায় তাঁর হীরক রাজার দেশে চলচ্চিত্রটির শুটিং করেন সেই দৃশ্যের, যেখানে উদয়ন পন্ডিত একটি পাহাড়ের গুহায় লুকিয়েছিল। তারপর তার সাথে গুপী ও বাঘার সাক্ষাৎ। পাহাড়ের সামনে গেলেই চোখের সামনে আজও ভেসে উঠবে গুপি বাঘার ভোজন দৃশ্য অথবা উদয়ন পন্ডিতের সঙ্গে গুপি বাঘার প্রথম দেখা হওয়ার সেই দৃশ্যটি। স্থানীয় অনেকের স্মৃতিতে আজও অমলিন বিশ্ববরেন্য পরিচালকের সঙ্গে সেই শুটিং এর দিনগুলি।

পাহাড়ের ওপর রয়েছে মা চণ্ডীর মন্দির। বলা হয় এই মন্দির থেকেই পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে। প্রায় ৫০০ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে মন্দিরে। বসন্তকালে পাহাড়ের গায়ের জঙ্গলে লাল পলাশের রঙ দেখতে পাওয়া যাবে। পাহাড়ের ওপর থেকে নিচের দৃশ্য অসাধারণ। সত্যজিতের স্মৃতিতে পাহাড়ের পাদদেশে তৈরী হয়েছে একটি স্থায়ী মঞ্চ। ডিসেম্বরের শেষে পর্যটন সমারোহ হয় এখানে, এছাড়াও ফেব্রুয়ারীতে মেলা বসে এখানে। এই দুই সময় বাদে এ চত্বরে নির্জনতাই বিরাজ করে। নির্জন এই পাহাড়ে একদুদিনের জন্য আসলে মনের ক্লান্তি দূর হয়ে যাবেই। পাহাড়ের ঠিক নিচেই একটি গ্রাম, নাম নন্দুয়ারা।
জয়চন্ডী পাহাড় যাবার জন্য বর্তমানে জয়চন্ডী আছে। স্টেশন থেকে পাহাড়ের দুরত্ব আড়াই কিমির মত। আগে আদ্রা স্টেশন থেকে যেতে হত, আদ্রা থেকে পাহাড়ের দুরত্ব ৪ কিমি। কলকাতা থেকে গাড়িতে জয়চন্ডী পাহাড় যেতে লাগে ঘন্টা পাঁচেক।
জয়চন্ডী পাহাড়ে থাকবার খুব বেশি হোটেল নেই। পশ্চিমবঙ্গ ইউথ হোস্টেল ছাড়া আরও দু একটি হোটেল আছে। আবার গড়পঞ্চকোটের হোটেলে থেকেও এখানে একদিনের জন্য ঘুরতে আসা যায়। গড়পঞ্চকোট থেকে জয়চন্ডীর দুরত্ব মাত্র ১৮ কিমি।

এখানে পাহাড়ের শোভা উপভোগ করুন। উদয়ন পন্ডিতের সেই গুহাটার খোঁজ করতে পারেন। এই পাহাড়ে রক ক্লাইম্বিংয়ের প্রশিক্ষণ হয়। পাহাড়ের মাথায় উঠে একবারটি নিচে তাকান, সিঁড়ি ভাঙার কষ্টটুকু এক লহমায় গায়েব হয়ে যাবে। সে এক অসাধারণ দৃশ্য, একদিকে শহরের ব্যস্ত নাগরিক জীবন, অন্যদিকে দূর আদিবাসী পল্লীর নিজস্ব ছবি। আরো দূরে ধু ধু মাঠ, মাঝে বিক্ষিপ্ত সবুজ আপনার শহুরে চোখে এনে দেবে এক মায়াবী পরশ। বসুন না দু দন্ড সামনের উচু কালো পাথরটায়, কেউ তো বাধা দেওয়ার নেই। পাহাড় চূড়াতেই দেখা মিলবে মা চন্ডী মাতার মন্দিরের। ভক্তিভরে পুজো দেওয়ার সুযোগও মিলবে। পাহাড়ের উপরে রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার, এখন ধ্বংসাবশেষটুকুই অবশিষ্ট। শোনা যায় কাশিপুরের রাজার সৈন্যরা এখান থেকে নজর রাখতেন বহুদূর পর্যন্ত।
গরমকালে এই অঞ্চলে অত্যধিক গরম থাকে, সেই সময়ে না যাওয়ায় ভালো । বহু সংখ্যক পর্যটক এই অঞ্চলে শীতকালে এসে থাকে এই অঞ্চলের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে । জয়চন্ডী পাহাড়ে আসার সেরা সময় হলো নভেম্বর থেকে মার্চ।
পাহাড়ে সন্ধ্যের পর উঠবেন না। বয়স্ক মানুষদের বিশেষ করে যাদের পায়ের ব্যাথা আছে, তাদের নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে না ওঠাই ভালো।
ট্রিপ টিপস
- কিভাবে যাবেন – জয়চন্ডী পাহাড় যাবার জন্য বর্তমানে জয়চন্ডী আছে। স্টেশন থেকে পাহাড়ের দুরত্ব আড়াই কিমির মত।
- কোথায় থাকবেন – জয়চন্ডী পাহাড়ে থাকবার খুব বেশি হোটেল নেই। পশ্চিমবঙ্গ ইউথ হোস্টেল ছাড়া আরও দু একটি হোটেল আছে। আবার গড়পঞ্চকোটের হোটেলে থেকেও এখানে একদিনের জন্য ঘুরতে আসা যায়।
- কি দেখবেন – জয়চণ্ডী পাহাড় এবং পাহাড়ের মাথায় মা চণ্ডীর মন্দির। এছাড়াও কাছাকাছি ঘোরার মধ্যে বিরিঞ্চিনাথের মন্দির, গড়পঞ্চকোটের গড়, বরন্তিতে মুরাডি লেক, কল্যাণেশ্বরী মন্দির।
- কখন যাবেন – গরমকালে এই অঞ্চলে অত্যধিক গরম থাকে, সেই সময়ে না যাওয়ায় ভালো । জয়চন্ডী পাহাড়ে আসার সেরা সময় হল নভেম্বর থেকে মার্চ।
- সতর্কতা –
- স্থানীয় বাসিন্দারা সন্ধ্যের পরে লজের বাইরে বেরোতে নিষেধ করে।
- পাহাড়ে সন্ধ্যের পর উঠবেন না।
তথ্যসূত্র
- নিজস্ব প্রতিনিধি
- https://en.wikipedia.org/
- https://ajanapathe.com/
- https://indiarailinfo.com/
One comment